মিঠুন ভৌমিক
১৯৩০ সাল থেকে আরম্ভ হয়েছে ফুটবল বিশ্বকাপ। তবে শুরুরও তো শুরু থাকে। এ প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সেটা অতীব রোমাঞ্চকর। প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল বলতে তার আগে ছিল অলিম্পিক, যা শুধুই অপেশাদারদের জন্য। ১৯০৮ থেকে শুরু হয়ে অলিম্পিক, ফুটবল যখন বেশ কৌলীন্য পেয়ে গেছে তখন দানা বাঁধতে শুরু করে স্রেফ ফুটবলের জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ভাবনা।
প্রথমদিকের অলিম্পিক খেলত শুধু গ্রেট ব্রিটেন এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো। আরও পরে ক্রমশ ইউরোপের অন্য দেশগুলো খেলতে শুরু করে। ১৯২৪ সালে প্রথম খেলতে এল উরুগুয়ে, এবং এসেই পরপর ৫ ম্যাচে ২০ গোল করে সোনা জিতে ফেলল। প্রবল অহংকারী ব্রিটিশ ফুটবল মহল তার আগে অবধি দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলকে খুবই হেয় করে এসেছে। এই তুমুল পারফরম্যান্সে সে মনোভাব একেবারেই উধাও হয়ে যায়।
উল্টোদিকে ব্রাজিল, আর্জেন্তিনা, উরুগুয়ের মধ্যেও যে হীনমন্যতা ছিল, তাও কেটে যায়। পরপর দুবার উরুগুয়ে সোনা পায় অলিম্পিকে। ইতিমধ্যে ইউরোপ ফুটবল পেশাদার হয়ে গেছে। ফলে অপেশাদারদের চ্যাম্পিয়ানকে বিশ্বসেরা ধরে নিতে আপত্তিও ছিল। এর অনেক আগেই কিন্তু ফিফা তৈরি হয়ে গিয়েছে। মূলত ব্রিটিশ একাধিপত্য ও খামখেয়ালিপনা রুখতে ১৯০৪ সালে ফ্রান্সের উদ্যোগে জোট বেঁধেছে সাতটি দেশ। ফ্রান্স ছাড়া সে তালিকায় রয়েছে বেলজিয়াম, সুইডেন, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, স্পেন ও সুইটজারল্যান্ড।
১৯২৮ সালে সেই ফিফা কংগ্রেসেই দেওয়া হল বিশ্বকাপের প্রস্তাব। ঠিক হল ১৯৩০-এর বিশ্বকাপের আসর বসবে উরুগুয়েতে। প্রথম বিশ্বকাপে খেলেছিল ১৩টি দল (উরুগুয়ে, মেক্সিকো, আর্জেন্তিনা, ব্রাজিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বলিভিয়া, চিলি, পেরু, প্যারাগুয়ে, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, রোমানিয়া ও যুগোস্লাভিয়া)। উল্লেখ্য, গ্রেট ব্রিটেন আমন্ত্রণ পেয়েও আসেনি। একইভাবে আসেনি জার্মানি, সুইডেন, ইতালি। শুধু তাই নয়, সুইডেন বিশ্বকাপ আয়োজন সমর্থনই করেনি। সে সময়ে দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের পরিসর বোঝা যায়নি। অনেকেরই মনে হয়েছিল অলিম্পিকই ‘আসল’ টুর্নামেন্ট। ভারতও ছিল এই মনোভাবের শরিক।
ভারতের বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েও না-যাওয়া নিয়ে অনেক কথা হয়। পরে এক জায়গায় গোষ্ঠ পাল বলেছিলেন, আরও নানা কারণের সঙ্গে বিশ্বকাপের গুরুত্ব নিয়ে সন্দেহও অন্যতম কারণ ছিল। ততদিনে ভারত অলিম্পিকে খেলতে শুরু করেছে, তাই অলিম্পিয়ানের মর্যাদার থেকে বেশি কী পাওয়া যাবে বিশ্বকাপে – এ প্রশ্ন তাঁদের মনে ছিল।
প্রথম বিশ্বকাপ অনেক দিক থেকেই অন্যরকম ছিল। সাধারণত আয়োজক দেশ উদ্বোধনী ম্যাচটি খেলে। সেবারও কথা ছিলো প্রতিযোগিতা শুরু হবে তিনটি ম্যাচ দিয়ে। কিন্তু যে স্টেডিয়ামে উরুগুয়ের খেলার কথা, সেই ‘এস্তাদিও সেন্তেনারিও’ তখনও সম্পূর্ণ না হওয়ায় ম্যাচটি পিছিয়ে যায়।
আরও পড়ুন: ফুটবলায়নের দিনগুলি- পৃথিবীজোড়া ফুটবল চর্চার ইতিহাস
আয়োজক দেশের ম্যাচ পিছিয়ে যাওয়ায় প্রথম ম্যাচ যৌথভাবে আয়োজন করে ফ্রান্স - মেক্সিকো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র – বেলজিয়াম। প্রথম গোলটি এল ফ্রান্সের লঁরার পা থেকে। সেই বিশ্বকাপেই প্রথম হ্যাটট্রিক করলেন আর্জেন্তিনার গিলেরমো স্তেবিল। সেটা আবার ছিলো তাঁর অভিষেক ম্যাচ। মোট ৮ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনিই। একটা কথা এখানে স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার। তিরিশের দশকেও কিন্তু ফর্মেশন হিসেবে ২-৩-৫ কেই মেনে চলছে সবাই। অর্থাৎ দুই ডিফেন্ডারের তথাকথিত ‘ব্যাক’ সিস্টেম, আর পাঁচ ফরোয়ার্ড।
