'ওঁকে তৈরি করব বলে সব নষ্ট করে জীবন দিয়েছিলাম। উনি তো আমার পরিবারের অভিভাবক ছিলেন। আমার পদক্ষেপে কোথাও ভুল হলে, তিনি আমায় ডেকে কথা বলতে পারতেন, জিজ্ঞাসা করতে পারতেন। সে সব না করে উনি রাজনীতি করলেন', বাহাত্তর ঘণ্টা আগে প্রাক্তন হয়ে যাওয়া দলনেত্রীর উদ্দেশে এক নিশ্বাসে সখেদ মন্তব্যগুলি করে গেলেন কলকাতার প্রাক্তন মহানাগরিক শোভন চট্টোপাধ্যায়। অভিমান-ক্ষোভ এতটাই প্রবল যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে একটিবারও 'দিদি' শব্দটি উচ্চারণ করলেন না বিগত ৪০ বছর ধরে কালীঘাটে ভাইফোঁটা নেওয়া কানন। কেন ছাড়লেন তৃণমূল, দেবশ্রীকে কেন এত অপছন্দ, বিজেপি-তে কী হবে তাঁর গেমপ্ল্যান- সব প্রশ্নেই সোজা ব্যাটে উত্তর দিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়।
বিজেপিতে কেমন লাগছে?
তিন দিন হল যোগ দিয়েছি বিজেপিতে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আলাপ হল। নাড্ডাজির (জে.পি. নাড্ডা) সঙ্গে কথা হয়েছে। অরবিন্দ মেননজি সেদিন (যোগদানের দিন) সব জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমাদের আলাপ করিয়ে দিয়েছেন। অরুণ সিংজি, শিব প্রকাশজির সঙ্গেও কথা বলেছি। খুবই হৃদ্যতার আবহে সবার সঙ্গে কথা হয়েছে। দিলীপ ঘোষের সঙ্গেও কথা হয়েছে। বিজেপি যতই সর্বভারতীয় দল হোক, আমাকে তো মূলত রাজ্য স্তরেই কাজ করতে হবে, তাই...। দিলীপবাবুর আন্তরিকতা আমার খুব ভাল লেগেছে। আর সে কারণেই আমি সিদ্ধান্ত (বিজেপিতে যোগদানের) নিয়ে ফেলি।
তৃণমূলকে মিস করছেন?
না, না, মিস করার কিছু নেই। যে অ্যাটিটিউড ছিল, যা দেখেছিলাম, তা আর এখন নেই। ৪০ বছরের অ্যাটাচমেন্ট ছিল। যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বা তৃণমূলকে তৈরি করেছিলাম, তা পথ হারাচ্ছে। মমতা যখন কংগ্রেসে ছিলেন, আমি তো তখন থেকেই ছিলাম। সে সময় নানা শঙ্কা, প্রাণহানিকে সামনে রেখে কাজ করেছিলাম। আজ সেই তৃণমূল মনে হয় চলতে চলতে পথ হারাচ্ছে। সাম্মানে আঘাত পেয়েছি। বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গায় ধাক্কা দেওয়া হয়েছে। তাই একসঙ্গে চলা যাবে না বলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মেয়র বা মন্ত্রীপদ আমার কাছে কিছু নয়। ওটা সেকেন্ডারি। রাজনীতির আঙিনায় নিজের সম্মান, বিশ্বাসযোগ্যতা সবার আগে। তাই সেদিন পদত্যাগ করে দিয়েছিলাম। ফলে, আর মিস করার কিছুই নেই।
আরও পড়ুন: পদ্ম কাননে শোভন-বৈশাখী
পুরানো সেই দিনের কথা: শোভন-মমতা। ছবি: টুইটার।দিদির কানন ছিলেন আপনি...
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্ক যেমন ছিল, তেমনই গত ২২ নভেম্বরের পর থেকে কোনও বাক্যালাপও হয়নি। এর প্রধান কারণ, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতাম, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়েছি। ওঁর থেকে যে ব্যবহার পেয়েছি, তা দুর্ভাগ্যজনক। আমাকে আঘাত দিয়েছে। ব্যাপারটা দল পরিচালনার পক্ষেও পরিপন্থী। তাই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি।
মিটমাট হতে পারত তো?
কেউ যদি ঘুমোয় তাকে জাগানো যায়। কিন্তু কেউ যদি জেগে ঘুমোয়, চোখ না খুলতে চায়, তাকে তো ঠ্যালা দিয়েও ওঠানো যাবে না। আপনারা বাইরে থেকে দেখে হয়ত অনেক স্পেকুলেশন করছেন বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও অনেক স্পেকুলেশন করেছেন, কিন্তু এর সঙ্গে বাস্তবের কোনও মিল ছিল না। যে আচরণ উনি করেছেন, যা সব উনি বলেছেন, মন্ত্রগুপ্তির শপথের মতো থাকায় সেসব কথা আমি বলতে পারব না। যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও দিন পরিষ্কার করে বলেন, তাহলে আমিও বলব সব, সেই জায়গাটা আসছে না বলেই এত বিভ্রান্তি! কোনও মিটমাটের রাস্তা যে ছিল না তা সেদিন আপনাদের কাছেও স্পষ্ট হয়ে যাবে।
আপনি বিজেপি-তে যোগ দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতিকদের পারিবারিক-সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলেছিলেন। অনেকে বলছে, নাম না করে উনি সেদিন আপনাকেই নৈতিকতার পাঠ দিয়েছেন। কী বলবেন?
