New Update
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/07/feature-1-2.jpg)
সময়টা ১৯৫৩। খ্যাতির মধ্যগগণে তখনও যাননি উত্তমকুমার। জনপ্রিয়তার গনগনে আঁচ তখনও গায়ে লাগেনি অরুণ চট্টাপাধ্যায়ের। নির্মল দে-র ছবি, পরিচ্ছন্ন পরিচালনা, আঁটসাট চিত্রনাট্যে অভিনয় করেছিলেন মহানায়ক। সেই ছবি দেখে সত্যজিত্ রায় বলেছিলেন, "ক্যামেরাকে তো পাত্তাই দেয় না দেখছি, অভিনয়ে থিয়েটারের গন্ধও নেই। বেশ স্বাচ্ছন্দ্য এবং সাবলীল”। সুঠাম চেহারার উত্তমকুমারের যে ভবিষ্যত্ আছে সেদিনই আঁচ পেয়েছিলেন জহুরী সত্যজিত্। ২৪ জুলাই মহানায়কের মৃত্যু দিনে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার এই বিশেষ নিবেদনে চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, উত্তম কুমার যে তারকা হয়ে উঠেছিলেন তার পিছনে কয়েকটি কারণ আছে। আপাত চোখে তিনি এক কথায় যে খুব অসাধারণ সুন্দর ছিলেন, এমনটা বলা যায় না। কারণ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরি, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিত্ চট্টোপাধ্যায় এঁরা প্রত্যেকেই উত্তমের তুলনায় অনেক বেশি সুন্দর ছিলেন। ওঁর আগে যাঁরা অভিনয় করতেন যেমন, দূর্গা দাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রমোথেশ বড়ুয়া এক কথায় আরও বেশি সুন্দর ছিলেন। তাহলে উত্তম কুমার এত জনপ্রিয় হলেন কেন? কারণ তিনি একটা সময় ধরতে পেরেছিলেন। বসু পরিবারে পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন উত্তম কুমার। সেখান থেকেই একটু একটু করে জনপ্রিয়তার শিখরে উঠতে শুরু করেছিলেন তিনি। যে সময়টা উনি ধরতে পেরেছিলেন, সেটি হল স্বাধীনতা দেশ ভাগের পরের সময়। আর্থিক সমস্যা যখন ঘরে ঘরে। সে সময় সাধারণ মানুষের সাফল্যের ঘটনাই থাকত তার প্রতিটি ছবিতে। দূর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রমোথেশ বড়ুয়ারা ছিলেন দূরের নক্ষত্র। কিন্তু উত্তম কুমারকে দেখে মনে হত, ঠিক যেন পাশের বাড়ির ছেলে। আর তখনকার প্রজন্মে সকলেই মনে করত, আমিও তো উত্তম কুমার হতে পারি। উত্তম কুমার হচ্ছেন গড়পড়তা অবদমিত বাঙালির প্রতিনিধি। তিনি নিজের চারপাশে একটা রশ্মি তৈরি করতে পেরেছিলেন। তখনকার দিনে পেজ থ্রি ছিল না। মিডিয়া সাপোর্ট ছিল না আজকের দিনের মতো। তা সত্ত্বেও উত্তম কুমার কী খাচ্ছেন, কার সঙ্গে প্রেম করছেন বা করছেন না তা নিয়ে চর্চা ছিল আপামোর বাঙালির মধ্যে। এর প্রমাণ রয়েছে ১৯৬৫ সালে তপন সিংহের ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে। একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে, দুপুর বেলা বিশ্রামের সময় দুজন গৃহীনি আলোচনা করছেন তাঁকে নিয়ে। উত্তম কুমার সাদামাটা মানুষ, তার মানে তারকার গন্ডি টপকে সাধারণ মানুষের ঘরে ঢুকেছিলেন তিনি। উত্তম কীভাবে চুল কাটেন (ইউ কাট), কীভাবে কালো চশমা পরেন, তা নিয়ে লোকে ভাবত। উত্তম কুমারই বাংলা সিনেমার প্রথম নায়ক যিনি সিনেমার ভয়েসটা বুঝতে পারতেন। অর্থাত্ এখানে যে মেলো ভয়েসের প্রয়োজন আছে, আর সেটাই যথাযথ সেটি উত্তম কুমারই প্রবর্তন করেন। থিয়েটার বা নাটকের মতো যে উচ্চস্বরে কথা বলার প্রয়োজন নেই তা বুঝিয়েছিলেন তিনি। দৈহিক সান্নিধ্য ছাড়াই প্রেম বুঝিয়েছিলেন তিনি। হারানো সুর ছবিতে বিখ্যাত গান 'একবার শুধু কানে কানে বল তুমি যে আমার', এখানে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে ঘনিষ্ট হতেই পারতেন। কিন্তু উনি সেই দৃশ্যে একেবারে মৃত মানুষের মতো শুয়ে ছিলেন। উত্তম কুমার সপ্তপদী ছবির আগে সুচিত্রা সেনকে স্পর্শ করেননি। কারণ তিনি মনে করতেন দৈহিক সম্পর্ক দেখালে লোকে পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখতে আসবে না। আসলে তাঁর কাছে, প্রেমিক তখন বয়ফ্রেন্ড ছিল না অভিভাবক ছিল। যখন তিনি আর হিরো আর থাকতে পারলেন না, বয়স হয়ে গিয়েছিল তখন তাঁকে ঘিরে গল্প তৈরি হল, ছবি তৈরি হল। যেমন, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’। সত্যজিত্ রায় ‘নায়ক’ ছবিতে উত্তম কুমারকে নিয়েছিলেন, কারণ তিনি বুঝে ছিলেন ভবিষ্যতের নায়ক হয়েই থাকবেন তিনি। চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের বলা একটা গল্প দিতেই মহানায়কের মৃত্যুদিনের এই আলোচনা শেষ হচ্ছে। হারানো সুরের শুটিং চলছে, তখন টালিগঞ্জ কী ছিল তা এখন চিন্তার অতীত। বাস একটাই চলে, ৬ নম্বর। বিরাট বিরাট গাছে ঢাকা অঞ্চল। কেউ কোথাও নেই। রাতে সে জায়গা খুব ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত। অজয় করের পরিচালনায় শুধু এক বার বলো গো তুমি আমার গানের শুটিং হবে। প্রয়োজন দুটি মালার। কিন্তু অজয় কর হঠাত্ জানতে পারেন, দুটো মালা লাগবে, কিন্তু একটা রয়েছে। এদিকে মেজাজি মিসেস সেন যদি জানতে পারেন যে তাঁকে মালা না দিয়ে উত্তমকে দেওয়া হয়েছে, তাহলে রাগারাগি করবেন। এদিকে, উত্তম কুমার কে মালা না দিলে তিনি যদি আবার কিছু মনে করেন! অতঃপর একজনকে পাঠালেন মালা জোগাড় করতে। তখন টালিগঞ্জে বাজার ছিল না। কাছের বাজার বলতে সেই লেক মার্কেট। যাই হোক, অবশেষে মালা এল। শুটিংও শেষ হল। পরবর্তী কালে অজয় কর দুঃখ করে বলেন, আমি আজও উত্তম কুমারকে জানাতে পারিনি যে সেদিনের মালাটি ক্যাওড়া তলা শ্মশান থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। শুটিং যাতে ভেস্তে না যায় তাই সেদিন চুপ ছিলেন অজয় কর।