ঘাটালের গায়ে জলের ঘা…

বছর ঘুরে যায়, পরিস্থিতির বদল হয় না ঘাটালের।

ঘাটালের গায়ে জলের ঘা…
ঘাটালের খাটাল-চিত্র

নীলার্ণব চক্রবর্তী: নদীর ঘাটের কাছে/ নৌকা বাঁধা আছে,/ নাইতে যখন যাই দেখি সে/ জলের ঢেউয়ে নাচে। নদীর ঘাট নয়, ঘাটাল। জল-লাঞ্ছিত এক জনভূমি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গিয়ে স্বচক্ষে, জলবক্ষে নেমে– দেখে, ত্রাণ দিয়ে এলেন, ঘাটাল পুরসভার দু’নম্বর ওয়ার্ডে, সঙ্গে ছিলেন দেব। তিনি ঘাটালের সাংসদ হলেও, ঘাটালের ঘাটে দাঁড়ানো অবস্থায় তাঁকে দেখে খোদ জলের দেবতা বলে মনে করেছেন পুরসভার জলবাসীদের অনেকে। কেউ কেউ বরুণদেব বরুণদেব বলে পেন্নাম ঠুকেছেন কিনা জানা নেই!

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার হ্যাটট্রিক করে গিয়েছে, তার আগে রেভোলিউশনের আসন পেতে ৩৪ বছর ঠায় বসেছিল বামেরা, তারও আগে কিং (king) ছিল কং মানে কংগ্রেস। ঘাটালের কিন্তু জল চলছে না তার পরেও, জমেই, পচা জলে দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে, কবি সুভাষ মুখুজ্জে ‘ফুল জমতে জমতে পাথর’ লিখেছিলেন, ঘাটালের জল জমতে জমতে জগদ্দল পাথর হয়ে এখানকার মানুষকে অকূল পাথারে ফেলেছে। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের পুরানো সেই দিনের কথাটা বার বার বলা হচ্ছে এই সময়ে, আহা কী সুন্দর সেই পরিকল্পনাটা, স্মৃতিচারণের মজাই আলাদা, স্মৃতি তো সতত সুখের, তাই না! যে প্ল্যানের শুরু আছে শেষ নাই, অকূল দরিয়া বললাম না, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান সপ্তদশ ঘাটের জল খেয়ে, ঘেঁটে গিয়ে, সব মাস্টারি তার ঘুচে গিয়ে, সে এখন নিরীহ ছাত্র হয়ে ক্লাসের বাইরে কান ধরে নিলডাউন।

রাজ্য বলে, মাস্টার প্ল্যানের অপমৃত্যুর জন্য দায়ী কেন্দ্র, কেন্দ্র স্বভাবতই উল্টো কথা বলে। তরজায় জল বাড়ে, ঘাটালের লোকজন কালো জলে নাইতে নামে প্রিয় পথে, ত্রাস কাটাতে কখনও ত্রাণ আসে, কখনও খবর আসে, আসবে ত্রাণ আসবে, সবুরে ত্রাণের চাল ফলে আলু ফলে, দূর থেকে বিশেষজ্ঞদের কথা ভেসে আসে, বন্যা মানেই পুরোটা খারাপ নয়, ভাল-র দিকটাও আছে। ঘাটালবাসী ভাবে– হিসি পেলে মুশকিল, পটি পেলে আরও মুশকিল, সবই উল্টো পথে ঘরে ঢুকে…!

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান ১৯৪৯ সালের, ভাল করে সিলমোহর পড়তে পড়তে বাম জমানা, এবং শিলাবতীর তীরে রুপোর কোদাল দিয়ে সেই সময়ের সেচমন্ত্রী প্রভাস রায়ের শিলান্যাস, সেটা ১৯৮২, রুপোর কোদালটা কোথায় গেল?… ঘাটালের ঘাট থেকে নৌকো ছাড়ার পর অথৈ জলের সঙ্গে নৌকার খেলা, ও মাঝি বাইয়া যাও রে… মনে ঘুরতে থাকে: যাদের রুপোর কোদাল খুঁজতে পাঠানো হয়েছিল, হারিয়ে গেছে তারা, সেই হারিয়ে যাওয়াদের খুঁজতে যাদের পাঠানো হয়েছিল, তারাও নিরুদ্দেশ, সেই তাদের খুঁজতে যাদের পাঠানো হয়েছিল, তারাও… সেচমন্ত্রী ছিলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজীব মানে পদ্ম, জলের সঙ্গেই তাঁর স্ফূরণ-সম্পর্ক, কাঁদতে কাঁদতে তৃণমূল ছেড়েছিলেন ভোটের আগে, তাঁর চোখের জল ঘাটালের জলের লেভেল বাড়িয়েছিল কি?

আরও পড়ুন দিল্লি সফর, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ- কেন এ পথে মমতা?

