Advertisment

নিজামের থেকে মুক্তি না ভারতভুক্তি, ১৭ সেপ্টেম্বর পালন নিয়ে বিবাদ বিজেপি-টিআরএসের

হিন্দুত্ববাদের ধুয়ো তুলতে বিজেপি অভিযোগ করেছে, আট বছর ক্ষমতায় থাকার পরও টিআরএস দিনটি পালন করেনি। কারণ, তারা ওয়াইসিকে চটাতে চায়নি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Maulana Abul Kalam Azad

মৌলানা আবুুল কালাম আজাদ, পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ও (ডানদিকে) হায়দরাবাদের নিজাম মির ওসমান আলি খান।

তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (টিআরএস) এবং বিজেপি এখন ১৭ সেপ্টেম্বর পালন নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে বিবাদে মত্ত। ১৭ সেপ্টেম্বর সেই বিশেষ দিন, ১৯৪৮ সালের যে দিনে হায়দরাবাদ ভারতভুক্ত হয়েছিল। যদিও টিআরএস-এর নেতৃত্বাধীন রাজ্য প্রশাসন দিনটিকে 'তেলেঙ্গানা জাতীয় ঐক্য দিবস' হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু, বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে যে এই দিনটিকে 'হায়দরাবাদ রাজ্য মুক্তি দিবস' হিসেবে পালন করা হবে।

Advertisment

আগামী বছরের জন্য রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে, বিজেপি হায়দরাবাদের সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়াইসির নেতৃত্বাধীন টিআরএস এবং তার সহযোগী এআইএমআইএম (অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন) এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানের বার্ষিকী পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একইসঙ্গে হিন্দুত্ববাদের ধুয়ো তুলতে বিজেপি অভিযোগ করেছে, আট বছর ক্ষমতায় থাকার পরও টিআরএস দিনটি পালন করেনি। কারণ, তারা ওয়াইসিকে চটাতে চায়নি।

ওয়াইসির নেতৃত্বাধীন দলটি বলেছে যে মূল মজলিস (মজলিস-ই-ইত্তেহাদ-উল-মুসলিমিন) বা এমআইএম ভারতের সঙ্গে হায়দরাবাদের সংযুক্তিকরণের বিরোধিতা করেছিল। এনিয়ে হিংসার পথে হেঁটেছিল। কিন্তু, ১৭ সেপ্টেম্বরের পর ১৯৪৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের পর সেই দলের অস্তিত্ব মিটে গিয়েছে। ঐতিহাসিক মহম্মদ নুরউদ্দিন খানের মতে, এমআইএমের সভাপতি কাসিম রাজভি এবং অন্যান্য প্রবীণ নেতারা পাকিস্তানে চলে যান। তাঁরা আসাদউদ্দিনের দাদু আবদুল ওয়াহেদ ওয়াইসির কাছে দলের ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। তার আগে আবদুল ওয়াহেদ ওয়াইসি এই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।

বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক তরুণ চুঘ আবার অভিযোগ করেছেন যে টিআরএস গত সপ্তাহে 'তেলেঙ্গানা জাতীয় ঐক্য দিবস' পালনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকার এই দিনটিকে 'মুক্তি দিবস' হিসেবে স্মরণ করার পরিকল্পনা করেছে। কেন্দ্রীয় সরকার প্যারেড গ্রাউন্ডে একটি বিশাল জনসভার আয়োজন করার পরিকল্পনা করেছে। কেন্দ্রীয় পর্যটন ও সংস্কৃতি মন্ত্রী জি কিষাণ রেড্ডি, যিনি সেকেন্দ্রাবাদের সাংসদ, মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও (কেসিআর)-কে চিঠি লিখে তাঁকে প্যারেড গ্রাউন্ডের অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

হায়দ্রাবাদের অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করবেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তারপরে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠানের ৭৫তম বার্ষিকীতে বছরব্যাপী অনুষ্ঠান হবে। মহারাষ্ট্র এবং কর্ণাটক অবশ্য ইতিমধ্যেই এই দিনটিকে মারাঠাওয়াড়ার মুক্তি দিবস এবং হায়দরাবাদ-কর্ণাটক মুক্তি দিবস (দুই রাজ্যের কিছু এলাকা হায়দরাবাদ রাজত্বের অধীনে পড়েছিল) হিসেবে স্মরণ করার কথা জানিয়েছে। আবার কেন্দ্রের লক্ষ্য তিনটি রাজ্যজুড়ে দিবসটি উদযাপন করা। আর, সবটাই একই ছাতার নীচে। সেই কারণে তেলেঙ্গানা সরকারকে পাঠানো চিঠিই পাঠানো হয়েছে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিণ্ডে ও কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইকেও।

