পশ্চিমবঙ্গে প্রথম যে বড় কারখানাটি তৈরি হয় তা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে, সেই গৌরীপুর জুটমিল ছিল নৈহাটিতেই। হতে পারতো এখন এই নৈহাটিতেই সারা দেশের বড় এক শিল্পতালুক। যদিও এই দাবি বর্তমান কোনও মানুষেরই নয়, সব পুরনো আমলের লোকদেরই। নৈহাটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বর্ধিষ্ণু জনপদ হয়ে উঠতে পারার এক বিশাল সম্ভাবনাময় শহরের শিল্পের সেই সুদিন আর এখন নেই। এক সময় ব্রিটিশ শিল্পপতি ম্যাকলিন বেরির হাত ধরে প্রথম নৈহাটিতেই তৈরি হয়েছিল দেশের সব থেকে বড় জুটমিল কারখানাটি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে তখন সদ্য সিপাহী বিদ্রোহের ধাক্কা সামলেছে। গোটা দেশ জুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের তখন একচ্ছত্র আধিপত্য। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
নৈহাটির 'গৌরীভা' কিংবা বলা যেতে পারে 'গরিফা' গ্রামের গঙ্গার ঘাটেই এসে থেমেছিল বেরি সাহেবের বজরা। তুখড় এই শিল্পপতির মনে হয়েছিল, এখানেই কারখানা তৈরির আদর্শ জায়গা। বেরি সাহেব যোগাযোগ করেন ভারতের তদানীন্তন বড়লাট লর্ড ক্যানিংয়ের সঙ্গে। নৈহাটি যে শিল্পে সোনা ফলানোর ক্ষমতা রাখে, তা বুঝতে দেরি করেননি বড়লাটও। সরকারি ছাড়পত্রও মেলে তৎক্ষণাৎ। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
নৈহাটির রাম ঘাটের কাছেই তৈরি হয় বড় একটি জেটি ঘাট। বড় বড় বজরায় আসতে শুরু করে লোহার থাম, যন্ত্রপাতি, ইট, কাঠ। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা গঙ্গার ধারে ৬০০ একর জমিতে ইমারত গড়ার তোরজোড় দেখতে সেখানে দিনভর ভিড় করতো আশপাশের গ্রামের অনেক মানুষ। ব্রিটিশ স্থপতিদের সঙ্গে হাত লাগান প্রখ্যাত বাঙালি স্থপতি, গরিফার রায়সাহেব বলরাম সেন। বিশাল এক কর্মযজ্ঞের পরে ১৮৬২ সালে মাথা তুলে দাড়ায় ম্যাকলিন সাহেবের বিশাল বড় কারখানা। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
শুরু হল পাটের আঁশ থেকে সোনালি সুতো বের করার কাজ। গৌরীপুর জুটমিলের তৈরি হওয়া বস্তা জাহাজে চেপে পাড়ি দিল বিদেশে। যদিও তখনও নৈহাটির আদি বাসিন্দাদের কাছে এই বিষয়টি ছিল বিস্ময়ের। এলাকার আদি বাসিন্দারা কিছুতেই নিজেরা কারখানার শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। মানসিক ভাবে নৈহাটিবাসী চটশিল্পে শ্রমিক হওয়ার কথা ভাবতে পারেননি। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
কাজেই ডাক পড়ল ভিন প্রদেশের মানুষজনের। তারই সূত্রে সংস্কৃতিসম্পন্ন নৈহাটির আদি রূপ পরিবর্তিত হয়ে শুরু হল 'কসমোপলিটান' শহরের পথচলা। চটকলের ব্যবসায় তখন দেদার মুনাফা। এই প্রতিষ্ঠিত চটকলকে ঘিরে একে একে গড়ে উঠল আরও তিনটি কারখানা। যার একটিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লিন্সেড অয়েল বা রেড়ির তেল তৈরি হত। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
যাকে মানুষ চেনে 'গৌরীপুর অয়েল মিল' অথবা 'তেল কারখানা' নামে। তৎকালীন সময়ে গোটা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের পথে ঘাটে সাঁঝবাতি জ্বলত এই তেলে। রাজভবন থেকে সরকারি দফতর, সেরেস্তা, এমনকি গৃহস্থের বাড়িতেও অন্ধকার নামলে এই তেল কারখানার রেড়ির তেলই ছিল ভরসা। সে সময় কারখানাগুল যে এক বিশাল এক লাভের মুখ দেখেছিল তা ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলেই বোঝা যায়। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
গোটা নৈহাটি তখন কারখানার শহর। সকালের সাইরেন বাজলেই কর্মীরা হাজির হতেন কারখানায়। ভিনপ্রদেশ থেকে আসা মানুষদের জন্যে কোয়ার্টার তৈরি হল এই ব্রিটিশ সময়কালেই। বাইরের রাজ্যে থেকে আসা চটকল শ্রমিকদের তখন রমরমা অবস্থা। সবরকম সুযোগসুবিধার সঙ্গে মিলত সঙ্গে মাথা গোঁজার জন্যে সুন্দর ঘরও। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
যদিও সব কিছুরই একটা শেষ আছে। সত্তরের দশক থেকে জৌলুশ হারালো কারখানাগুলো। একের পর এক হাত বদল। কারখানা অধিগ্রহণ। লকআউট শব্দের সঙ্গে শ্রমিকদের প্রথম পরিচয় হল এই সময়টাতেই। সমাপ্তির শুরু হল ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের। বাইরের থেকে আসা লোকেরা তখন থেকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে। নব্বইয়ের দশক থেকে বন্ধ হতে শুরু করলো একের পর এক কারখানা। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
