অরুণাচল প্রদেশের রাজধানী ইটানগরে বৃহস্পতিবার অশান্তি শুরু হয়। অশান্তির কেন্দ্রে ছিল- আদিবাসী, দেওরি, গোর্খা, মিশিং, মোরান এবং সোনোয়াল কাচারি, এই ছটি সম্প্রদায়কে স্থায়ী অধিবাসী শংসাপত্র (PRC) দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে। এঁরা মূলত রাজ্যের দুটি জেলা, নামসাই এবং চাংলাং জেলার বাসিন্দা।
গত তিন দিনেরও বেশি সময় ধরে চলা অশান্তিতে অন্তত একজন বিক্ষোভকারী নিরাপত্তাবাহিনীর ছোড়া গুলির আঘাতে নিহত হয়েছেন, মন্ত্রীদের বাড়িতে হামলা হয়েছে, সরকারি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, কর্তব্যরত সংবাদকর্মীরা হুমকির মুখে পড়েছেন, এবং অল অরুণাচল প্রদেশ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (AAPSU)-র মত জবরদস্ত সংগঠনের দফতরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শনিবার ভারতীয় সেনাবাহিনী ইটানগরে ফ্ল্যাগ মার্চ করে এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রক থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে ”বিক্ষোভকারীদের সাবধান করার জন্য সেনা নামানো হয়েছে।”
আরও পড়ুন, অবস্থান বদল! আপাতত পিআরসি নিয়ে পদক্ষেপ নয়, জানালেন অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গণ অভ্যুত্থানের জন্য ঐতিহাসিকভাবে পরিচিত অরুণাচল প্রদেশে এ বছরই লোকসভা ভোটের সঙ্গে বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা।
পিআরসি- দীর্ঘদিনের পুরনো এক দাবি
অরুণাচল প্রদেশে এই সম্প্রদায়গুলির পিআরসি-র দাবি বহুদিনের পুরনো। কিন্তু বেশ কতকগুলি ক্ষমতাবান গোষ্ঠী এ দাবির বিরুদ্ধাচরণও করে আসছে। যাঁরা এই সম্প্রদায়গুলির সদস্য, তাঁদের ১৯৯২-৯৩ সাল পর্যন্ত পিআরসি দেওয়া হয়েছে, যা পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
গত বছর রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছিল এই সম্প্রদায়গুলিকে জানুয়ারি মাসের মধ্যে পিআরসি দেওয়া হবে।
পরে সরকার জানায়, পিআরসি নিয়ে ওঠা বিভিন্ন বিষয় যৌথ উচ্চপর্যায়ের কমিটির কাছ থেকে রিপোর্ট পাওয়ার পর খতিয়ে দেখা হবে। ওই কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন অরুণাচল প্রদেশের বরিষ্ঠ মন্ত্রী নাবাম রেবিয়া।
যৌথ উচ্চপর্যায়ের কমিটির সদস্য বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন এবং অন্যান্য গোষ্ঠী সব পক্ষের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠক করে। এ সপ্তাহেই ওই কমিটির রিপোর্ট বিধানসভায় পেশ করার কথা।
আরও পড়ুন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থেকে বাহিনীকে রক্ষাকবচের আবেদন খতিয়ে দেখছে শীর্ষ আদালত
পিআরসি ওই রাজ্যের বাসিন্দা হিসেবে স্বীকৃতির একটি নথি, যার মাধ্যমে রাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কোটা ভিত্তিক চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়া যায়। প্রতিটি রাজ্যের এ ধরনের যোগ্যতামান থাকার কথা। অরুণাচল প্রদেশে সবছেকে বেশি পরিমাণ পিআরসি ইস্যু করা হয়েছে রাজ্যের তফশিলি জনজাতিদের মধ্যে।
অল মোরান স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সভাপতি অরুণজ্যোতি মোরান ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ”পিআরসি একটি আইনসঙ্গত এবং যথাযথ দাবি। মোরান সহ যেসব সম্প্রদায় অরুণাচল প্রদেশে বাস করছে, তারা এ রাজ্যের যথার্থ বাসিন্দা। আমরা এমনকি জনজাতি তকমাও দাবি করছি না, শুধু পিআরসি চাইছি। এমনকি সরকারও সে দাবি কার্যকর করতে সমর্থ নয়, তারা পরে আমাদের দাবি নিয়ে বিবেচনা করবে।”
