
জন্মগতভাবে একজন পুরুষ হলেও, শরীরে এবং মননে তিনি একজন মহিলা। এভাবেই তাঁর বেড়ে ওঠা। যাত্রা কিংবা নাটক তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি আদতে একজন পুরুষ। একসময় তাঁর রূপে মুগ্ধ ছিলেন সকলেই। তিনি চপল ভাদুড়ি। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

বাংলার যাত্রা শিল্পে শেষ জীবিত নারী চরিত্রে অভিনয় করা পুরুষ শিল্পী। যাত্রায় মেয়েদের আগমনের পূর্বে ছেলেরা নারীসাজে অভিনয় করতেন। চপল ভাদুড়ি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

জীবিতকালে উত্তম কুমার তাঁর অভিনয় দেখে নিজেই চমকে গিয়েছিলেন। তখন রবীন্দ্র সদনে স্বপনকুমারের ‘মাইকেল মধুসূদন’ পালা চলছিল। দর্শকদের মধ্যে ছিলেন উত্তমকুমার ও সুপ্রিয়া দেবীও। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

যাত্রা শেষ হওয়ার পরই সোজা গ্রিনরুমে চলে এলেন মহানায়ক। একজনকে ডেকে বললেন, ‘জাহ্ণবীর রোল যিনি করলেন তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।’ আমি তো ততক্ষণে মহিলা-সাজ ছেড়ে ফেলেছি। তাই পুরুষের পোশাকেই তাঁর সামনে গেলাম। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

উনি বললেন, ‘আহা বুঝতে পারছেন না, মাইকেলের মা-র রোলটা যে ভদ্রমহিলা করলেন তাঁর কথা বলছি।’ একজন তাঁকে বললেন, ‘দাদা, ইনিই জাহ্ণবীর রোলটা করেছেন। নাম চপল ভাদুড়ি। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

অভিনেত্রী প্রভাদেবীর ছেলে। ওঁরই দিদি অভিনেত্রী কেতকী দত্ত।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তমবাবু বললেন, ‘বিয়ে করেছ?’ মাথা নেড়ে না বললাম। উনি আরও অবাক হয়ে বললেন, ‘তুমি অবিবাহিত হয়ে এমন মাতৃভাব কেমন করে আনলে!’ ওঁকে প্রণাম করলাম, আর উনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন। ওঁর বুকে মাথা রেখেও তখন আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, যেখানে সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া দেবী মাথা রাখেন সেখানে কি সত্যিই আমি! এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

তখন সেলফি তোলার সুযোগ থাকলে এখনও মনের ভিতর সেই ছবি ধরা আছে। এক নাগাড়ে বলে যান চপল ভাদুড়ি। লাইট, দর্শকদের ছেড়ে মঞ্চের চপল রানির দিন কাটছে এখন বৃদ্ধাশ্রমে। উত্তর কলকাতার বৃদ্ধাশ্রমের দোতলায় তাঁর জৌলুসহীন ঘর। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

ঘরের দুটো জানালার মাঝে রামকৃষ্ণ দেবের একটা বড় ছবি ছাড়াও আছে তাঁর মা প্রভাদেবী, তাঁর বাবা তারাকুমার ভাদুড়ি, তাঁর ছোটদি কেতকী দত্তর ছবি। এসব নিয়ে এখন বেশ ভাল আছেন বলে জানান তিনি। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

জীবনের একটা অধ্যায় শেষ করে আরেকটা অধ্যায় শুরু করেছেন। অভিনয়কে তার জীবন থেকে চিরবিদায় জানিয়েছেন। মায়ের মৃত্যুর পর মাত্র সাত বছর বয়সে শ্রীরঙ্গম যাত্রায় তার অভিনয় জীবনের শুরু। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা ছিল সঙ্গিন। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

