মাস খানেকের ব্যবধান। জ্যোতিরাদিত্যের পর 'বিদ্রোহী' শচিন পাইলট। এদিকে সোনিয়া গান্ধীর সামনেই নেতৃত্ব বদলের ডাক উঠেছে। কংগ্রেস বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছে? দলের ভবিষ্যতই বা কোন পথে? দ্য সানডে এক্সপ্রেস-কে বিশেষ সাক্ষাৎকারে এই সবের জবাব অকপটে দিলেন লোকসভার কংগ্রেস নেতা তথা দলের কার্য সমিতির সদস্য অধীর চৌধুরী।
প্রশ্ন- কংগ্রেসে কী হচ্ছে? সোনিয়া গান্ধীর ডাকে গত বৃহস্পতিবার রাজ্যসভা সাংসদদের বৈঠকে যে বিতর্ক উঠেছে তা আপনি নিশ্চই শুনেছেন?
অধীর চৌধুরী- রাজনীতিতে বাস্তবকে স্বীকার করতেই হবে। আমাদের দলের উদ্যম দরকার, কিন্তু বর্তমানে এর অভাব রয়েছে। আমরা যদি আমাদের কর্মীদের তাতাতে না পারি, তাহলে শুধু ডিজিটাল প্রচার আর সাংবাদিক বৈঠকে কাঙ্খিত ফল মিলবে না। রাজনৈতিক-সামাজিকস্তরে আমরা প্রতিটি ইস্যুকে তুলে ধরছি। আমাদের মতো করে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক দলই সোচ্চার হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের ডিটিটাল প্রচার থেকে বাস্তবে ফিরতে হবে। তৃণমূলস্তরের কর্মীদের তাতানোর লক্ষ্যেই এই কাজ করতে হবে।
এটা ঘটনা যে আমরা তৃণমূলস্তরের কর্মীদের অনুপ্রাণিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। নেপোলিয়ান বলেছিলেন, 'খালি পেটে একজন সৈন্য কখনও মার্চ করতে পারবে না।' রাজনৈতিক কর্মীদেরও আদর্শগত ও রাজনৈতিক খাদ্যের দরকার রয়েছে। আমরা তা কর্মীদের দিতে পারছি না। আমরা সঠিক বিষয়গুলিই উত্থাপন করছি তবে সেগুলো কাজ করছে না।
প্রশ্ন- কেন এমন হচ্ছে?
অধীর চৌধুরী- আমাদের দলের সাংগঠনিক কাঠামোতেই দুর্বলতা রয়েছে। দলের কাঠামোর খোলনলচে পাল্টাতে হবে ও সঠিক কাঠামো বাছতে হবে। দলের তৃণমূলস্তরের কর্মীরা জনগণের কাছে গিয়ে প্রচার করতে পারছে না। ফলে মানুষের আস্থা অর্জন করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত মানুষ কংগ্রেসকে বিশ্বাস করতে পারবেন ততক্ষণ আমাদের নির্বাচনী ফলাফল ভালো হবে না।
প্রশ্ন- সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণ কী?
অধীর চৌধুরী- একথা বলতে পারি যে গত কয়েক বছর ধরেই একটা ক্ষয় চলছে। গত ১০ বছর কংগ্রেস ক্ষমতায় নেই। ফলে আমরা তৃণমূলস্তরের নেতা তৈরি করতে পারিনি। একই সঙ্গে গত কয়েক বছরে আঞ্চলিক দলের উত্থান হয়েছে চোখে পড়ার মতো। অনেক জায়গাতেই কংগ্রেস থেকে নেতারা বেরিয়ে ওইসব দলে যোগ দিয়েছেন। তাই একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটাতে স্থানীয় পর্যায়ে তৃণমূলস্তরে সম্ভাবনাময় নেতার প্রয়োজন।
প্রশ্ন- তাহলে কি কংগ্রেস এখন শুধু সোশাল মিডিয়া এবং সংবাদিক বৈঠকেই সীমাবদ্ধ?
অধীর চৌধুরী- আমরা এখন বেশিরভাগ কাজই সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে করছি। তবে আলোচনার সময় আমি সবসময় বলে থাকি যে আমাদের প্রথমে রাস্তায় নেমেই আন্দোলন করতে হবে। না হলে কাঙ্খিত লক্ষ্যপূরণে কংগ্রেস ব্যর্থ হবে।
প্রশ্ন- দলের মধ্যে নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব কী নিয়ে? দল এ বিষয়ে কী ভাবছে?
অধীর চৌধুরী- এটা রটনা। বিভিন্ন ধারনার মেলবন্ধই কংগ্রেস। আমরা যখন বহুত্ববাদী চিন্তাধারাকে মাণ্যতা দিয়েছি, তবে কেন বিভিন্ন বয়সীদের সমাহারকে মেনে নেব না? নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্ব বোগাস বিষয়ে। একে অপরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বের বদলে, প্রবীণদের অভিজ্ঞতা ও নবীনদের উদ্যমের মেলবন্ধন ঘটাতে হবে।
কতিপয় উচ্চাকাঙ্খী নবীন নেতা মনে করছেন যে কংগ্রেস দ্রুত আর ক্ষমতায় ফিরবে না। আমি তাঁদের বলব, বিজেপির বিরুদ্ধে লম্বা যুদ্ধ চলছে। এক্ষুনি সাফল্য মিলবে এটা মনে করাটাই মুর্খামি হবে। দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে। আমাদের ইচ্ছা মতো ফল হবে এটা মনে করাই বোকামি।
প্রশ্ন- তবে মাঝে মাঝেই কেন বিরোধ লক্ষ্য করা যাচ্ছে?
