Advertisment

অটিস্টিক সন্তানের মায়ের অভিজ্ঞতা ও স্বপ্ন

যাঁরা অটিজম স্পেকট্রামে আছেন তাঁরাও সমাজের অংশ। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, অটিজম স্পেকট্রামের মানুষদের নিজেদের মত করে থাকতে দিয়ে ও থাকার সুযোগ করে দিয়ে কিছুটা মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারি তাহলে সকলের মঙ্গল।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Autism Awareness Day

ছবিটি বিনায়ক রুকুর আঁকা

আমরা আজ যারা মধ্যচল্লিশে, আমাদের ছোটবেলায়, আমরা সবাই অটিজম ব্যাপারটা সম্ভবত বেশিরভাগই সে ভাবে জানতাম না। আমার ছেলের আড়াই বছর বয়সে যখন অটিজম নির্ণয় হয়, সত্যি বলতে কী আমি বুঝতেই পারছিলাম না বিষয়টা ঠিক কী! সেই সময়ে ইন্টারনেট এতটা আধিপত্য বিস্তার করেনি।

Advertisment

অনেক কষ্ট করে আমাদের ব্যাপারটি সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছিল। ছেলের কিছু কথা বারবার বলা, কোনও কিছু ছোটখাটো জিনিসের জন্য প্রচণ্ড চিৎকার করে কাঁদা, এবং প্রশ্নকর্তার চোখের দিকে না তাকিয়ে কথা বলা, ব্যথা/শারীরিক আঘাতের সীমিত বোধ, এসব সমস্যা দেখে আমরা আমাদের ছেলে রুকুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই এবং অটিজম নির্ণয় হয়।

আমার ছেলে বিনায়ক রুকু। তার ১৭ বছর বয়স। তার অটিজম আছে।

আরও পড়ুন, অটিস্টিক কিশোর রুকুর বই, অপর ছায়াপথের ছবি-লেখা

অন্য যে কোনও প্রতিবন্ধীদের আমরা দেখেই বুঝতে পারি। কিন্তু অটিজম যেহেতু বোধজনিত সমস্যা, এদের দেখে সবসময় বোঝা যায় না, এবং আমাদের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় এদের তথাকথিত "স্বাভাবিক মানুষ" হিসেবে গড়ে তোলার জন্য। অথচ এদের নিজেদের মত থাকতে দিলে বা আমরা যদি এদের সাথে একটু মানিয়ে নিতে পারি, তা সম্ভবত বেশি কার্যকর হয়।

অটিজমের লক্ষণ শুধু মাত্র ব্যবহারে ধরা পড়ে না, বা অটিজম আক্রান্তের মেলামেশায় অসুবিধে হয়, তা-ই নয়। এটি এমন একটি অবস্থা যা একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম। কিছু লক্ষণ লুকিয়েও থাকে - যেমন বেশি আলো সহ্য করতে না পারা, লোকজনের তীব্র হুল্লোড়ে অস্বস্তি, কোনও জিনিস নিচু থেকে তোলার সময়ে অসুবিধা, মুখের পেশীর উপর নিয়ন্ত্রণহীনতা, মুখভঙ্গিমা নিয়ন্ত্রণে অপারগতা, প্রভৃতি। এসব নিয়েও নিজেদের সব পরিবেশ ও অবস্থায় মানিয়ে নেওয়া এবং সঠিক মতো চালনা করা এদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জ।

রুকু যখন ছোট, সে যেমন 'বাবা' ডাকতে পারত না। মানে বাবা, মা, দাদা, শব্দগুলো এক বছরের মধ্যে বলতে পারত, কিন্তু বাবা মানে যে 'বাবা' পরিচিতি, নাম, বা সম্পর্কযুক্ত একজন ব্যক্তি, সেকথা বুঝতে পারত না। যেহেতু আমি শ্বশুরমশাইকে বাবা ডাকতাম, ও দাদুকে আমার মত সুর করে "ও বাবা" ডাকত। তাই আমরা বিনায়ক রুকুকে 'পাপা' শেখাই। তারপর থেকে ও 'পাপা' মানে 'বাবা' বোঝে। দাদুকে 'আদা' বলতে থাকে।

অটিজম একটি 'স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার'। প্রতিটি অটিস্টিক মানুষ দ্বিতীয় আরেকজনের থেকে আলাদা। এই জায়গাতে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন একটি করে চ্যালেঞ্জ নিতে হয় আমাদের মতো মা-বাবাদের।

এপ্রিল মাস আমাদের কাছে একটি বিশেষ মাস। গোটা এপ্রিল জুড়ে চলে অটিজম সচেতন সমাজ গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন কাজ। এপ্রিল ২ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই মাসের সূচনা। নীল পোশাক পরে সবাই এই দিন সচেতনতা প্রচার করে থাকেন। পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রে নীল আলো জ্বালিয়ে রাখা হয় বিভিন্ন স্মৃতিসৌধ, মিনার ইত্যাদির স্তম্ভে।

২ এপ্রিল Autism Awareness Day। এই দিনটি সকলকে সচেতন হওয়ার ডাক দেয়। আমরা যারা 'living with Autism', তারা কিছুটা হলেও এই স্পেকট্রাম সম্পর্কে জানি, কিন্তু অনেক মানুষ এখনও এ বিষয়ে জানেন না। তাঁদের জানানোর জন্যই এই রঙের পোশাক পরে ছবি ইত্যাদি দিয়ে প্রচার।

যাঁরা অটিজম স্পেকট্রামে আছেন, তাঁরাও সমাজের অংশ। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, অটিজম স্পেকট্রামের মানুষদের নিজেদের মত করে থাকতে দিয়ে ও থাকার সুযোগ করে দিয়ে কিছুটা মানিয়ে গুছিয়ে নিতে পারি, তাহলে সকলের মঙ্গল।

এই পৃথিবী সবার।

আমাদের সমাজে প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, 'সন্তান অন্ধের যষ্টি'। অর্থাৎ নিজের চাহিদা, না পাওয়া, নিজের আগামী সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যেই যেন সন্তান পালন। যাঁদের সন্তান নেই, তাঁরা নিন্দার মুখে পড়েন।ব্যতিক্রম একেবারে নেই তা নয়, তবে আমি সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা বললাম। সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা যারা এমন মা যাঁদের সন্তানের অটিজম আছে, তাঁরা নিজেরা বাচ্চাদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম খুঁজে চলি। কারণ আমাদের পরেও আমাদের সন্তানরা থেকে যাবে প্রকৃতির সাধারণ নিয়মে। তাদের ভবিষ্যৎ কী?

বিভিন্ন দেশে এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে থাকে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে সঠিকভাবেও কোন নিয়ম নেই। থাকলেও যেখানে আমাদের সন্তানদের রাখা হবে, সেখানকার পরিকাঠামো একেবারেই যথাযথ নয়।

প্রতি বছর এপ্রিলের দ্বিতীয় দিনে সারা পৃথিবীর মত আমাদের দেশেও অটিজম নিয়ে আলোচনা হয়, অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু সরকারি নীতি নির্ধারণ, আমাদের বাচ্চাদের অধিকার সম্বন্ধে সঠিক দিশা আমরা আজও পাই নি সেভাবে।

তবুও আশা রাখা।

Advertisment