গত বছর ২০ সেপ্টেম্বরের কথা, ঘোষ পরিবারে এল নতুন অতিথি। ফুটফুটে কন্যা সন্তানকে পেয়ে খুশির বাঁধ ভেঙে পড়েছিল ঘোষ দম্পতির কোলে। ফুটফুটে মেয়ের নাম তাই রাখা হল খুশি। এ বছরের ২০ মার্চ। সংখ্যাটা একই, ২০। ওইদিনই ছোট্ট শিশু খুশির চোখ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষ পরিবারের খুশি যেন মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। তারপর থেকেই আসানসোলের কুমারপুরের ঘোষ পরিবারে শোকের ছায়া।
না, কোনও দুর্ঘটনা নয়, বড় কোনও অসুখও নয়। ছ’ মাসের খুশির জ্বর হয়েছিল। জ্বর না কমায় মেয়ের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ছুটে গিয়েছিলেন বাবা-মা। কিন্তু সেখানে গিয়েই যত বিপত্তি হল বলেই মনে করছেন খুশির বাবা অক্ষয় কুমার ঘোষ। চিকিৎসার গাফিলতিতেই মেয়ের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন জীবন বিমা সংস্থার কর্মী অক্ষয়।
খুশির মৃত্যুতে কাঠগড়ায় আসানসোলের এইচএলজি হাসপাতাল। এ ঘটনার হাত ধরে আরও একবার চিকিৎসায় গাফিলতিতে মৃত্যুর অভিযোগ উঠল এ রাজ্যে। তবে এ ঘটনা যেন একটু ব্যতিক্রমী। গাফিলতিতে মেয়ের মৃত্যুর অভিযোগে, রোষে অন্যদের মতো হাসপাতালে ভাঙচুর চালাননি অক্ষয়রা। বরং প্রতিবাদের ধরন পাল্টে ফেলেছেন এঁরা। মেয়ের মৃত্যুতে সিবিআই তদন্তের দাবি জানিয়ে গত ২৪ মার্চ থেকে স্ত্রী রূপা ঘোষকে নিয়ে ধরনায় বসেছেন অক্ষয় কুমার ঘোষ। শুধু ধরনাই নয়, ১৩ এপ্রিল একদিনের অনশনেও বসেন খুশির বাবা-মা। কোনও ফয়সালা না হলে আগামী বুধবার থেকে আমরণ অনশন করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন অক্ষয়রা। এমনকি, আসানসোলে রামনবমী ঘিরে যে অশান্তি ছড়িয়েছিল, সেসময়ও টানা ধরনা চালিয়ে গিয়েছিলেন অক্ষয়রা।
ঠিক কী অভিযোগ? আই ই বাংলাকে ফোনে অক্ষয় কুমার ঘোষ বললেন, ‘‘মেয়ের জ্বর হওয়ায় ২০ মার্চ প্রথমে ইএসআই হাসপাতালে যাই, সেখানে আউটডোরে চিকিৎসক না থাকায় এইচএলজি হাসপাতালে যাই।’’ ওইদিন বিকেল ৩টে ৫৮ মিনিট নাগাদ এইচএলজি হাসপাতালে চিকিৎসক অমিত মণ্ডলের তত্ত্বাবধানে খুশিকে ভরতি করা হয়। মেয়ের অবস্থা সংকটজনক বলে সন্ধে ৭টা নাগাদ স্বামীকে খবর দেন খুশির মা রূপা ঘোষ। অভিযোগ, একটি ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর খুশির সারা শরীর ফুলে যায়, সেইসঙ্গে সারা গায়ে র্যাশ বেরিয়ে যায়। এরপর তাকে আইসিইউ-তে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানেই ধন্দ অক্ষয়দের। মেয়েকে মৃত অবস্থাতেই আইসিইউ-তে নিয়ে যাওয়া হয় বলে অভিযোগ অক্ষয়ের। রাত ১০টা ০৫ মিনিট নাগাদ ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। ডেথ সার্টিফিকেটে খুশির মৃত্যুর কারণ নিউমোনিয়া বলে উল্লেখ করা রয়েছে বলে জানিয়েছেন খুশির বাবা। তাঁর দাবি, রাত ১০টা ১৫-২০ মিনিট নাগাদ খুশির নিথর দেহ তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এতেই শেষ নয়, আরও গুরুতর অভিযোগ এনেছেন অক্ষয়। অমিত মণ্ডল নামে যে চিকিৎসকের অধীনে মেয়েকে ভরতি করেছিলেন, তিনি আদপে খুশির চিকিৎসাই করেননি। অমিত মণ্ডল পরিচয় দিয়ে হাসপাতালের একজন জেনারেল ফিজিশিয়ান খুশির চিকিৎসা করেন বলে অভিযোগ অক্ষয়দের।