অধীর চৌধুরী- কিছুটা অতিরঞ্জিত বিষয়। আমাদের দলের একাংশ এই ধরনের কুকাজ করেছে কিন্তু তা সম্পূর্ণ ছবি নয়। অভিজ্ঞতা ও উদ্যমকে হাত ধরেই এগোতে হবে। কোন দলে নবীন-প্রবীণের সমাহার নেই? ভারতীয় সমাজের ধর্ম মেনে প্রবীণদের শ্রদ্ধা করেই নবীনদের এগোতে হয়। রাজনৈতিক দল এর থেকে আলাদা নয়। রাজনৈতিক দর্শন, সামাজ বিচ্ছিন্ন নয়। এখানে পাকা চুল, আর্ধ পক্ক ও কালো চুলের নেতৃত্বের মেলবন্ধনের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
প্রশ্ন- জ্যোতিরাদিত্যের কংগ্রেস ত্যাগ ও শচিন পাইলটের বিদ্রোহ প্রসঙ্গে আপনার কী প্রতিক্রিয়া?
অধীর চৌধুরী- দ্রুত সব দখল করতে হবে- এদের মানসিকতা অনেকটা এমন। মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কংগ্রেসে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত মানুষ রয়েছেন। জ্যোতিরাদিত্যে বা শচিন পাইলটরা কেউ জাদুকর নন, তাঁদের দলই পরিচিত করেছে। মাধবরাও সিন্ধিয়া বা রাজশ পাইলটের আগে এঁদের কে চিনত? মাধবরাও সিন্ধিয়া বা রাজশ পাইলটেরই বা কী পরিচয়?
প্রশ্ন- মাধাবরাও ও রাজেশ পাইলটের কী পরিচয়? তাঁরা কংগ্রেস নেতা ছিলেন...
অধীর চৌধুরী- জ্যোতিরাদিত্য বা শচিন উত্তরাধিকারসূত্রে আজ নেতা। তাঁরা যখন ভোটে লড়ল সেই কেন্দ্র থেকে কি কংগ্রেসের আর কোনও দাবিদার ছিল না? অবশ্যই ছিল। কিন্তু এঁদের আগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে কারণ এঁদের বংশ পরিচয়।
এঁরা (জ্যোতিরাদিত্য বা শচিন) কেউ কি রাস্তায় নেমে শুরুতে আন্দোলন করেছেন? পুলিশের লাঠির ঘা সহ্য করেছেন? কখনও জেলে গিয়েছেন? দলের হয়ে যখন কর্মীরা পুলিশের মার সহ্য করে আন্দোলন করেছেন তখন এঁরা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। তাই প্রার্থী হওয়ার সময়ে বুঝতে পারেননি যে তাঁদের উপরে অনেক প্রবীণ রয়েছেন। তাঁদের বাবার সঙ্গে একাধিক আন্দোলন করে উঠে আসা ব্যক্তিদের লোকসভায় টিকিট পাওয়া উচিত বলে কখনও এঁরা মনে করেছেন?
তাঁরা দ্রুত উপরে উঠতে চায়। ১০ তলায় ওঠার জন্য সিঁড়ির বদলে তাঁরা লিফটে চড়তে আগ্রহী। এটাই পার্থক্য করে দিচ্ছে।
প্রশ্ন- তাঁদের প্রস্থান কি শীর্ষেনেতৃত্বের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করছে?
অধীর চৌধুরী- শচীন কেন লোকসভায় দলকে জেতাতে পারল না? জোত্যিরাদিত্য তো নিজের কেন্দ্রেই হেরে গিয়েছেন। তুমি যদি এত বড় নেতাই হও তাহলে নিজের কেন্দ্রে হারলে কীভাবে? রাজস্থানে বিধানসভা ভোটে বিজেপি বিরোধী হাওয়া ছিল, তাই জন্যই কি সাফল্য আসেনি? যদি তা না হবে তাহলে এক বছর বাদেই লোকসভায় কংগ্রেস কেন মুখ থুবড়ে পড়ল?
প্রদেশ নেতা হিসাবে শচিন পাইলট কংগ্রেসকে কী দিয়েছেন? লোকসভায় দলের পরাজয়ের দায় একা রাহুল গান্ধীর?
প্রশ্ন- আপনি বলেছেন যে দলের বার্তা তৃণমূলস্তরে পৌঁছচ্ছে না। কারণ কি শীর্ষ নেতৃত্বের বিভ্রান্তি?
অধীর চৌধুরী- কংগ্রেসের নেতা, সভাপতি রয়েছে কি না সেটা দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী ও সাংবাদিক এই নিয়ে খুবই আগ্রহ দেখিয়ে থাকেন। অনেক সময়ই তাঁরা বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করেন। যেমন, রাহলজী কি সক্রিয় নন? তিনি তো বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর মতামত জানান, তবে এই প্রশ্নের কারণ কী?
বিভিন্ন পদে উপযুক্ত ব্যক্তিকে বসাতে হবে। নেতা নির্বাচনে আমাদের খামতি রয়েছে। সেদিকে নজর দিতে হবে।
Read in English
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন