সুপ্রিম কোর্টে ৩৭০ প্রত্যাহারে বৈধতা, আগামী বছর রাম মন্দির উদ্বোধনের আগে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের কাছে এক বড় রাজনৈতিক সাফল্য। কারণ, বিজেপির পূর্বসূরি ভারতীয় জনসংঘ, সর্বদাই কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাকে বিচ্ছিন্নতাবাদের জীবন্ত লক্ষণ হিসেবে দেখেছিল। জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির স্লোগান ছিল, 'এক দেশ মে দো নিশান, দো বিধান অউর দো প্রধান নহি হো সক্তে (এক দেশে দুটি পতাকা, দুটি সংবিধান এবং দু'জন প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারেন না)'।
জনসংঘ ও প্রজা পরিষদ
এই স্লোগানটি শুধু জনসংঘই নয় বরং প্রজা পরিষদও বারবার প্রয়োগ করেছিল। যার নেতা ছিলেন প্রাক্তন স্বয়ংসেবক প্রেমনাথ ডোগরা। তাঁর এই বক্তব্য, জম্মুর ডোগরা হিন্দুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। প্রবীণ বিজেপি নেতা এলকে আদবানি জনসভায় তাঁর বক্তৃতাতেও বলেছেন যে কাশ্মীরের সম্পূর্ণ একীকরণ প্রয়োজন ছিল। কারণ, ভারত দ্বি-জাতি তত্ত্ব মেনে নেয়নি। কারণ, এই তত্ত্ব মানলে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের রাজনৈতিক মর্যাদা নির্ধারণ করা উচিত ছিল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বিরুদ্ধে বিজেপি যে অস্ত্রগুলি তুলে ধরে, তার মধ্যে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা লাগু করা অন্যতম। কংগ্রেসের যদিও দাবি, মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরকে দেশভাগের পরে ভারতের সঙ্গে রাখার জন্য বিশেষ সাংবিধানিক বিধানের প্রয়োজন ছিল। আর, সেটাই ৩৭০ ধারা।
৩৭০ ধারার কবচ
ধারা ৩৭০ এবং পরবর্তীতে ৩৭০ অনুচ্ছেদ কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সংসদকে শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা, বিদেশ এবং যোগাযোগের ক্ষমতা দিয়েছে। এই তিনটির বাইরে, ভারতীয় আইন জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। ১৯৫২ সালের জুলাইয়ে, ন্যাশনাল কনফারেন্সের শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বাধীন জম্মু ও কাশ্মীর সরকার জওহরলাল নেহেরু নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুযায়ী, কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে বিরোধের বিষয়ে এবং মৌলিক অধিকারের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের মূল এক্তিয়ারকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, সমস্ত দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলায় আপিলের এক্তিয়ারও কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করেছে। ভারতীয় পতাকার আধিপত্য স্বীকার করেছে, যদিও রাজ্যের পতাকার ব্যবহারও থাকবে বলেই চুক্তিতে জানানো হয়েছিল।
বিজেপির আক্রমণ
পাশাপাশি, এই চুক্তি রাষ্ট্রের সম্মতি সাপেক্ষে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের ক্ষেত্রে ৩৫২ অনুচ্ছেদের অধীনে জম্মু-কাশ্মীরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা নিয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে মেনে নিয়েছে। আদবানি ও প্রয়াত বিজেপি নেতা অরুণ জেটলি দাবি করেছিলেন, কাশ্মীরকে ভারতে একীভূত করার পিছনে প্রাথমিকভাবে 'জনসংঘের চাপ' ছিল। যাই হোক, প্রজা পরিষদও দিল্লি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং ১৯৫২ সালের অক্টোবরের মধ্যে জম্মু-কাশ্মীর গণপরিষদ রাজ্যের প্রধান নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিলে আন্দোলনের পরিকল্পনা করছিল। এটি সেই সময় আন্দোলন শুরু করে যখন জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা, ১৯৫২ সালের নভেম্বরে করণ সিংকে রাজ্যের প্রধান ('সদর-ই-রিয়াসত') নির্বাচিত করে।
প্রজা পরিষদের আন্দোলন
আন্দোলনের জেরে ডোগরা এবং প্রজা পরিষদের অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে কানপুরে তার প্রথম বার্ষিক অধিবেশনে জনসংঘ দাবি করেছিল প্রজা পরিষদ, জম্মু ও কাশ্মীর সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক করতে হবে। যা পূরণ না-হওয়ায়, জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতে একীকরণের দাবিতে পূর্ণাঙ্গ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল জনসংঘ।
আরও পড়ুন- জম্মু-কাশ্মীরের প্রকৃত বাসিন্দা কারা? ৩৭০ নিয়ে বিতর্ক খুঁচিয়ে তুলল আসল সত্য
মতাদর্শের লড়াইয়ে জয় হল বিজেপির, এবার কী?
৩৭০ ধারা নিয়ে মতাদর্শের সেই দীর্ঘ লড়াইয়ে এতদিনে জয় পেল বিজেপি। প্রশ্নটা হচ্ছে, এবার তাহলে কী হতে যাচ্ছে গেরুয়া শিবিরের এজেন্ডা? তা হল- একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড। যা ইতিমধ্যেই রাজ্য নীতির নির্দেশমূলক অংশ। চলতি বছরের গোড়ার দিকে, আইন কমিশন একটি সাধারণ নাগরিক বিধি নিয়ে জনসাধারণ-সহ সমস্তস্তরের মতামত চেয়ে পরামর্শমূলক প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। পেয়েছে ৫০ লক্ষেরও বেশি পরামর্শ। একটি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, যদি এই সরকার কার্যকর করার লক্ষ্যে খসড়া আইন প্রণয়ন করে, তবে বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার এবং দত্তক গ্রহণের মতো বিষয়গুলিতে ধর্মীয় সম্প্রদায় নির্বিশেষে একই আইন লাগু হবে।