New Update
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/11/Ghats-Cover.jpg)
আর্মেনিয়ান ঘাট: ইতিহাসের পাতায় ব্রিটিশদের আগেই আরেক বিদেশি জাতির কলকাতায় আসার প্রমাণ পাওয়া যায়, তারা আর্মেনিয়ান। এই সূত্রে আর্মেনিয়ানদের ভারতে আসার ইতিহাসটি স্মরণ করা যেতে পারে। জানা যায়, আলেকজান্ডার যখন আর্মেনিয়া হয়ে ভারতের দিকে আসছিলেন তখন কিছু আর্মেনিয়ান তার সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে ভারতে রওনা দেন। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ
গঙ্গাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে শহর কলকাতা। উত্তর থেকে দক্ষিণে শহরের গা ঘেঁষে চলেছে গঙ্গা। আর গঙ্গার এই চলার পথে তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি গঙ্গার ঘাট। প্রতিটি ঘাটের সঙ্গে জুড়ে আছে শহরের নানা সময়ের ইতিহাস। ব্রিটিশ রাজ থেকে কলকাতার ‘বাবু কালচার’ কিংবা রানি রাসমণির ইতিহাস থেকে হাল আমলের মিলেনিয়াম পার্ক, সবকিছুই ছুঁয়ে আছে গঙ্গাকে। গঙ্গা নদী এবং কলকাতা এক যুগপৎ চরিত্র নিয়ে বিরাজ করছ প্রায় তিনশ বছরের বেশি সময় ধরে। গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে তবুও এখনও ঘাটগুলোর বুকের পাঁজরে লুকিয়ে আছে ইতিহাস। কলকাতায় জব চার্নক। তিনি এসেছিলেন এই নদীপথ ধরেই। তখনকার সময়ে যাতায়াতের একমাত্র সহজ মাধ্যেম ছিল নদীপথ। এই পথকেই কেন্দ্র তৈরি হয় কলকাতায় গঙ্গার ঘাটগুলো। আমাদের কারোরই অজানা নয় নদীমাতৃক সভ্যতার কথা, কলকাতাও বলতে গেলে একটি নদী কেন্দ্রীক নগর সভ্যতা। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ অষ্টাদশ শতকের কলকাতায় একদিকে যেমন শহর গড়ে উঠেছিল, পথ-ঘাট, রাস্তা তৈরি হচ্ছিল তেমনই ভাগীরথীর তীরে ঘাট সমূহ নির্মিত হয়েছিল। এই সকল ঘাট হয় সরকারি ব্যয়ে অথবা কোনো বিত্তশালী ব্যক্তির অর্থানুকূল্যে তৈরি হয়েছিল। সরকারি ব্যয়ে বোধহয় মাত্র দুটি ঘাট নির্মিত হয়েছিল, একটি কেল্লার ঘাট (যা থেকে কয়লাঘাট ষ্ট্রীট নামের উৎপত্তি হয়েছে) আর অন্যটা হচ্ছে বাগবাজারের পুরানো বারুদখানার ঘাট। উচ্চ ও নিম্ন সকল শ্রেনীর মানুষ এই ঘাট ব্যবহার করত। প্রত্যেকে ঘাটের নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ইতিহাস। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ কলকাতার ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও এই ঘাটগুলো ছিল গঙ্গাস্নানের জন্যে। মেয়েরা সেযুগে ছিল কট্টর অসূর্যম্পশ্যা (যে স্ত্রীলোক সূর্যের মুখ পর্যন্ত দেখে না) যে জন্য সাধারণ ঘরের মেয়েরা গঙ্গাস্নান সেরে সূর্যোদয়ের পূর্বে ঘরে ফিরত। আর অভিজাত সম্প্রদায়ের মেয়েরা পালকি করে গঙ্গা স্নানে আসত, পালকি বাহকরা অরোহিনী সমেত পালকিকে জলে ডুবিয়ে দিতেন, আরোহিণী পালকির ভিতরে থেকেই স্নান ও পোষাক পরিবর্তন করতেন। আজকের এই কলকাতা তৈরি হয়েছে গঙ্গা পাড়ের এই ঘাটগুলো থেকে। শহরের ইমারতের জিনিসগুলো নিয়ে আসা নদীপথেই আর এই ঘাটগুলো ছিল নদী আর শহরের সঙ্গে যোগসূত্রের মধ্যেমণি। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ ব্যবসার কারণে তৈরি হওয়া ঘাট গুলিতে শুধু দেশীয় বণিকরা নয়, সাহেব ব্যবসাদারেরাও ব্যবহার করত, পরে তারা অনেকে পয়সা খরচ করে নিজেদের ব্যবসার জন্য ঘাট তৈরি করেছিলেন। যে সকল ছোটো ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত ঘাট ছিল না, তাদের জন্য ছিল অন্যত্র কিছু আলাদা ঘাট। এই সকল ঘাট ঠিকা নিত মাঝিরা, এদের বলা হত ঘাট মাঝি। এরা ব্যবসাদারদের সকল প্রকার সহায়তা করতেন, এরকম অবস্থায় বহু ঘাটমাঝিও প্রচুর অর্থ উপার্জন করে বিত্তশালী হয়ে উঠেছিল। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ বাবুঘাট: জানবাজারের বাবু রাজচন্দ্র মার ১৮৩০ সালে আরও একটি ঘাট তৈরি করেন। নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ইতিহাস। কলকাতার গঙ্গাস্নানের যে ঐতিহ্য আছে, সেই ঐতিহ্যের বড় অংশই এই ঘাটকে ঘিরে। রানী রাসমণির স্বামী বাবু রাজচন্দ্র দাসের নামে এই ঘাট নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই থেকে এই ঘাট বাবুঘাট নামে পরিচিত। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ আর্মেনিয়ান ঘাট: ইতিহাসের পাতায় ব্রিটিশদের আগেই আরেক বিদেশি জাতির কলকাতায় আসার প্রমাণ পাওয়া যায়, তারা আর্মেনিয়ান। এই সূত্রে আর্মেনিয়ানদের ভারতে আসার ইতিহাসটি স্মরণ করা যেতে পারে। জানা যায়, আলেকজান্ডার যখন আর্মেনিয়া হয়ে ভারতের দিকে আসছিলেন তখন কিছু আর্মেনিয়ান তার সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে ভারতে রওনা দেন। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ তার পরবর্তী সময় আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সময় ভারতে এসেছেন। প্রথম বিদেশি আর্মেনিয়ানরাই যারা কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বাণিজ্যিক কাজকর্মর জন্যে তৈরি করেন কলকাতার এই 'আর্মেনিয়ান ঘাট' অন্যতম। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ নিমতলা ঘাট: এখন যেখানে আনন্দময়ী কালীর মন্দির আছে আগে নিমতলা শ্মশান ঘাট সেখানেই ছিল। তখন মন্দির তৈরী হয়নি। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ এই শ্মশান তৈরী হয় ১৮২৮ সালে, ১৭ মার্চ থেকে সেখানে শবদাহ আরম্ভ হয়, বাবু রাজচন্দ্র মার এখানে একটি ঘর করে দেন, মূলত যাদের মৃত্যু হয়নি, তবে মৃত্যু আসন্ন, তাদের সেই সময় গঙ্গার ঘাটে এনে রাখা হত, জোয়ার এলে তাদের খাট সহ জলের মধ্যে রাখা হত, এমনই চলতে থাকত যত দিন না তাদের মৃত্যু হত। গঙ্গাপ্রাপ্তি যাত্রীদের জন্য এই ঘাট নির্মাণ করেন বাবু রাজচন্দ্র মার। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ প্রিন্সেপ ঘাট বা জাজেস ঘাট: এক সময় প্রিন্সেপ ঘাটের চত্বরও ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা, সাপ, জোঁক, শেয়াল, বাদুড়ের রাজত্ব কায়েম ছিল। তবে এখন আর তা নেই। প্রিন্সেপ ঘাট থেকে বাবুঘাট (অবধি এখন রঙ্গিন আলোতে সাজানো সন্ধ্যা। আর রয়েছে রং বে রং এর ফুল ও গাছ। সবথেকে বড় কথা কলকাতায় ভিড়, জ্যাম, উৎসবের মাঝখানেই প্রিন্সেপ ঘাট একদম ব্যতিক্রমী, বিকেল হলেই ভিড় জমে অনেক মানুষের। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ প্রিন্সেপ ঘাটে স্নানের জন্য একটা আলাদা বাঁধানো ঘাট করা হয়েছে। সেই ঘাটের আবার আলাদা নাম আছে, জাজেস ঘাট। গঙ্গাবক্ষে নৌকাবিহারের জন্য এই ঘাটে প্রতিদিন বহু মানুষ হাজির হন। সমস্ত পরিবর্তন হয়েছে গঙ্গাতীরের অতীত ঐতিহ্য কে মাথায় রেখে, যার প্রমাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝুড়িওলা বড় বড় বট ও অশ্বত্থ গাছগুলো। