একদিকে তৃণমূলের সংগঠন, অন্যদিকে বিজেপি'র ‘বাহুবলী’ প্রার্থী। কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও বামেদের মরিয়া চেষ্টা ২০১৪ সালের ভোট ধরে রাখার। ব্যারাকপুর লোকসভায় নির্বাচনের প্রাকলগ্নে এই সব সমীকরণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে দলবদলের খেলা। প্রায় প্রতিদিনই এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে যাতায়াত করছেন জুট মিল এলাকার 'স্ট্রংম্যান'-রা। সঙ্গে রয়েছে অর্ন্তদ্বন্দ্ব।
বিজেপি'র কর্মীসভায় তখন উপস্থিত দলের রাজ্য ও জেলা নেতৃত্ব। দেখা গেল, তাঁদের সামনেই যুযুধান দু'দল বিজেপি কর্মী! মঞ্চ থেকে নেতারা চেষ্টা করেও থামাতে পারছেন না বিবাদ। গেরুয়া শিবিরের মিছিলেও বচসা, হাতাহাতির ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। এমন বিভিন্ন ঘটনাকে হাতিয়ার করেই বিজেপির প্রতি কটাক্ষের তীর ছুঁড়ছেন বিরোধীরা। শাসকদল তৃণমূল এবং বিরোধী বামেরা দাবি করছেন, অর্জুন সিংয়ের মতো হেভিওয়েট প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও ব্যারাকপুর কেন্দ্রে বিজেপির প্রধান কাঁটা এই অর্ন্তদ্বন্দ্বই।
লোকসভা ভোটের আরও খবর পড়ুন, এখানে
সূত্রের খবর, অর্জুনের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই কথাবার্তা চালাচ্ছিল বিজেপি। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা প্রকাশের আগে পর্যন্ত পাকা কথা দেন নি তিনি। শিল্পাঞ্চলের এক আইএনটিটিইউসি নেতার কথায়, "অর্জুনভাই আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন টিএমসির টিকিট পাওয়ার। এক পর্যায়ে কিছুটা নিশ্চিতও হয়েছিলেন। জগদ্দলের শ্রমিক ভবনের এক সভায় অনুগামীদের আশ্বস্তও করেছিলেন। তারপর ছবিটা আচমকাই বদলে গেল।" তিনি বলেন, "অর্জুন বিজেপিতে যাওয়ায় এই কেন্দ্রে আমরা কড়া লড়াইয়ের মুখে পড়ব ঠিকই, কিন্তু বিজেপি'র অন্দরেও প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গিয়েছে। বহু পুরনো বিজেপি কর্মী অর্জুনের হয়ে কাজ করতে রাজি নন।"
বস্তুত, গত রবিবার জগদ্দলের এক মিছিলে বিধায়কের অনুগামীদের 'অর্জুন সিং জিন্দাবাদ' স্লোগানের প্রতিবাদ করেন সংঘ পরিবারের ট্রেড ইউনিয়ন বিএমএসের একাংশ। তাঁদের দাবি, নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহ ছাড়া কারও নামে স্লোগান দেওয়া যাবে না। সংখ্যায় অনেক বেশি অর্জুন অনুগামীরা অবশ্য সেই দাবি মানেন নি। একইভাবে, বীজপুরের এক পুরনো বিজেপি নেতাও এখনও পর্যন্ত অর্জুনের প্রচারে সক্রিয় হননি। সূত্রের খবর, অর্জুন দল না ছাড়লে টিকিট পাওয়ার অন্যতম দাবিদার ছিলেন ওই নেতা। ঘনিষ্ঠমহলে তিনি জানিয়েছেন, যে অর্জুন একদা বিজেপির অফিস দখল করেছেন, প্রকাশ্য রাস্তায় রাজ্যস্তরের নেতাদের হুমকি দিয়েছেন, সেই অর্জুনের সঙ্গে কাজ করা অসম্ভব। যদিও বিজেপি সূত্রের খবর, সম্প্রতি ওই নেতার বাড়ি গিয়ে মান ভাঙানোর চেষ্টা করেছেন অর্জুন।
আরও পড়ুন: Lok Sabha polls 2019: চাইনিজ-তৃণমূল! ট্যাংরার দেওয়ালে চীনা হরফে ভোটপ্রার্থী মালা
অন্তর্দ্বন্দ্বের চোরা স্রোত বইছে তৃণমূলের অন্দরেও। শাসকদলের এক নেতার কথায়, "কে যে আমাদের সঙ্গে আছে আর কে বিজেপির, তা বোঝাই তো মুশকিল।" ব্যারাকপুর লোকসভার সাতটি বিধানসভার ছ’টিতেই অর্জুনের প্রভাব রয়েছে। সূত্রের খবর, নোয়াপাড়ার বিধায়ক তথা অর্জুনের আত্মীয় সুনীল সিংকে দলের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তৃণমূল। দলের এক প্রয়াত নেতার স্মরণসভাতেও সুনীল যাননি।
