রামমন্দির উদ্বোধনে ব্রাত্য এল কে আডবানি, এমএম যোশী? রাম মন্দির ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক চম্পত রাই বলেছেন যে ২২ শে জানুয়ারি রাম মন্দির উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকবেন।
প্রবীণ বিজেপি নেতা এল কে আদবানি এবং মুরলি মনোহর যোশী, যারা অযোধ্যায় রাম মন্দিরের আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন, পরের মাসের রাম মন্দির উদ্বোধনে তাঁদেরই দেওয়ার সম্ভাবনা কম। সোমবার এমনটাই জানানো হয়েছে রাম মন্দির ট্রাস্টের তরফে।
ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক চম্পত রাই সাংবাদিকদের বলেন, "দুজনের বয়সের কথা বিবেচনা করে তাঁদের না আসতে অনুরোধ করা হয়েছে, যা তাঁরা দুজনেই মেনে নিয়েছেন।" শ্রী রাই বলেছেন যে ২২ শে জানুয়ারী 'পবিত্রকরণ অনুষ্ঠানের' জন্য প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উপস্থিত থাকবেন। তিনি বলেন, '১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে এবং প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ পুজাপাঠ ১৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হবে এবং চলবে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত'।
আমন্ত্রিতদের বিস্তারিত তালিকা প্রদান করে, রাই বলেছিলেন যে 'আদবানি এবং জোশী স্বাস্থ্য এবং বয়স সম্পর্কিত কারণে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারবেন না' । উল্লেখ্য, আদবানীর বয়স বর্তমান ৯৬ । যেখানে জোশী পরের মাসে ৯০ বছরে পা দিতে চলেছেন।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার সঙ্গে দেখা করতে এবং তাঁকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে তিন সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়েছে, বলে রাই জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, প্রায় চার হাজার সাধু এবং ২২০০ অন্যান্য অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কাশী বিশ্বনাথ, বৈষ্ণো দেবীর মতো প্রধান মন্দিরের প্রধান এবং ধর্মীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
আধ্যাত্মিক নেতা দলাই লামা, যোগ গুরু বাবা রামদেব, সিনে তারকা রজনীকান্ত, অমিতাভ বচ্চন, মাধুরী দীক্ষিত, চলচ্চিত্র পরিচালক মধুর ভান্ডারকর এবং মুকেশ আম্বানি, অনিল আম্বানি, বিখ্যাত চিত্রশিল্পী বাসুদেবের মতো অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। ২৩ জানুয়ারি মন্দিরটি ভক্তদের জন্য খুলে দেওয়া হবে।
প্রবীণ বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আডবানি এবং মুরলি মনোহর যোশী, যারা ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে রাম মন্দির আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের বয়স বাড়ার কারণে পরের মাসে মন্দিরের অভিষেক অনুষ্ঠানে অযোধ্যায় না আসার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। সোমবার একথা জানিয়েছেন রাম মন্দির ট্রাস্টের সাধারণ সম্পাদক চম্পত রাই।
দুদিন আগেই রাম জন্মভূমি তীর্থক্ষেত্র ট্রাস্টের সম্পাদক চম্পত রাই জানিয়েছিলেন, বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি লালকৃষ্ণ আদবানি ও মুরুলি মনোহর যোশীকে অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে আসতে বারণ করা হয়েছে। রাই বিশ্বহিন্দু পরিষদের সহ সভাপতি।
কিন্তু মঙ্গলবার ওই সংগঠনেরই আন্তর্জাতিক শাখার কার্যনির্বাহী সভাপতি অলোক কুমার আমন্ত্রণ পত্র নিয়ে হাজির হলেন দুই প্রবীণ নেতার দিল্লির বাড়িতে। তাঁর দাবি তিনি দুজনকেই রাজি করিয়েছেন। ২২ জানুয়ারি অযোধ্যায় রাম মন্দির উদ্বোধনের সময় হাজির থাকবেন বিজেপির দুই প্রাক্তন সভাপতি তথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের সাবেক প্রচারক। সূত্রের খবর, চম্পত রাইয়ের বক্তব্য ঘিরে সঙ্ঘ পরিবার ও বিজেপির অন্দরে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে। অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেন তাঁর এই বক্তব্য ঘিরে।
বিজেপি ও সঙ্ঘের অনেকেই মনে করেন রাম মন্দিরের শিলান্যাস, উদ্বোধন আদবানিকে দিয়ে করানো উচিত ছিল। আসলে তাঁরই প্রধান কৃতিত্ব মন্দির আন্দোলন নির্মাণের।