অন্যদিকে মেডিকেয়ারে আগেই মেয়ের বুকের এক্স-রে করিয়েছিলেন অক্ষয়। গত ২২ মার্চ সেই রিপোর্ট হাতে পান তিনি। সেই রিপোর্টে নিউমোনিয়ার কোনওরকম লক্ষ্মণের কথা বলা নেই বলে দাবি করেছেন খুশির বাবা। এরপর ২৪ মার্চ থেকে আসানসোলের এইচজেএল হাসপাতালের সামনে ধরনায় বসেন শোকসন্তপ্ত খুশির বাবা-মা।
প্রশাসনের তরফে সেভাবে কোনও সাহায্য মেলেনি বলে অভিযোগ অক্ষয়দের। এমনকি, থানায় নালিশ জানানো নিয়েও টালবাহানা করা হয় বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, প্রথমে আসানসোল দক্ষিণ থানায় যাওয়ার পর থানা থেকে জানানো হয়, হাসপাতালটি ওই থানা এলাকায় পড়ে না। ফলে তারা এফআইআর নিতে পারবে না। এরপর আসানসোল উত্তর থানার দ্বারস্থ হন অক্ষয়। চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে এফআইআর নিতে এ থানাও অস্বীকার করে বলে অভিযোগ অক্ষয়ের। শেষমেশ থানায় জেনারেল ডায়েরি করেন খুশির বাবা। নিজের অভিযোগ জানিয়ে পুলিশ কমিশনার, জেলাশাসক এবং সিএমওএইচকে চিঠি পাঠিয়েছেন অক্ষয়। অভিযোগ পেয়ে কমিটি বানিয়ে বিষয়টির তদন্ত করা হচ্ছে বলে অক্ষয়কে সিএমওএইচের তরফে জানানো হয়েছে। সিএমওএইচকে লেখা চিঠিতে অবশ্য জানানো হয়েছে, থানায় এফআইআর করা হয়েছে। অক্ষয়ের বক্তব্য, সে কথা ভুলবশত লেখা হলেও, পরে মৌখিকভাবে সিএমওএইচকে গোটা বিষয়টি জানানো হয়। আইনি বিষয়গুলি সম্পর্কে অজ্ঞতাহেতুই এই বিভ্রান্তি বলে জানিয়েছেন তিনি। চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয়েছে আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারিকে ও। এ ঘটনায় স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী মলয় ঘটক ও কাউন্সিলরেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অক্ষয় কুমার ঘোষ। কিন্তু তাঁদের তরফে এখনও কোনও সাহায্য পাননি বলে অভিযোগ খুশির বাবার। এ ব্যাপারে আই ই বাংলার তরফে মলয় ঘটকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। প্রথম দুবার অন্য এক ব্যক্তি ফোন ধরলেও, পরে মন্ত্রীকে আর ফোনে পাওয়া যায়নি। এসএমএসেও কোনও জবাব আসেনি।
তবে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন আসানসোলের মেয়র। আই ই বাংলাকে ফোনে আসানসোলের মেয়র বলেন, সিএমওএইচ ইতিমধ্যেই তদন্ত করছেন। তদন্তের রিপোর্ট এলেই সবটা জানা যাবে। দোষ প্রমাণ হলে ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জিতেন্দ্র তিওয়ারি। একইসঙ্গে খুশির বাবা-মাকে প্রশাসনের উপর ভরসা রাখার বার্তাও দিয়েছেন মেয়র।
এ ঘটনায় এইচএলজি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। হাসপাতালের সামনে থেকে অক্ষয়দের ধরনা তোলার জন্য তাঁদের হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ এইচএলজি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। তাঁর দাবি এ সম্পর্কিত পোস্টার, ব্যানারও ছিঁড়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
অন্যদিকে খুশির বাবা-মা’র পাশে দাঁড়িয়েছেন বহু সাধারণ মানুষ। ফয়সালা না হলে আগামী দিনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরও দ্বারস্থ হবেন বলে জানিয়েছেন অক্ষয় কুমার ঘোষ।