আমসু-র লেকাং আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি বিহুধর মোরান ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ”আমরা এই ভূমিতে স্মরণাতীত কাল থেকে বাস করছি এবং পিআরসি আমাদের দীর্ঘদিনে বকেয়া দাবি। এ দাবি নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গেছে।” লেকং অরুণাচল প্রদেশের নামসাই জেলার অন্তর্ভুক্ত।
তিনি আরও বলেন, পিআরসি মানে আমরা যে অরুণাচল প্রদেশের বাসিন্দা, তার স্বীকৃতি। আমরা কোনওদিনই আসামের বাসিন্দা ছিলাম না, ফলে আসাম আমাদের সে সার্টিফিকেট দেবে না। কিন্তু অরুণাচলের এই শংসাপত্র দেওয়া উচিত, শুধু আমাদেরই না, অন্য পাঁচটি সম্প্রদায়কেও।
জানুয়ারি মাসে আমসু অরুণাচল প্রদেশের পূর্বভাগে অর্থনৈতিক অবরোধ সৃষ্টি করে, যার ফলে নামসাই, লোহিত এবং চাংলার জেলায় যান চলাচল ব্যাহত হয়। এ অঞ্চলগুলি দিয়ে তেল, কয়লা এবং কাঠ ট্রাকে করে মূলত আসামের তিনসুকিয়া সহ রাজ্যের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়।
অরুণাচল প্রদেশে পিআরসি নিয়ে রাজনীতি এবং বিক্ষোভ
যদিও যৌথ কমিটি কী প্রস্তাব দিয়েছে, সরকারিভাবে সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি, তবে সূত্র মারফৎ জানা গিয়েছে যে তাদের প্রস্তাব, ১৯৬৮ সালকে ভিত্তিবর্ষ ধরে পিআরসি দেওয়া হোক।
দীর্ঘদিন ধরেই অরুণাচল প্রদেশের একাংশের মানুষ পিআরসি-র বিরুদ্ধে। সরকার যৌথ কমিটির প্রস্তাব বিধানসভায় পেশও করেনি। তা সত্ত্বেও ইটানগরের হিংসা এই বিক্ষোভের পিছনে রাজনৈতিক শক্তির অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল।
শুক্রবার মুখ্যমন্ত্রী পেমা খাণ্ডু টুইট করে বলেছেন, ”বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রেথে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিধানসভার চলতি অধিবেশনে পিআরসি-র বিষয়টি আনা হবে না।”
রবিবার রাজ্যের মুখ্য সচিব সত্য পাল এক বিবৃতি জারি করে জানান, নামসাই এবং চাংলাং জেলার অ-জনজাতি সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের পিআরসি দেওয়ার বিষয়টি বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বন্ধ রাখা হয়েছে।
পিআরসি বিরোধী আন্দোলনের পূর্বভাগে থাকা সংগঠন আপসু-র নেতারাও পিআরসি বিরোধী আন্দোলনের চরিত্র দেখে হতবাক।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক আপসু নেতা জানিয়েছেন, ”এই হিংসার পিছনে আমরা নেই। আমাদের অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বাড়িঘরের উপরেও হামলার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পিছনে রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে বলেই মনে হয়।”
ইটানগরে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে আপসু সভাপতি হাওয়া বাগাং এ ইস্যুতে সংগঠনের অবস্থান স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, ”পিআরসি নিয়ে অ-জনজাতিদের অনুরোধ মোতাবেক, এটি কেবলমাত্র শিক্ষা এবং চাকরির জন্যই ব্যবহার করা যাবে, চাকরিতে জনজাতি সংরক্ষণের কোটায় পিআরসি ব্যবহার করা যাবে না।”
অরুণাচল প্রদেশের বিজেপি সভাপতি টাপির গাও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ”এই হিংসার পিছনে রয়েছে কংগ্রেস। সরকার ইতিমধ্যেই বিধানসভায় পিআরসি পেশ না করার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। এ ঘটনা রাজ্যে বিজেপি সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা। গত কয়েকদিন ধরেই ইটানগর এলাকায় গুন্ডারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি টাকাম সঞ্জয় বলেছেন, "এই হিংসা থেকে বিজেপি সরকারের অপদার্থতা প্রমাণিত। এখনই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা উচিত।"
Read the Full Story in English