পরের দুই বিশ্বকাপেই জয়ী ইতালি। ১৯৩৪ ও ’৩৮-এর বিশ্বকাপ, এবং মাঝের অলিম্পিক (১৯৩৬) সোনা নিয়ে সে ইতালির সর্ব অর্থেই স্বর্ণযুগ। ভিত্তরিও পোজোর মেথড ফুটবলের সেই সূচনা। হার্বার্ট চ্যাপম্যান বা আন্দ্রে মেইজলের মত যেসব কোচ ২-৩-৫ ফর্মেশন ভেঙ্গে জন্ম দিচ্ছিলেন নতুন নতুন স্ট্র্যাটেজির, তাঁদের সঙ্গেই অমর হয়ে থাকবেন পোজো। তাঁর ফর্মেশনে ইতালির খেলোয়াড়েরা দাঁড়াতেন দুটো ডব্লিউ এর মত। ৫ ফরোয়ার্ড মিলে একটা, আর ২ ব্যাক ও ৩ হাফ মিলে আরও একটা। এছাড়াও ম্যান মার্কিং ও শুরু করেছিলেন পোজো। একই সঙ্গে শুরু হয়েছিলো রাফ, কড়া ট্যাকলের যুগ, যা ১৯৩৪ বিশ্বকাপের ছন্দপতন ঘটায়।
খেলা শুরুর আর সামান্যই বাকি। এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক কিছু শুকনো তথ্য। এখনও অবধি দঃ আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলো মোট ১৯ বার জিতেছে বিশ্বকাপ। আর কোনও মহাদেশে এখনও অবধি যায়নি এই ট্রফি। ব্রাজিলই একমাত্র দল, যারা প্রতিটি টুর্নামেন্টেই খেলেছে। সবথেকে বেশিবার ট্রফি জেতার রেকর্ড ও তাদেরই। ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে এখনও পর্যন্ত সবথেকে বেশি দর্শক হয়েছে, এক লাখ নিরানব্বই হাজার। সবথেকে কম লোক হয়েছিলো ১৯৩০ সালে, পেরু বনাম রোমানিয়ার খেলায়, মাত্র ৩০০!
২০১৮ বিশ্বকাপে খেলবে আইসল্যান্ড, প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে জনসংখ্যা যাদের সবথেকে কম। সেখান থেকে ৬৬০০০ মানুষ আসছেন খেলা দেখতে, যা জনসংখ্যার ২০%। আই দিয়েই নাম শুরু আরেক দেশ ইন্ডিয়া, জনসংখ্যায় দ্বিতীয়, কিন্তু আজও তারা কোয়ালিফাইং রাউন্ডের গন্ডি পেরোয়নি। প্রসঙ্গত, ভারত ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে আমন্ত্রণ পেয়েও যায়নি (নানাবিধ কারণের মধ্যে খালিপায়ে খেলতে না দেওয়া, ব্রাজিল যাতায়াতের খরচ ও বিশ্বকাপের গুরুত্বহীনতা উঠে এসেছে)। আর তারপর থেকে ১৯৮২ অবধি যোগ্যতা নির্ণায়ক রাউন্ডই খেলেনি তারা।
আরও পড়ুন: History of Soccer: ফুটবলায়নের দিনগুলি (দ্বিতীয় পর্ব)
২০১৮ বিশ্বকাপের জন্য রাশিয়ায় বানানো হয়েছে ৯ টি নতুন স্টেডিয়াম। মোট মাঠের সংখ্যা ১২। লঝনিকিতে মুখোমুখি হচ্ছে রাশিয়া ও সৌদি আরব, যারা আবার ক্রমপর্যায়ে সবথেকে নিচের দুই দল। রাশিয়ার গ্যাঁট থেকে ১২ বিলিয়ান ডলার খরচ করে হচ্ছে এই মহাযজ্ঞ, আর আধুলির অন্য পিঠে জিম্বাবোয়ে, যারা কোয়ালিফাই করেও খেলতে পারবে না কোচের মাইনে না দিতে পারায়।
ফুটবল ইতিহাসের সবথেকে ঘটনাবহুল প্রতিযোগিতা শুরু মানেই চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে আসা। এবং উঠে আসা নানাবিধ বিতর্কের। পারফর্ম্যান্স বাড়ানোর ইঞ্জেকশন থেকে শুরু করে ট্র্যাজিক নায়ক, ফর্মেশনের দফারফা করে ছক ওল্টানো খেলা, ইতিহাসের ম্যাজিক। সেই সঙ্গে উঠে আসে অর্থনীতির ফাঁদে আটকে পড়া আধুনিক ফুটবল ও তার কুশীলব। আফ্রিকার কোন কোন দেশের জাতীয় দলের ১০০% খেলোয়াড় ইউরোপের ক্লাবে খেলেন। আবার স্পেন, ইংল্যান্ড বা জার্মানির মত কোনো কোনো দলের ৮০% সদস্য হয়ত দেখা যাবে নিজের দেশেই থাকেন। তাই ব্যালেন্স হারানোর কথাও উঠে আসতে বাধ্য। কিন্তু ফুটবলে যেমন পারফেক্ট ম্যাচ বলে কিছু হয়না, তেমনি ফুটবল নিজেও পারফেক্ট গেম না। যথার্থ ফুটবলরসিক মাত্রেই জানেন, জীবনের মত ফুটবলও ‘আনফেয়ার’।