জগদ্দল এবং নৈহাটি বিধানসভার কর্মীদের একাংশও অর্জুনের হয়ে কাজ করবেন বলে আশঙ্কা তৃণমূলের। ভাটপাড়ার বিধায়ক অর্জুন নিজেই। বীজপুরের বিধায়ক মুকুল রায়ের পুত্র শুভ্রাংশু রায়। বাহ্যত তৃণমূলে থাকলেও নির্বাচনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সংশয় রয়েছে দলেই। ব্যারাকপুর বিধানসভার বিধায়ক শীলভদ্র দত্ত অসুস্থ। তৃণমূলের শঙ্কা, সেখানেও দল কিছুটা নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। অবাঙালি নেতৃত্বের একাংশ বিজেপির পক্ষে কাজ করতে পারেন।
আরও পড়ুন: ২৪ তারিখের পর অর্জুন সিং কপাল চাপড়াবেন: জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক
ব্যারাকপুরের নির্বাচনে এবার গুরুত্ব বেড়েছে বাহুবলীদের। ২০১৬ সালের বিধানসভায় ভাটপাড়া কেন্দ্রে অর্জুনের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন বাম-কংগ্রেস জোট সমর্থিত নির্দল প্রার্থী, স্ট্রংম্যান হিসাবে পরিচিত জিতু সাউ। অর্জুন বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরদিনই সদলবলে তৃণমূলে গিয়েছেন তিনি। আবার সূত্রের খবর, টিটাগড় এলাকার ‘ত্রাস’ মনীশ শুক্লা এবার অর্জুনের হয়ে কাজ করবেন। কেন গেলেন তৃণমূলে? হোটেল ব্যবসায়ী জিতু বলেন, "অর্জুনকে হারাতেই হবে। ও জিতলে শিল্পাঞ্চলের সর্বনাশ। হিন্দু-মুসলমান, বাঙালী-বিহারী দাঙ্গা হবে। তাই যে ওকে হারাতে পারবে, তার দিকেই গিয়েছি।" মনীশের সঙ্গে বহুবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেন নি।
বাংলার ভোটে সাধারণত জাত-পাতের অঙ্ক কাজ করে না। কিন্তু এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ব্যারাকপুর। অর্জুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি অবাঙালী এবং উচ্চবর্ণের হিন্দু ভোট সংগঠিত করছেন। এর পাল্টা দিতে তৃণমূলের ভরসা মুসলিম এবং ‘সাউ’ ভোট। এক তৃণমূল নেতার কথায়, "ভাটপাড়া, জগদ্দলে সিং বনাম সাউ বিরোধ বহুদিনের। অর্জুনের নিজের বিধানসভায় প্রায় হাজার পঞ্চাশ সাউ কোনওভাবেই বিজেপিকে ভোট দেবে না।"
সিপিএম প্রার্থী গার্গী চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, "তৃণমূল আর বিজেপি ধর্ম, জাতপাতের নামে মানুষকে ভাগ করছে। আমরা যদি গতবারের ভোট ধরে রাখি, জয় নিশ্চিত।" পিছিয়ে থাকা সিপিএমের ভরসা ব্যারাকপুর লোকসভার অর্ন্তগত সাতটি বিধানসভার একমাত্র গ্রামীণ কেন্দ্র আমডাঙা। সেখানে তৃণমূলের প্রতিপক্ষ সিপিএম-ই। বাম নেতাদের অঙ্ক হল, অর্জুন বিজেপিতে যাওয়ায় দক্ষিণপন্থী ভোট এবং মেশিনারি ভাগ হবে, তাই নিজেদের ভোট ধরে রাখতে পারলে লড়াই সম্ভব।
আপাতত রাজ্য বিজেপিতে মূল দ্বন্দ্ব মুকুল রায় বনাম দিলীপ ঘোষের। একদা মুকুলের ঘোর প্রতিপক্ষ অর্জুন রাজনীতির সিঁড়িভাঙা অঙ্গে এখন 'মুকুলের লোক'। জগদ্দলের শ্রমিক ভবনে বসে অর্জুন বলছেন, "আমি জিতবই। আমার প্রতিপক্ষরা ভয় পেয়েছে, তাই একজোট হচ্ছে। কিন্তু অর্জুন সিংকে ওরা চেনে না। আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না।" বাহুবলী বিতর্ক নিয়ে কী বলবেন? চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অর্জুনের জবাব, "কীসের বাহুবলী! মানুষ আমায় ভালবাসেন, তাই পাশে আছেন। এতদিন ওদের এসব মনে হয়নি! এখন কি ঘুম ভেঙে জেগে উঠল?"