সময়টা নব্বইয়ের দশক। ল্যান্ডলাইনের যুগ। মোবাইল বা ইন্টারনেট তখন দুরহস্ত। মহালয়ার ভোরে পাঁচটা বাজলেই টিভিতে শুরু হত দেবী দুর্গার সঙ্গে অসুরের লড়াই। জানান দিত পুজো আসছে। 'আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে...' এতদিন যারা শুনে এসেছিলেন রেডিওতে এবার তা সরাসরি উঠে এসেছে টিভির পর্দায়। সময়টা ১৯৯৪। দূরদর্শনের পর্দায় প্রথম সম্প্রচারিত হল মহিষাসুর মর্দিনী। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ দর্শক প্রথম প্রত্যক্ষ করলেন দেবী দুর্গাকে। সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন বাঙালির আইকনিক দুর্গা। সেইসঙ্গে অমল চৌধুরী হয়ে উঠলেন অসুর। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। পেশিবহুল বিরাট আকার চেহারা। মোটা গোঁফ। মহালয়ার ভোরে যার বিরাট হাসিতে থরহরি কম্প শুরু হয়ে যেত ছোটদের। দূরদর্শনের মহালয়া মানেই ডাক পড়ত হাবড়া অশোকনগরের অমল বাবুর। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ ইদানীংকালে একাধিক স্যাটেলাইট চ্যানেলের ভিড়ে নব্বইয়ের দশকের মহালয়া এখনও ট্রেন্ডিং। এখন কেমন আছেন মহিষাসুর অমল? যদিও মহিষাসুর অমলকে এখন চেনা যায়না। টিভি, রেডিওকে বহু পিছনে ফেলে রেখে আধুনিকতার জোয়ারে গা ভাসিয়েছে সকলে। অভিনয় দক্ষতার জন্য এখনও এলাকার সকলেই তাঁকে চেনেন 'অমল অসুর' বলে। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ দীর্ঘ বছর ধরে কখনও অসুরের ভূমিকায়, কখনও বা যমরাজের অট্টহাসিতে দর্শকের মন জয় করে নিয়েছেন এই অভিনেতা। এখন অবশ্য সেই সময় বদলেছে। আজ পুরনো দিন সব অতীত। পুজো আসলেই সোনালী দিনগুলির কথা ভেবে, যেন মন খারাপ হয়ে যায় অমল বাবুর। লম্বা চুল, মোটা গোঁফ ছিল অমল অসুরের প্রধান ইউএসপি। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ অমল বাবুর কথায়, 'তখন সবে মোটর বাইক চালানো শিখেছেন। মোটর বাইক নিয়ে বাড়ির সামনে আড্ডা দেওয়ার সময়, এলাকারই দু’জন টেকনিশিয়ানের নজরে এসে রুপোলী পর্দার যাত্রা শুরু। অভিনয়ের আগে বাড়ি বাড়ি আঁকা শেকাতেন। তখন রাস্তায় বেরোলে অনেকে ভয় পেতেন। কতজন যে অভিযোগ করেছেন তাঁর হিসেব নেই। বেশীরভাগ মানুষই চেহারা দেখে চোর ডাকাত ভাবতেন' অভিনয় শুরুর পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ খুব সুন্দর দিন কাটছিল অমল চৌধুরীর। তার সেই চেহারা ও রূপ দেখলে রীতিমতো ভয়ে কাঁপত ছোট শিশুরা। কোন বাচ্চা সে সময় পড়তে না বসলে মহিষাসুর আসছে বলে ভয় দেখাত। মহালয়ার অনুষ্ঠান ছাড়াও বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও অনেক কাজও করেছেন তিনি। প্রথম সারির অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করলেও, আজ সকলের চোখের আড়ালে অমল চৌধুরী। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ 'বর্তমানে যেসব মহালয়া টিভিতে দেখানো হয় তার কোনটাই দেখতে ইচ্ছে হয় না। এখন কোন অভিনেতা অভিনেত্রীরাই মহালয়ার অভিনয় করতে পারে না। আর তাছাড়া অর্থাভাবের কারণে ঘরে টিভিও নেই। মহালয়া আর দেখাও হয় না। এখন মহালয়ার দিন রেডিও একমাত্র ভরসা' বাড়ির সামনের সিমেন্টের স্ল্যাভে বসে বলেন, অমল বাবু। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ গত বেশ কয়েক বছর ধরে আর ডাক আসে না স্টুডিও পাড়া থেকে। এখন দিন কাটছে চরম অভাবে। ভাই এবং বোন দুজনের সংসার। দাদা গত হয়েছেন। মা বাবা ভাই বোন সকলেই একে একে মারা গিয়েছে। ঘরে এখন সঙ্গী বলতে অসুস্থ বোন। অবিবাহিত অমল বাবুর টানাটানির সংসার। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অভিনয়ের বদলে এখন হাতে তুলে নিয়েছেন রং-তুলি। গাড়ির নম্বর প্লেট লেখার কাজ করেন। এর পাশাপাশি হাতেগোনা কয়েকটি আঁকার টিউশনি করেই যা আসে। তা দিয়েই কোনরকমে চলে দু'জনের সংসার। অতীতের সেই সময়ের ছবি দেখলেই ভারাক্রান্ত হয়ে যায় অমল বাবুর মন। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ আত্মীয়রাও আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তাদের থেকে। দারিদ্রতার সাথে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করে আজ চলছে দিন গুজরান। এখনও পর্যন্ত মেলেনি কোনও সরকারি সুযোগ সুবিধা। বয়সের ভারে এখন অনেকটাই হারিয়েছে সেই রূপ। বার্ধক্য থাবা বসিয়েছে জীবনে। তবুও, বড় বড় সেই চোখ ও পাকানো গোঁফ দেখলে চিনতে খুব একটা অসুবিধা হয় না কারোরই। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ একসময় টলিউডের প্রথম সারির অভিনেতা-অভিনেত্রী বা পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করলেও আজ লোকচক্ষুর আড়ালে অভিনেতা। এক সময় অশোকনগরে নাট্য চর্চায় অমল বাবুর অভিনয় সারা ফেলে দিয়েছিল। টিভির পর্দায় দাদাকে দেখে রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠতেন বোন। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ সকলেই জিজ্ঞেস করতেন দাদার অভিনয়ের ব্যাপারে। আজ আর অভিনয়ের জন্য ডাক আসে না এই অভিনেতার। সেই আক্ষেপের কথাই শোনা গেল শিল্পীর গলায়। যাঁর চেহারা একসময় মেকআপের জাদুতে সেজে উঠত, তিনি আজ সব হারিয়ে আজ বসে থাকেন বাড়ির সামনে চাতালে। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