ভিএইচপি নেতা অলোক কুমার মঙ্গলবার এক্স হ্যান্ডেলে দেওয়া বিবৃতিতে রাম মন্দির নির্মাণের পিছনে আদবানির অবদানের কথা স্মরণ করেছেন। সেই সঙ্গে বলেছেন দুই নেতাই কথা দিয়েছেন ২২ জানুয়ারি অযোধ্যা যাবেন।
কিন্তু বিশ্বহিন্দু পরিষদের সহ সভাপতি তথা মন্দির ট্রাস্টের নেতা চম্পত রাই কেন আদবানি ও যোশীকে অযোধ্যায় না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন তা নিয়ে চর্চা চলছে হিন্দুত্ববাদী শিবিরে। একটি মহলের বক্তব্য, মন্দির উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। উদ্বোধনের দিন অযোধ্যায় আদবানির উপস্থিতি প্রধানমন্ত্রীর প্রচারের আলোয় ভাগ বসাবে ধরে নিয়েই হয়তো তাঁকে স্বাস্থ্যের কারণে না যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। উল্লেখ্য, রাম জন্মভূমি আন্দোলনে তাদের অবদান শুধু বিজেপির গতিপথই বদলে দেয়নি, বিজেপিকে ভারতীয় রাজনীতিতেও শক্তিশালী স্থান অর্জনের ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা নেয়।
মোদী জমানায় শুরু থেকেই আঁধারে ৯৬ বছরের আডবাণী। একই অবস্থা অটলবিহারী বাজপেয়ী জমানার কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী নবতিপর মরলীমনোহর যোশীরও। বর্তমানে বিজেপির মার্গ-দর্শকের ভূমিকায় রয়েছেন তাঁরা। দুই প্রবীণ নেতার এই পরিণতির জন্য বিজেপির ‘পোস্টার বয়’ নরেন্দ্র মোদীর কৌশলের কথা গেরুয়া শিবিরের চর্চা উঠে আসে। এই পরিস্থিতিতে জানুয়ারিতে রামমন্দিরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আদবাণী-যোশীর না থাকা নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, প্রধানমন্ত্রী মোদীতে মহিমান্বিত করতেই কী আডবাণী, যোশীর মতো রাম মন্দির আন্দোলনের কান্ডারীদের ব্রাত্য করার পরিকল্পনা? উঠেছে প্রশ্নও
ভিএইচপি-র রাম মন্দিরের দাবিকে সিলমোহর দেওয়া হয় যখন আডবানি ১৯৮৬ সালে দলের সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব নেন। দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর আডবানি মুরলি মনোহর যোশীকে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেন। যোশী ছিলেন একজন আরএসএস পন্থী মানুষ। ১৯৮৯ সালের জুনে পালমপুর অধিবেশনে আডবাণীর অধীনে বিজেপি আনুষ্ঠানিকভাবে ভিএইচপি-র রাম মন্দিরের দাবিকে সমর্থন করেছিল। এরপর ১৯৯০ সালে অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের দাবি নিয়ে গুজরাটের সোমনাথ মন্দির থেকে রাম রথযাত্রা শুরু করেছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি। ওই বছরের ২৩ অক্টোবর, বিহারে তৎকালীন লালুপ্রসাদ যাদব সরকার তাঁকে গ্রেফতার করেছিল। যার ফলে, আচমকা সমাপ্তি ঘটেছিল সেই রথযাত্রার।
এরপর, গত ৩৩ বছরে অনেক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে, রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ জমি বিতর্কের অবসান ঘটেছে। অযোধ্যার ৫ একর জমির মালিকানা পেয়েছেন রামলালা। অযোধ্যায় মন্দির নির্মাণও প্রায় সম্পূর্ণ। আদবানির সেই রথযাত্রা জনসাধারণের মধ্যে সাড়া ফেলে। এটি কিছু জায়গায় দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায় এবং আদবাণীকে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে নিয়ে যায়।
বিজেপির সভাপতি হিসাবে আদবানির টানা দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ১৯৯১ সালে ফেব্রুয়ারিতে যোশীকে দলীয় প্রধান হিসাবে বেছে নেওয়া হয়। এর পরেই অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে, বিজেপির আসন সংখ্যা ৮৫ থেকে বেড়ে হয় ১২০। ভোটের হার ১১শতাংশ থেকে বেড়ে একলাফে হয় ২০ শতাংশ।
বিজেপি প্রধান হিসাবে, যোশী কল্যাণ সিংকে, যিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ১৯৯১ সালের জুন মাসে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসান। এর পরেই, নতুন মুখ্যমন্ত্রী এবং যোশী 'আমরা এখানে মন্দির তৈরি করব' স্লোগানের মধ্যে অযোধ্যা সফর করেন। রাজ্য সরকার বাবরি মসজিদের আশেপাশে ২.৭৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে ভিএইচপিকে হস্তান্তর করে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর রাম মন্দির আন্দোলনই ভারতের সর্ববৃহৎ গণআন্দোলন ছিল। পাশাপাশি রাম মন্দির আন্দোলনের মাধ্যমেও বিজেপি সর্ব ভারতীয় স্তরে নিজেকে অপ্রতিরোধ্য ভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়।