হানাবাড়ির চেহারা নিল কারখানা থেকে শুরু করে শ্রমিক আবাসন। নৈহাটি ষ্টেশন থেকে একটু এগিয়ে গেলে বাম দিকে এক সরু গলি। এই গলির ভিতর দিয়ে সোজা এগোলেই দেখা যাবে কঙ্কালসার দেহে মাথায় বট গাছের ঝুরি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শ্রমিক কোয়ার্টারগুলো। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
গোটা শহর জুড়ে জুটমিল শ্রমিক আবাসনগুলোতে শেষ কবে সংস্কার করা হয়েছিল তা কারো মনে নেই। নদীয়া জুটমিলের শ্রমিক ছিলেন স্বপন পাল। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে কারখানায় কাজ করছেন। তার কথায়, নদীয়া জুটমিল খোলা কিংবা বন্ধের কোনও সময় নেই, এই খোলা আবার এই বন্ধ এভাবেই চলছে। নদীয়া চটকল শ্রমিক আবাসনের সামনে ছোট একটি চায়ের দোকানই তার উপার্জনের ভরসা। জুটমিল খোলা হলে বুঝতে পারেন সাইরেনের শব্দে। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
দিনপ্রতি ২০০টাকা রোজগার। কাজ নেই এখান ছেলেবুড়ো সকলে তাস খেলেই সময় কাটিয়ে দেয়। আর কেউ রিক্সা চালায় অথবা দিনমজুরী করে। নদীয়া জুটমিল কোয়ার্টারে এখন সব মিলিয়ে ১০০টি পরিবারের বাস। প্রতিদিনই আবাসনের কিছু না কিছু অংশ ভেঙ্গে পড়ছে। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
গত বছর এখানেই বাড়ি ভেঙ্গে পরে আহত হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন। নৈহাটির চটকল আর শ্রমিক বস্তি এই অঞ্চলের এক প্রাণবন্ত ইতিহাস নিয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে। এখানে এখন শুধুই যন্ত্রণার ধুলো ওড়ে। কান্নায় ভারী হয় চারপাশ বস্তির ছোট্ট খুপরিতে খুপরিতে গাদাগাদি করে থাকেন পাঁচ থেকে দশজন মানুষ। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে শ্রমিক পরিবারগুলির। করোনা মহামারীতে লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন অনেক মানুষ। কিন্তু এই চটকল শ্রমিকদের কাজ নেই বছরের পর বছর। কারখানার মালিক কিংবা স্থানীয় প্রশাসন তাঁদের ব্যাপারে উদাসীন। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
ব্রিটিশ আমলে তৈরি চটকল শ্রমিকদের বাসস্থান এখন ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে গিয়েছে। জগদ্দল জেজেআই জুট মিলের স্পিনিং বিভাগের শ্রমিক মুকেশ্বর মণ্ডল। ঐ জুটমিলের শ্রমিক লাইনে থাকেন। টালির ঘর। ঘরে জল পড়ে। মেরামত করে না মিল কর্তৃপক্ষ। মুকেশ্বর বলেন, 'কীভাবে বেঁচে আছি বলে বোঝাতে পারব না'। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
ঘরের মধ্যে নোংরা জল। এভাবে পরিবার নিয়ে দিন কাটছে। ভয় লাগে যদি ঘর ভেঙে পড়ে! তাহলে চাপা পড়ে সবাই মরে যাব। ওই মিলের চায়না লুমে কাজ করে প্রিয়াঙ্কা কুমারী। ঘরের অবস্থা খুব খারাপ। একই অবস্থা কাঁকিনাড়া জুট মিল ও রিল্যায়েন্স জুট মিলের শ্রমিক আবাসনের। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
নৈহাটি নদিয়া জুট মিল আড়াই বছর ধরে বন্ধ। শ্রমিকরা টাকা পাননি। পাওয়ার আশায় এখনও বেশ কিছু পরিবার শ্রমিক আবাসনে থাকেন। জল নেই। আলো নেই। গত বছরের আগস্ট মাসের একদিন রাতে খাওয়া শেষে রামপ্রীত কুশওয়া পরিবারের লোকজন নিয়ে বসে গল্প করছিল। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
বৃষ্টিতে আচমকা ঘর ভেঙে পড়ে। ঘরের তলায় চাপা পড়ে রামপ্রিত কুসওয়া ও তাঁর নাতি, নাতনি ও জামাই। এলাকার মানুষ তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠান। একসময় এই এলাকায় মোটা টাকার বেতনের কাজের জন্যে ভিন রাজ্যে থেকে এই মানুষগুলো ছুটে এসেছিলেন তাঁদের অবস্থা যে এমন শোচনীয় হয়ে উঠবে কারো জানা ছিল না। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
নৈহাটি রেল স্টেশনের কাছে নদিয়া জুটমিল, হাজিনগরে নৈহাটি জুটমিল, আইপিপি কাগজ কল সব এখন শুধুই ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে। এক সময়ের শিল্পশহরে এখন 'শিল্পের ফসিল' পরে আছে। কোয়ার্টারগুলোর চটকল শ্রমিকরা এই ফসিলেরই বংশধর। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
Get all the Latest Bengali News and West Bengal News at Indian Express Bangla. You can also catch all the Latest News in Bangla by following us on Twitter and Facebook