তবে, তেলেঙ্গানা সরকার কেন্দ্রের ঘোষণাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে নারাজ। তারা নিজেদের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তেলেঙ্গানা সরকারের এই ঘোষণার পরে, তেলেঙ্গানার বিজেপি প্রধান বান্দি সঞ্জয় কুমার তাঁর দলের পক্ষে জয়ের দাবি করেন। কেন তিনি এই দাবি করছেন, তা বোঝাতে গিয়েছে বান্দি সঞ্জয় কুমার বলেন, “কেন্দ্রের ঘোষণার পরেই রাজ্য সরকার এটি উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু টিআরএসই নয়। একথা কংগ্রেস এবং এআইএমআইএমও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছে। আসলে বিজেপিই বহু বছর ধরে দাবি করে আসছে যে এই অনুষ্ঠানকে তেলেঙ্গানা মুক্তি দিবস হিসাবে পালন করা উচিত। ক্ষমতায় থেকেও টিআরএস এর আগে কখনও দিনটি পালনে জোর দেয়নি।”

বান্দি সঞ্জয় কুমার আরও বলেন, "বিজেপি ১৭ সেপ্টেম্বরকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়। কারণ, এটি সেই দিন, যেদিন হায়দরাবাদ রাজ্য নিজামের থেকে নেওয়া হয়েছিল। এটা আবেগের ব্যাপার। কারণ, নিজামের লোকেরা সাধারণ হিন্দুদের ওপর বর্বরতা চালিয়েছিল। কারও অনুভূতিতে আঘাত না-করার জন্য, সেই নিজামের হাত থেকে মুক্তি উদযাপন না-করাটা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।”

পালটা রাস্তায় হাঁটছেন কেসিআর
কেন্দ্রের ঘোষণা রাজ্য সরকারের ১৭ সেপ্টেম্বর পালনে বাধা তৈরি করবে। এমনটাই মনে করছে টিআরএস। টিআরএস ঠিক করেছে, ১৭ সেপ্টেম্বরেক তেলেঙ্গানার ভারতভুক্তি দিবস হিসেবে পালন করা হবে। ওয়াইসিও এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছেন। এই ব্যাপারে ওয়াইসি বলেছেন, এই দিনটিকে সংহতি দিবস হিসেবে পালন করাই ঠিক হবে। কারণ, দিনটি হল সাহসের প্রতীক। এই দিনেই রাজ্যবাসী সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং নিজামের স্বৈরাচারী শাসনকে প্রতিরোধ করেছিল। তেলেঙ্গানা মুসলিমদের সমর্থন আছে কেসিআরের সঙ্গে। এআইএমআইএম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে না, এমন এলাকায় মুসলিমরা কেসিআরকেই সমর্থন করেছেন।

আর, এই সব কারণে তেলেঙ্গানা গঠনের আগে কেসিআর নিজামদের ভালো কাজের প্রশংসা করতেন। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুদান দেওয়া, সেচের সুবিধা তৈরি করা, এসব কাজগুলো নিজামের আমলে হয়েছিল। এমনটাই দাবি করতেন কেসিআর। এই সব কথা বলার ফলে কেসিআরের প্রতি মুসলিমদের সমর্থন বেড়েছে। তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের পর টিআরএসও এই সমর্থন থেকে উপকৃত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে টিআরএস নেতৃত্ব মনে করছেন, সংযুক্তিকরণ বা মুক্তি- যাই পালন করা হোক না-কেন, এতে দলকে ভুগতে হতে পারে।

কী বলছে ইতিহাস
ভারত যখন ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন হয়েছিল, তখনও ৫০০টি দেশীয় রাজ্য ভারতে যোগ দিতে চায়নি। এই সব রাজ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল হায়দরাবাদ। এই প্রসঙ্গে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বলেছিলেন, "একটি স্বাধীন হায়দরাবাদ ভারতের পেটে ক্যানসারের জন্ম দিয়েছে।''

১৯৪০-এর দশকে, কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে হায়দরাবাদে একটি শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন শুরু হয়। যা শীঘ্রই দরিদ্র ভাড়াটে এবং ক্ষুদ্র জমির মালিকদের পাশে পায়। যখন স্বাধীনতা এবং ভারতে যোগদানের বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়, তখন নিজাম এবং অভিজাতরা একটি মুক্ত হায়দরাবাদের দাবি করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবাদী কৃষক-সহ জনসংখ্যার একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভারতে যোগদানের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

আরও পড়ুন- মধ্যপ্রদেশ বিজেপিতে কোন্দল তুঙ্গে, শিবরাজের সরকারের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগে সরব পদ্ম-নেতারা

নিজাম তখন রাজাকার নামে একটি আধাসামরিক বাহিনী ব্যবহার করেন। যাঁর উৎপত্তি হয়েছিল এমআইএম থেকে। রাজাকার মিলিশিয়া কৃষক আন্দোলনকে দমন করে এবং গ্রাম লুণ্ঠন করে এবং আন্দোলনকারী বলে সন্দেহভাজনদের হত্যা করে ভারতে যোগদানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ১৯৪৮ সালের ২৭ আগস্ট রাজাকাররা ভৈরনাপল্লিতে ৯৬ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করে।

এরপর, ১৯৪৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী অপারেশন 'পোলো'-র অংশ হিসাবে বর্তমানে তেলেঙ্গানা এবং মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের কয়েকটি অঞ্চল নিয়ে গঠিত তৎকালীন হায়দরাবাদ রাজ্যে প্রবেশ করে। এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে নিজাম ও রাজাকার বাহিনী সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

Read full story in English

bjp Telengana TRS
Advertisment