বঙ্গ রাজনীতিতে নক্ষত্রপতন। প্রয়াত রাজ্যের বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। পশ্চিবঙ্গের রাজনীতিতে বর্ণময় চরিত্রদের মধ্যে অন্যতম সুব্রতবাবু। ১৯৪৬ সালের ১৪ জুন বর্ধমানের নওপাড়ায় জন্ম সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। পরে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজের সারেঙ্গাবাদে চলে আসা। কলেজে পড়তে পড়তেই ছাত্র রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। তখনই মফস্সলের থেকে কলকাতায় চলে আসেন সুব্রতবাবু।
বজবজ থেকে এসে বঙ্গবাসী কলেজে অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে ভর্তি হন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। কংগ্রেসের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ছাত্র রাজনীতির সূত্রেই তৎকালীন ছাত্র রাজনীতির আরেক নক্ষত্র প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির সঙ্গে আলাপ। এরপর প্রিয়-সুব্রত জুটিই হয়ে উঠেছিল অপ্রতিরোধ্য। এরই মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিওলজিতে এমএ পাস করা।
সত্তরের উত্তাল দিনগুলিতেই ছাত্র পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব সামলানোর ভার পড়েছিল তাঁর কাঁধে। ক্রমেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর খুব কাছাকাছি চলে আসেন তিনি।
১৯৭১ সালে প্রথমবার বিধায়ক নির্বাচিত হন সুব্রতবাবু। ২৫ বছর বয়সে বালিগঞ্জ থেকে সেবার জয়ে পেয়েছিলেন তিনি। ভোটে দাঁড়িয়েই জয়। এরপর আবার রাজ্যে বিধানসভা ভোট। ১৯৭২ সালে আবারও সেই বালিগঞ্জ থেকে জিতলেন। এবার সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মন্ত্রিসভার সদস্য হন সুব্রত। দায়িত্ব পান তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের প্রতিমন্ত্রীর। মাত্র ২৫ বছর বয়সে রাজ্যের মন্ত্রী। বাংলার রাজনীতিতে এখনও তাঁর এই রেকর্ড কেউ স্পর্শ করতে পারেননি।
১৯৭৭ সালের ভোটে কংগ্রেসের পরাজয় ঘটে। বালিগঞ্জ থেকে লড়াই করে হেরে যান সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বাংলার ক্ষমতায় আসে বামেরা। এর পাঁচ বছর পর ১৯৮২ সালের বিধানসভা ভোটে আসন বদল করেন তিনি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন উত্তর কলকাতার জোড়াবাগান থেকে। জয়লাভ করেন। ওই কেন্দ্র থেকেই পরপর তিনবার জেতেন তিনি। এরপর কেন্দ্র বদল। ১৯৯৬ সালে চৌরঙ্গি থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে জয়লাভ করেন।
এরপর ২০০০ সালে কংগ্রেস থেকে সুব্রত মুখোপাধ্যায় যোগ দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূলে। ৮৭ নম্বর ওয়ার্ড থেকে তৃণমূলের প্রতীকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তবে বিধানসভায় সেই সময়ও হাত প্রতীকের হয়ে বিধায়ক ছিলেন তিনি। ২০০ সালে কলকাতার মেয়র হন সুব্রতবাবু। তাঁর নেতৃত্বে কলকাতা পুরসভার ‘সোনালি সময়’ হিসাবে বিবেচিত হয়। সংস্কারমূলক নানা পদক্ষেপ করেছিলেন তিনি। ২০০১ সালে ফের চৌরঙ্গি থেকে বিধায়ক হন তিনি। কবে এবার তৃণমূলের প্রতীকে।
২০০৪ সালে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদলে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা থেকে সুব্রত মুখোপাধ্যায় তৃণমূলের হয়েপ্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সুব্র মুখোপাধ্যায়। তবে, নির্দল প্রার্থী সুদীপ ও তৃণমূলের সুব্রতর ভোট কাটাকাটিতে কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্রের বাম প্রার্থী সুধাংশু শীল জয়লাভ করেন।
২০০৫ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে চরম মতবিরোধ ঘটে সুব্রত। তৃণমূল ছেড়ে পৃথক মঞ্চ গড়েন তিনি। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে ঘড়ি চিহ্ন নিয়ে পুরভোটে লড়েন তিনি। নিজে জিতলেও তাঁর গড়া মঞ্চের প্রার্থীরা হেরে যান। বামেরা ফের কলকাতা পুরসভার দখল নেয় এবং সুব্রতবাবুও আবারও কংগ্রেসে যোগ দেন।
২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের হয়ে চৌরঙ্গি লড়াই করেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। তবে, হেরে যান তিনি। এরপরই সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকাণ্ডে উত্তাল হয় রাজ্য রাজনীতি। ২০০৮ সালে কংগ্রেসে থেকেও সিঙ্গুরে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধর্নামঞ্চে যোগ দেন সুব্রতবাবু। চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা। এরপর ২০০৯ সালে কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের হয়ে ‘হাত’ প্রতীকে বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হন তিনি। কিন্তু পরাজিত হন। ২০১০ সালের পুরভোটের সময় কংগ্রেস ছেড়ে ফের সুব্রত যোগ দেন তৃণমূলে।
২০১১ সালে জোড়া-ফুল চিহ্নে ফের বালিগঞ্জের বিধায়ক নির্বাচিত হন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান মমতার প্রথম মন্ত্রিসভায়। সামলেছেন পঞ্চায়েতের মতো দফতর। ২০১৬ ও ২০২১ সালে ওই বালিগঞ্জ থেকেই জয় পান তিনি। আমৃত্যু ছিলেন রাজ্য মন্ত্রিসভায়। মাঝে ২০১৪ ও ১৯-য়ের লোকসভায় বাঁকুড়া থেকে ভোটে লড়লেও দিল্লি যাওয়া তাঁর অধরাই থাকলো।