২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা। সেই সময় দাঙ্গার অংশ হিসেবে একটা ঘটনা সারা ভারতকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তা হল, বিলকিস বানোর গণধর্ষণ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা। সেই মামলায় একদিন আগেই জেল থেকে মুক্তি শৈলেশ ভাট ও আরও ১০ জন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার একদিন পরে দোষী সাব্যস্ত শৈলেশ ভাটের দাবি, তারা 'রাজনীতির শিকার'।
ঘটনাটা যে সময়ের, তখন শৈলেশ বিজেপির এক স্থানীয় কর্মী। তার ভাই মিতেশকেও এই মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। শৈলেশ এখন ৬৩। শৈলেশের মত মিতেশও গোধরা জেল থেকে মুক্তি পেয়েছে। মুক্তির পর প্রত্যেকেই ফিরে গিয়েছে গুজরাতের দাহোদ জেলায় নিজেদের গ্রাম সিঙ্গোরে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল শৈলেশ, মিতেশরা। বিচারপর্বের শেষে ১৫ বছর জেলে কাটিয়েছে। অবশেষে গুজরাত সরকার স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে ক্ষমাভিক্ষার নীতি নিয়ে তাদের মুক্তি পেল।
যে মতবাদ আর যে দলের জন্য তারা জীবনের এতগুলো বছর হারাল, সেই দল আজও গুজরাতে ক্ষমতায়। তবে, নিজেদের গ্রামে শৈলেশদের জন্য হিন্দুত্ববাদীরা কোনও সংবর্ধনার ব্যবস্থা রাখেনি। 'নায়ক'রা ফিরে এসেছে, এমন ধাঁচের কোনও অনুষ্ঠানপর্বও করেনি তাদের দল। কারণ, একটা হতে পারে শৈলেশরা কোনও বড় নেতা ছিল না। অথবা, বিজেপির বক্তব্য অনুযায়ী, তারা হিংসাকে প্রশ্রয় দেয় না।
যদিও পলিটিক্যাল মাইলেজের কথা বললে, গুজরাত দাঙ্গার পর জাতীয় রাজনীতিতে দুটো নাম খুব বেশি উঠে এসেছিল। সেই গুজরাত থেকেই। একজন নরেন্দ্র মোদী, সেই সময় যিনি গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। অন্যজন অমিত শাহ। সেই সময় গুজরাতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। এখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
বিলকিস বানো মামলার অপরাধীরা তাই বাড়ি ফিরল নিঃসঙ্গ অবস্থায়। গ্রামে ফিরে নিজেদের অবস্থাটা আরও বেশি করে বুঝতে পারছে শৈলেশরা। সাংবাদিকদের কাছে তাদের সাফাই, 'সিঙ্গোর একটা ছোট গ্রাম। আসামিরা সবাই এই গ্রামের বাসিন্দা। আমরা সবাই রাজনীতির শিকার হয়েছি।' কিন্তু, রাজনীতির শিকার কীভাবে হবে শৈলেশ? সেই সময়ও তো গুজরাতে বিজেপিরই সরকার ছিল। অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রেও এনডিএর সরকার। তাহলে, কি নিজের দলের প্রতিই আঙুল তুলছে শৈলেশ? প্রশ্নটা উঠছে। কারণ, পেশায় কৃষক শৈলেশ ছিল জেলা বিজেপির একজন নেতা। গেরুয়া শিবিরের ভাষায় কর্মকর্তা। আর, তার ভাই মিতেশ পঞ্চমহল ডেয়ারিতে কেরানির কাজ করত।
যাই হোক, এতবছর পর বাড়ি ফিরে শৈলেশ, মিতেশরা খুশি। শৈলেশের কথায়, 'আমরা ২০০৪ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলাম। ১৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে জেলে ছিলাম। এখন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বাড়িতে থাকতে ভালো লাগছে। আমরা ফিরে আসায় সবাই খুশি। আমার ছেলের বয়স তখন নয় বছর। এখন প্রাপ্তবয়স্ক। পঞ্চমহল ডেয়ারিতে কাজ করে। আমি তার জন্যও খুশি।' শৈলেশরা যখন জেলে, তখনই ওদের মা মারা যায়। সেটা ২০০৭ সাল। আদালত শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী জামিন মঞ্জুর করেছিল।
আরও পড়ুন- ভারতের স্বাধীনতা দিবসে বিবিসির উপহার টিভিতে নেহরুর প্রথম উপস্থিতি, ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়ায়
বিলকিস বানোর বয়স তখন ২১। পাঁচ মাসের গর্ভবতী। আচমকা ২০০২ সালে গোধরার সবরমতি এক্সপ্রেসে আগুন লাগানোর অভিযোগ ওঠে। তারপরই গুজরাতের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক হিংসা ছড়ায়। বিলকিসের পরিবারের সাত জন ওই হিংসায় খুন হয়েছেন। কিন্তু, যারা এতবড় ঘটনার জন্য সাজা পেল, তারাই কি প্রকৃত দোষী? সেই প্রশ্ন ২০ বছর পরও তুলছে সাজাপ্রাপ্তরা।
এই মামলার অন্যতম সাজাপ্রাপ্ত রাধেশ্যাম শাহ। শৈলেশ, মিতেশদের সঙ্গেই জেলে ছিল। একসঙ্গেই ছাড়া পেয়েছে। রাধেশ্যামেরও দাবি, তারা নির্দোষ, তাদের ফাঁসানো হয়েছিল। সাংবাদিকদের কাছে রাধেশ্যাম বলেছে, 'আমরা একটা আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম বলে আমাদেরকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল।' বিচার চলাকালীন এই বন্দিদের একজন মারা গিয়েছিল। একাধিক বন্দির স্ত্রী মারা গিয়েছে। কিন্তু, বিলকিস কি আদৌ ন্যায্য বিচার পেয়েছে? শৈলেশ, মিতেশ আর রাধেশ্যামদের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বিলকিসের দীর্ঘশ্বাসও কি একইসঙ্গে ভাসছে গুজরাতের দাহোদে? গুজরাত দাঙ্গার ২০ বছর পরও প্রশ্নটা উঠছে।
Read full story in English