আমি তো বেশি পড়াশোনার সুযোগ পাইনি। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েই পড়াশোনা শেষ। অভিনয় ছাড়া আর কিছুই তেমন জানতাম না। অতএব রোজগারের জন্য যাত্রায় এলাম। নট্ট কোম্পানিতে। আমার কণ্ঠস্বর পাতলা ছিল বলে সকলে পরামর্শ দিলেন নারী চরিত্রে অভিনয় করতে। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

তখন যাত্রায় মেয়েরা অভিনয় করতেন না। মেয়ে সেজে ছেলেরাই অভিনয় করতেন। আমার আগে নারী চরিত্রের নামী অভিনেতা ছিলেন শ্যামাপদ রায়, তাঁকে ছবিরানি বলেই সকলে চিনতেন। আমিও প্রতিষ্ঠা পেলাম। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

একটানা প্রায় কুড়ি বছর অভিনয় করে গিয়েছি। আমিই কিন্তু যাত্রার শেষ নারী চরিত্রাভিনেতা। জ্যোৎস্না দত্ত ছিলেন যাত্রায় প্রথম মহিলা শিল্পী। তাঁর পরে হুড়হুড় করে মহিলারা এলেন অভিনয় করতে। এটা যে হবে তা জানতাম। কিন্তু তাঁরা এসে পড়ায় আমায় ধীরে ধীরে যাত্রা থেকে সরে আসতে হয়। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

সব কিছুরই পরিবর্তন হয় এটাও তেমন। পরিবর্তনকে মেনে নিয়েই জীবনে এগিয়ে যে হয় বলে মনে করেন চপল ভাদুড়ি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিন্দুর ছেলে-তে অপূর্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৫৫ সালে মর্জিনা আবদুল্লায় মর্জিনা চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক সাড়া জাগান। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

তখন ষোল বছর বয়স। ছিপছিপে শারীরিক গঠন। গলার স্বর খুব সরু। এক গ্রামে অভিনয় করতে গিয়েছেন। নারীবেশে যখন স্টেজে উঠতে যাবেন সে সময় কিছু যুবক তাঁকে পিছন থকে জাপটে ধরে বিয়ের জন্যে তুলে নিয়ে যায়। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

চপলরানি তখন চিৎকার করে বলছেন তিনি একজন পুরুষ। কিছুতেই তারা বিশ্বাস করে না। শেষমেশ নিজের মেকআপ সরিয়ে তাদের দেখালে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারেন। এরকমই ছিল তার প্রতিভা। রাজা দেবিদাস, চাঁদ বিবি, সুলতানা রাজিয়া, মহিয়সী কৈকেয়ী বিভিন্ন পালায় খ্যাতি অর্জন করেন। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

১৯৬০ সালে তিনি সর্বাধিক পারিশ্রমিক নিয়ে অভিনয় করতেন। রোজগার ছিল চার হাজার টাকা। বৃদ্ধাশ্রমের ছোট্ট ঘরে ৮২ বছরের এই অভিনেতার সম্বল এখন পুরনো দিনের এসব স্মৃতি। ২০১৭-তে পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে পেয়েছেন বঙ্গভূষণ। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

বৃদ্ধাশ্রমটা ঘেন্না করার মতো জায়গা নয়। এটা শান্তির নীড়। বুড়ো বয়সে একটু শান্তির খোঁজে তিনি নিজেই এই জায়গা খুঁজে নিয়েছেন। চপল কুমার থেকে চপল রানি হয়ে ওঠা কখনও মধুর আবার কখনও কখনও তিক্ত অভিজ্ঞতায় এখন সঙ্গী। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

অনেক কাছের মানুষদের বদলে যেতে দেখেছেন কিন্তু কারও প্রতি কোনও অভিযোগ নেই। সব কিছু থেকে দূরে সঙ্গী এখন বই আর বৃদ্ধাশ্রমের ছোট্ট কামরাটি। বাকি সময় উদাস চোখে তাকিয়ে থাকেন জীবনের শেষ দৃশ্যের জন্যে। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