শুভেন্দু অধিকারী, সেচের দায়িত্বে ছিলেন, ঘাটালের বসতি-নদীর চেহারা তিনিও বদল করতে চেয়েছিলেন, তবে নিশ্চয়ই মনে মনে, একজন বলে উঠল– তোলাবাজ ভাইপো হটাও না বলে ঘাটালের বন্যা হটাও– এই ডাক দিতেই পারতেন– কী বলুন! এখন সেচমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রও ঘাটালকে জলের পাত্রই হয়তো ভাবছেন! দোষ কার, কার জন্য এই হাহাকার? আকাশবাতাসে উত্তরা অনুরণিত– ম্যান মেড, ম্যান মেড, ম্যান মেড…। এত ক্ষণ এই বন্যার কথা, যাঁদের দিকে আঙুল তুললাম, সবাই তো ম্যান, হোমোস্যাপিয়েন্স– তা-ই ম্যান মেড, ভুল কিসের? তা-ই ডিভিসিকে একা দোষী করলে চলে কী করে?

ডিভিসিকে আবার মোটেই ঋষিতুল্য, স্যানিটাইজড তুলসিপাতা ভাববেন না, তাদের দোষ এমনকী গলা-পর্যন্ত। বৃষ্টির বেলাগাম হবে, পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও, জলাধার যতটা খালি রাখার দরকার ছিল, তা কি তারা রেখেছিল? কেন রাতের আঁধারে ঘুমন্ত বাড়িতে জলাধারের ছাড়া জল দিনের পর দিন বছর-কে বছর ঢুকে পড়বে, ডিভিসিকে জবাব দিতে হবে বন্যা-জাগ্রত এমন প্রশ্নের। হ্যাঁ, নদীর দিকপালরা অনেকেই বলছেন, দামোদরকে ব্রিটিশরা বাঁধ দিয়ে ঘাটাল-সহ এ অঞ্চলের বারোটা বাজিয়েছে। বাঁধের ফলে দামোদরের শাখা নদীগুলি শুকিয়ে গিয়েই বেপথু পরিস্থিতি। তা নয় মানছি, ব্রিটিশরা শাখামৃগের ন্যায় কাজ করেছিল, দামোদরকে সরো অফ বেঙ্গল বা বঙ্গের বেদনা বলাটা তাদের উচিত হয়নি, কিন্তু তার পর বৃক্ষে যে এত শাখা তৈরি হল, সেই সবে ফুল ধরল না কেন? আপনারাই বা কেন লাগাতার গগনচুম্বী আন্দোলন করে ঘাটালের খাটাল-চিত্রের বদল করতে পারলেন না?

আরও পড়ুন খেলা হবে, আবার খেলা হবে…

দোষারোপের এই দুর্নিবার সময়ে, মনে পড়তেই পারে ঘাটালের এক সময়ের সাংসদ, প্রয়াত গুরুদাস দাশগুপ্তকে। হ্যাঁ, সংসদে তাঁর বাকপটুত্বে ঘাটালের লাভ কিচ্ছুটি হয়নি, কেন?… ধরা যাক– কেন্দ্রের দোষ, ধরা যাক নয়, সত্যি সত্যিই তাদের দারুণ দোষ আছে, কিন্তু যাঁরা মরে পচছেন, তাঁরা তো এ রাজ্যের, তাই রাজ্যকেই উপায়টা বার করতে হবে, যার বিয়ে তাকেই হুঁশে থাকতে হবে সেন্ট পারসেন্ট, কি! নাকি ঘাটাল ডুবলেই ঝুলি থেকে ‘কেন্দ্রের দোষ’ সিনেমাটা বার করে দেখালেই ষোল কলা পূর্ণ হয়ে যাবে?

কেন্দ্রও বাবা বলিহারি! ঘাটাল-প্ল্যান নিয়ে তারা যা করল, সে জন্য অলিম্পিক্সে ‘সরকারের প্রকল্প দৌড়’ ইভেন্টে তাদের গোল্ড মেডেল বাঁধা এবং রেকর্ডের টাইম জলের সাহারায় শিহরণ তোলা, সাঁতারু কোনিকেও হার মানাবে। একজন ফস করে বলে উঠলেন, আচ্ছা, প্রধানমন্ত্রী বার বার প্রচারে এলেন এ রাজ্যে , এক দিন যদি প্রচার-অভিযানটি বাদ দিয়ে, ঘাটাল-ফাইলটি উলটে দেখতেন খুলে, তা হলেই বুঝতেন পুলিশ ফাইলের যে কোনও এপিসোড এর কাছে নস্যি। ‘সুনার বাংলা’র স্বপ্ন সাকার করার রাস্তাটা হয়তো ওই ফাইলেই খুঁজে পেয়ে যেতেন মোদীজি।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Opinion news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Year after year flood misery continues for ghatal

Next Story
ইলেকট্রিক গাড়ির পথে আমেরিকা, কবে শিখবে ভারত
Exit mobile version