
কলকাতায় এমন অনেক জায়গা আছে যার পরতে পরতে ইতিহাস লুকিয়ে। সে সব জায়গার ইতিহাস শুনলেই গা শিউরে ওঠে। ঠিক তেমনি কলকাতা শহরের বর্তমান পরিস্থিতি মিলে যায় অতীতের এক ঘটনার সঙ্গে। এই যেমন এখন করোনা সংক্রমণের জেরে জেরবার সকলে। এই ছোঁয়াচে রোগের থেকে বাঁচতে একমাত্র উপায় কোয়ারেন্টাইনে করে রাখা। জানিয়ে রাখা ভাল, কোয়ারেন্টাইন শব্দটার সঙ্গে কলকাতা ২৩০ বছর আগে থেকেই পরিচিত। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

এখনও রয়েছে কলকাতাতে সেই আশ্চর্য জায়গা। এই জায়গার নামেই রয়েছে গা ছমছমে ব্যপার। নাম ‘গুমঘর লেন’। মধ্য কলকাতার চাঁদনি চকের এক প্রান্তে রয়েছে এই গলি। এই গলির একদিক উঠছে গণেশ চন্দ্র এভিনিউ অন্যদিকে টেম্পল স্ট্রিট। ছোট্ট অপরিসর রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একাধিক পুরনো বাড়ি। সেগুলির বেশির ভাগই ভগ্নদশা। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

গলির ভিতরে আছে দু-একটা দোকান। তাও এখন আংশিক লকডাউনের জন্যে বন্ধ। এই গুমঘর লেনের শুরুটা হয়েছিল অষ্টাদশ শতকের শুরুতে। কলকাতা তখন সাক্ষাৎ যমপুরী। লোক আসত, লোক মরত। এখনও মরে, তখনও মরত। সাহেব-নেটিভ নির্বিশেষে। এই নেটিভদের জন্যেই তৈরি করা গুমঘর লেন। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

এখন যেমন করোনা আক্রান্তরা কোয়ারেন্টাইন থাকেন, সেই সময়েও গুমঘর গলি নেটিভদের একঘরে রাখার একমাত্র ঠিকানা। ১৭৯২ সালে প্রস্তাব ওঠে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় কর্মীদের জন্য একটি হাসপাতাল তৈরি করা হবে। সেই হাসপাতাল তৈরি হয় কলুটোলা বা আজকের চিৎপুরে। নাম ছিল ‘নেটিভ হসপিটাল’। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

অষ্টাদশ শতকের কলকাতায়, বিশেষ করে ব্ল্যাক টাউনেও চিকিৎসা বলতে তেমন কিছু ছিল না। যা ছিল তা কবরেজি, হাকিমি, ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবচ। এইসব দিয়ে তো আর মানুষ বাঁচানো যায় না। সমালোচনায় সম্মুখীন হতে হচ্ছে সাদা চামড়ার মালিকদের। আর তা ছাড়া নেটিভ যদি মরে তবে খিদমত খাটবে কে? তাই প্রস্তাব উঠলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় কর্মীদের জন্য হাসপাতাল তৈরি হোক, আলাদা ভাবে। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

এক টেবিলে যেমন সাদা আর কালো চামড়ার মানুষ বসবে না, তেমনই একই হাসপাতালের বিছানাতেই বা শুয়ে থাকবে কেমন করে? সেই প্রস্তাব অনুযায়ী তৈরি হল হাসপাতাল। যদিও হাসপাতাল বেশিদিন এক ঠিকানায় থাকেনি। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

খোলামেলা বাড়িতে হাসপাতালটিকে স্থানান্তরিত করার উদ্দেশ্যে ঠিকানা বদল হয়। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে এটি উঠে আসে ধর্মতলায়। যে বাড়িতে নেটিভ হাসপাতাল ছিল, তার উত্তর দিকে ছিল গুমঘর লেন। হাসপাতাল লাগোয়া ওই রাস্তায় একটি বাড়িতে ছোঁয়াচে ও সংক্রামক রোগে আক্রান্তদের রাখা হত। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

সেই নির্দিষ্ট বাড়ি থেকেই রাস্তার নাম হয়ে গেল গুমঘর গলি বা লেন। সংক্রামক রোগীদের মূল হাসপাতাল থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হত গুমঘর লেনে। গুম হয়ে যাওয়া মানুষের অসুখ না সারলে গুম করে দেওয়া হত জীবন থেকেও – সেই জন্যই লোকের মুখে মুখে গলির নাম হয়ে গেল গুমঘর! এই নামের ব্যাপারটা যদিও স্পষ্ট নয়। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

একটানা ৭৮ বছর ধরে গুমঘর লেন-এ চলেছে ছোঁয়াচে অসুখের চিকিৎসা। তারপর? ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এর ১৯১৯ সালের মে মাসের সংখ্যায় জানা যায় ধর্মতলার পর নেটিভ হাসপাতালের নামটাও বদলিয়েছে, হয়েছে মেয়ো নেটিভ হসপিটাল। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ

এই মেয়ো নেটিভ হাসপাতাল চলছিল বেশ। ছোঁয়াচে রোগের জন্যে তৈরি এই জায়গার সে সময় প্রশংসাও পেয়েছিল সবার কাছ থেকে। কিন্তু কখন হঠাৎ যে বন্ধ হয়ে গেল এই হাসপাতাল আর তার কোয়ারেন্টাইনের জায়গা তা কেউ বলতে পারে না। এখন কয়েকটা ভাঙাচোরা বাড়ির কঙ্কালসার দেহ নিয়ে পরে রয়েছে গুমঘর লেন। এক্সপ্রেস ফটো-শশী ঘোষ