ভারতের প্রথম অ-কংগ্রেসি পূর্ণ মেয়াদি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অটল বিহারী বাজপেয়ীর অবদান ভারতের গনতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। জাতি সঙ্ঘে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়া থেকে শুরু করে লাহোর বাস সার্ভিস চালু করা, অথবা পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, বাজপেয়ীর বিশেষত্বই ছিল তাঁর স্বভাবসিদ্ধ পাণ্ডিত্য এবং শালীনতার কল্যাণে স্বপক্ষ এবং বিরোধীপক্ষের মন জয় করবার ক্ষমতা।
আরও পড়ুন: অটলবিহারী বাজপেয়ীর কলকাতার ঠিকানা, বেরিয়াল হাউস থেকে
অত্যন্ত সুবক্তা হিসেবে পরিচিত এই নেতার দেওয়া কিছু বক্তৃতা ভারতের সংসদীয় ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। দেশের রাজনীতিতে 'ভীষ্ম পিতামহ' তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়কালে দেশে সুশাসন এবং উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছিলেন এমন একটা সময়ে, যখন জাতীয় রাজনিতিতে জাত, ধর্ম, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রকোপ ছিল প্রবল। সকল রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি তাই সর্বজন স্বীকৃত বর্ষীয়ান নেতা হয়ে উঠেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় জনতা পার্টি একটি কট্টর দক্ষিণপন্থী দলের পরিবর্তে হয়ে উঠেছিল ভারতের রাজনৈতিক মূলস্রোতের অঙ্গ।
রইল অটল বিহারী বাজপেয়ীর রাজনৈতিক জীবনের দশটি নির্ণায়ক ঘটনার বিবরন:
১. বিদেশ নীতি: কোল্ড ওয়ার বা ঠাণ্ডা লড়াই পরবর্তী যুগে বাজপেয়ী ভারত-আমেরিকা সুসম্পর্ক গড়ার পেছনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, যার ফলে ১৯৭৮ সালে জিমি কার্টারের পর ২০০০ সালে বিল ক্লিন্টন হন ভারত সফরে আসা প্রথম আমেরিকান রাষ্ট্রপতি। চিনের সঙ্গেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় আগ্রহী বাজপেয়ী সরকার উচ্চস্তরের আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতিসাধন করে সীমান্ত কলহ মেটাতে পদক্ষেপ নেয়। বাজপেয়ীর 'লুক ইস্ট' নীতির ফলস্বরূপ ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিরও।
২. পাকিস্তানকে শান্তি প্রস্তাব: পাকিস্তানের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা সম্ভবত বাজপেয়ীর বিদেশনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯ সালে তিনি দিল্লি-লাহোর বাস সার্ভিসের উদ্বোধন করে সেই বাসেই পাকিস্তানে যান সেদেশের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বৈঠক করতে। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলে নিদর্শন হয়ে দাঁড়ায়, এবং বাজপেয়ীর বাস্তবধর্মী বিদেশনীতি প্রশংসা পায় সারা বিশ্বে। দুই প্রধানমন্ত্রী এর পরই লাহোর চুক্তি সই করেন, যার ফলে দুই দেশ যৌথভাবে শান্তিস্থাপনের উদ্দেশ্যে পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ রুখতে প্রতিশ্রুত হয়। পাশাপাশি দু দেশের মধ্যে উন্নততর বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করার কথাও হয়। ২০০১ সালেও বাজপেয়ী পারভেজ মুশারফের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন দীর্ঘস্থায়ী কিছু সমস্যার সমাধান করতে, কিন্তু সেই প্রয়াস ব্যর্থ হয়।
৩. ভারতকে পারমাণবিক মানচিত্রে পাকাপাকি স্থান দেওয়া: বাজপেয়ী জমানার উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের মধ্যে একটি ছিল ১৯৯৮ সালের পোখরান-২ পারমাণবিক বোমা পরীক্ষা, যা গোপনে করা হয় রাজস্থানের জয়সলমীরে। সে বছর মে মাসে মাটির নীচে সারা বিশ্বের অলক্ষ্যে পাঁচটি পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যা আজ পর্যন্ত মার্কিন গুপ্ত সংস্থা সিআইএ-র সবচেয়ে বড় ইন্টেলিজেন্স ব্যর্থতার মধ্যে একটি। এই পরীক্ষার পর আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ভারতের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলেও, বাজপেয়ীর সাহসী এবং কৌশলগতভাবে জরুরি সিদ্ধান্তের ফলে ভারত পারমাণবিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
৪. কার্গিল যুদ্ধ: ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রীত্বের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। অপারেশন বিজয় নামাঙ্কিত এই যুদ্ধ শুরু হয় তখন, যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কিছু সৈন্য এবং কাশ্মীরি জঙ্গি লাইন অফ কন্ট্রোল পেরিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে। অবশেষে নওয়াজ শরিফের অনুরোধে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টনের মধ্যস্থতায়, এবং পাকিস্তানের ভারী লোকসান ঘটিয়ে, যুদ্ধ শেষ হয়।