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ জগন্নাথ ঘাট: ১৮৮৭ সালের ২৫ মে, ৭৫০ জন যাত্রী বোঝাই একটি জাহাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদাসীনতায় উলটে গিয়েছিল মাঝ সমুদ্রে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ভারতীয় রমণী। পুরী যাওয়ার পথে এই জাহাজডুবী হয়। সে সময় রেলপথচালু না হওয়াতে যাতায়াত হত জাহাজে এই জগন্নাথ ঘাট থেকেই জাহাজে যাওয়ার সময়ই এই ঘটনা ঘটে। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ 'ইংলিশম্যান' পত্রিকায় ওই বছর ২৪ মে কোম্পানি'র জাহাজ ছাড়ার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, ম্যাকলিন অ্যান্ড কোম্পানি'র জাহাজ 'স্যার জন লরেন্স' বালেশ্বরের চাঁদবালীর দিকে রওনা হবে ২৫ মে। সেখান থেকে ২৭ মে ফিরে আসবে কলকাতায়। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ অন্নপূর্ণা ঘাট: ১৮৫৬ সালের কলকাতার ম্যাপে প্রথম অন্নপূর্ণা ঘাটের নাম পাওয়া যায়, চিৎপুর থেকে বাগবাজারের যাওয়ার রাস্তায় এই ঘাট। বাগবাজারের বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী, হেস্টিংসের আমলে কলকাতার আমিন নিযুক্ত হয়, হেস্টিংস বিলেতে যাওয়ার সময় তাঁকে ৫২ বিঘা জমি দান করেন, আর তিনিই ১৭৭৩ সালে মতান্তরে ১৭৭৬ সালে তিনি ঐ জমিতে অন্নপূর্ণা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, মন্দির থেকে কিছু দূরে ঘাট থাকায় ঘাটটির নাম হয় অন্নপূর্ণা মন্দির। আবার যদিও অনেকে মনে করেন এই ঘাট চাল (অন্ন) আমদানি রপ্তানির কেন্দ্র থাকার জন্য এমন নাম হয়েছে। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ কুমোরটুলি ঘাট: কুমোরটুলি নামেই বোঝা যায় কুমোরদের পাড়া, এটা একটা ছোট পাড়া, যেখানে প্রায় সারা বছর সব প্রতিমা গড়ার কাজ চলে। কলকাতার যে সব অঞ্চলে একটু নিম্নস্তরের জীবিকা অবলম্বন কারীদের অস্থায়ী আস্তানা বা কুঁড়েঘর সারিসারি থাকত সেই অঞ্চলের নাম হত দিয়ে, টোলা হল অস্থায়ী বড় ঘর, আর টুলি হল অস্থায়ী ছোটো ঘর। এই কুমোরটুলি ব্যবসায়িক ভিত্তিতে ১৮ শতকের মাঝামাঝি তৈরী হয়েছিল, আর এই কুমোরটুলির সামনে অবস্থিত ঘাটটি তার নাম পায় কুমোরটুলি ঘাট। গঙ্গাপথে ঠাকুর নিয়ে আসা যাওয়ার জন্যে এই ঘাট ব্যবহার করা হত। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ বাগবাজার ঘাট: এই ঘাট হল উত্তর কলকাতায় হুগলি নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত একটি প্রাচিন ও বিখ্যাত ঘাট।এই ঘাটটি রঘু মিত্র ঘাট নামে পরিচিত ছিল। এই ঘাট ব্রিটিশ শাসনকালে কলকাতার অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রেখেছিল। সে সময় বাগবাজারের এই ঘাটের মাধ্যেমে ব্যবসায়িক পন্য নিয়ে আসা হত। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ বর্তমানে এই ঘাটের পাশে একটি স্টিমার জেটি নির্মিত হয়েছে যাত্রী পরিবহনের জন্য। যদিও বাগবাজারের পুরোনো ঘাটটি গঙ্গা স্নাস ও গঙ্গা জল সংগ্রহ করেন হিন্দু ধর্মের মানুষ। এই ঘাটে বিভিন্ন ধর্মিও অনুষ্ঠান সম্পূর্ন হয়। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ এরকম প্রতিটি ঘাটের সঙ্গে জুড়ে আছে ইতিহাসের বিভিন্ন নজির। যা কোথাও আজও স্পষ্ট, আবার কোথাও সেগুলি চলে গেছে বিস্মৃতির অতলে। কলকাতার গড়ে ওঠার পেছনে গঙ্গা নদীর অবদান সব থেকে বেশি বলে মনে করেন ওয়াকিবহাল মহল। সেই কথা যে সামগ্রিকভাবে ঠিক তা ঘাটগুলির ইতিহাসের দিকে নজর দিলে আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এক্সপ্রেস ফটো- শশী ঘোষ