৫. শিক্ষা এবং অর্থ নীতি: অটল বিহারী বাজপেয়ীর হাতেই ভিত্তিস্থাপন হয় সর্ব শিক্ষা অভিযান প্রকল্পের, যার ফলে ছয় থেকে চৌদ্দ বছর বয়সী শিশুদের জন্য শিক্ষা হয়ে যায় মৌলিক অধিকার। অন্যদিকে বাজপেয়ীর হাতেই উদ্বোধন হয় ন্যাশনাল হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের, যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের চারটি প্রধান শহর - দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা এবং চেন্নাই - কে 'সোনালী চতুর্ভুজের' চার কোণায় রেখে আন্তর্জাতিক মানের হাইওয়ে নির্মাণ।
বাজপেয়ী তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অবশ্যই ভারতের অর্থনীতির ক্ষেত্রে রেখে গিয়েছেন। তাঁর নয়া টেলিকম নীতির ফলে জন্ম নেয় ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড (BSNL), এবং টেলিকম কোম্পানিগুলিকে লাইসেন্স দেওয়ার প্রথা হঠিয়ে আয়-ভাগ প্রথা চালু করাতে ভারতে সূচনা হয় টেলিকম বিপ্লবের।
তাঁর শাসনকালে নানারকম প্রাকৃতিক বিপর্যয়, তেলের সঙ্কট, আমেরিকায় ৯/১১ দুর্বিপাক, এবং কার্গিল যুদ্ধের মতন প্রতিকূল ঘটনা সত্ত্বেও ভারতের অর্থনীতির গায়ে বিশেষ আঁচড় লাগে নি।
আরও পড়ুন: অটল বিহারী বাজপেয়ী: শুধু কবিতার জন্যেও
৬. জাতি সঙ্ঘে প্রথম হিন্দি ভাষণ: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০২ সালে জাতি সঙ্ঘের সাধারণ সভায় দেওয়া অটল বিহারী বাজপেয়ীর ভাষণ আজও সমাদৃত হয়ে রয়েছে জাতি সঙ্ঘে প্রদত্ত প্রথম হিন্দি ভাষণ হিসেবে। সেই প্রথমবার কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জাতি সঙ্ঘে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গিদের প্রসঙ্গ তোলেন, এবং ঘোষণা করেন যে জঙ্গি উপদ্রব বন্ধ হলে তিনি কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে রাজি। মজার ব্যাপার হলো, ২০০২ সালে জঙ্গি হানার সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়ায়।
৭. তেরো দিনের সরকার: ১৯৯৬ সালে মাত্র তেরো দিনের মাথায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করবার সময় সংসদে বাজপেয়ী যে ভাষণটি দেন, তা আজও তাঁর দেওয়া বক্তৃতাগুলির মধ্যে অন্যতম। "সরকার আসে যায়, দলের জন্ম বা মৃত্যু হয়। কিন্তু সর্বোপরি, দেশের মুখ যেন উজ্জ্বল থাকে, তার গণতন্ত্র অমর," বলেছিলেন তিনি।
৮. প্রথম সফল জোট সরকারের নেতৃত্ব: ভারতে জোট সরকার নিয়ে চিন্তাভাবনা যে সময়ে একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে, সে সময় বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন একটি বড়সড় জোট সরকার দেশ চালাতে সক্ষম হয়েছিল, রাজনৈতিক আদর্শ এবং মতামত নির্বিশেষে। পাশাপাশি, বাজপেয়ী প্রথম অ-কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী, যিনি পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করেছিলেন।
৯. কান্দাহার প্লেন হাইজ্যাক: ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট আইসি-৮১৪ মোট ১৭৬ জন যাত্রী এবং ১৫ জন বিমানকর্মী সমেত কাঠমান্ডু থেকে দিল্লি আসার পথে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন হরকত-উল-মুজাহিদিনের হাতে আফগানিস্তানের কান্দাহার বিমানবন্দরে হাইজ্যাক হয়। সংগঠনের দাবি ছিল, ভারতের জেলে বন্দী তিন আতঙ্কবাদীর মুক্তি। তৎকালীন বাজপেয়ী সরকার সেই দাবি শুধু মেনেই নেয় নি, বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা স্বয়ং ওই তিন জঙ্গিকে কান্দাহার পৌঁছে দিয়েছিলেন।
১০. গুজরাতের দাঙ্গা এবং নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশে বার্তা: গোধরায় সাবরমতি এক্সপ্রেসের আগুনে ৫৯ জন তীর্থযাত্রীর মৃত্যুর পর প্রায় তিন মাস ধরে গুজরাতে চলে সাম্প্রদায়িক ধ্বংসলীলা। মারা যান এক হাজারের বেশি মানুষ, ঘরছাড়া হন আরও কয়েক হাজার। কেন্দ্রে বাজপেয়ী সরকারের প্রভূত সমালোচনা হয় দাঙ্গার যথাযথ মোকাবিলা না করায়, বিশেষ করে যখন গুজরাতেও সেসময় বিজেপি সরকার, নেতৃত্বে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি এক বিখ্যাত তিরস্কার সূচক মন্তব্যে বাজপেয়ী বলেছিলেন, মোদীর উচিৎ তাঁর "রাজধর্ম পালন করা", এবং রাজ্যের মানুষের মধ্যে জাতিধর্ম ভিত্তিক ভেদাভেদ না করা।