উনি পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা বলছেন! অথচ ২ বছর আগে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পারিবারিক বিষয় জানিয়েছিলাম, উনি নিজেই আমাকে বাড়ি ছাড়তে বলেছিলেন। আরে উনি তো আমার পরিবারের অভিভাবক ছিলেন। আর আজ এসব কথা বলছেন! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা নাম, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, তবুও ওঁকে বলব, ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। চেনা মমতাকে পাল্টাতে দেখেছি। যদি কোনও জায়গায় ওঁর মনে হত যে আমার পদক্ষেপে কোথাও ভুল হচ্ছে, তাহলে তিনি তো ডেকে কথা বলতে পারতেন, জিজ্ঞাসা করতে পারতেন। উনিই তো অভিভাবক ছিলেন। আমি তো ওঁকে তৈরির জন্য সব নষ্ট করে আমার জীবন দিয়েছিলাম। কিন্তু, জিজ্ঞাসা করার মানসিকতা না দেখিয়ে পরিবার নিয়ে যে রাজনীতি করেছেন, তার শালীনতা কি উনি বিচার করবেন? ওঁর কাছ থেকে পরবর্তীকালে অভিভাবকের আচরণ পাইনি। ওঁর শোনার মতো মানসিকতা ছিল না। তাই নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে মেয়র পদে থাকব না বলেই পদত্যাগ করেছিলাম।আরও পড়ুন: কাননকে নৈতিকতার পাঠ দিলেন ‘দিদি’
মমতার হাতে ভাইফোঁটা মিস করেন?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে কালীপুজো হয়। চল্লিশ বছর সেখানেই সময় কাটিয়েছি। পুজোতে আমি কী করতাম তা আমি জানি। কিন্তু, পারিবারিক কারণে বিচ্ছেদ মামলা চলছে আমার। যখন দেখলাম, যার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য এবং বাড়ি ছেড়ে আসার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমায় পরামর্শ ও নির্দেশ দিয়েছিলেন অন্য বাড়িতে থাকতে, তাকে সামনে রেখেই পুজো হচ্ছে, তখন আমি মাঝ পথ থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। অথচ উনিই (মমতা) বলেছিলেন, কীভাবে রত্না চট্টোপাধ্যায় আমার জীবনে বিপদ আনতে পারে, আমি খুন হয়ে যেতে পারি, আমার জীবনহানির আশঙ্কা করেছিলেন, তবু তাকে সামনে রেখেই কালীপুজো হল, ফলে আমি ফিরে এলাম। আর ভাইফোঁটায় তিনি আর আমায় ডাকেননি, হয়তো মনে করেছেন, ভাই হিসেবে যা থাকা দরকার তা আমার নেই। তাই যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
তৃণমূলের কেউ যোগাযোগ করেছেন আপনার সঙ্গে?
তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে এমন জেলা স্তরের এবং কলকাতার বহু নেতা আমায় বলেছেন, তাঁরা বিজেপিতে শামিল হয়ে আমার সঙ্গে কাজ করতে চান। আমি ভাবতেও পারিনি যে এত সাড়া পাব। আগামী দিনে তাঁদের নিয়ে রাজনৈতিক প্রাঙ্গণ তৈরি করে নিশ্চয়ই লড়াই করব আমি। সেই প্রস্তুতিই এখন নিচ্ছি।
আরও পড়ুন: শোভনের পর তৃণমূল ছেড়ে ‘যাব যাব’ করছেন কোন নেতা? জানিয়ে দিলেন ভারতী ঘোষ!
দেবশ্রী রায়কে নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন...
(প্রশ্ন শেষ না করতে দিয়েই) দেবশ্রী রায়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিন ধরে কোনও যোগসূত্র নেই। উনি বিধানসভার সদস্য ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না। নিশ্চয়ই আপত্তি জানানোর বিষয় ছিল, তাই জানিয়েছি। আমার পারিবারিক বিষয়ে দেবশ্রী রায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। সে বিষয়ে প্রমাণও রয়েছে আমার কাছে। প্রয়োজনে যথা সময়ে সামনে আনব। আসলে সেদিন একটা শিডিউল ঠিক করা হয়েছিল। আমার, বৈশাখীর যোগদান করার কথা ঠিক হয়েছিল। এটা গুলিয়ে দেওয়ার জন্য কেউ হয়ত শামিল হয়েছিলেন। তাই আপত্তি জানিয়েছিলাম। কিন্তু বিজেপির কেউ এতে জড়িত নন বলে তাঁরা আমায় জানিয়েছেন।
আপনি বলেছেন, দেবশ্রী রায় ভবিষ্যতে বিজেপি-তে যোগ দিলেও আপনি দল ছাড়বেন! কোনও সিরিয়াস রাজনীতিকের মুখে এ কথা মানায়?
(খানিকটা উত্তেজিত) দেখুন, সামনের দিনে সব দেখতে পাবেন। এরকম কিছু হলে, তখন আমার কী পদক্ষেপ হবে তা দেখতেই পাবেন।
দিলীপ ঘোষ দেবশ্রী প্রসঙ্গে বলেছিলেন, বাজার থেকে অনেক জিনিস কিনলেও সবটা রান্না হয় না। অনেক কিছু ফ্রিজেও থাকে। কী বলবেন?
দেখুন, দিলীপবাবু ঠিক কী বলেছেন তা শোনার সুযোগ হয়নি আমার। তবে কোনটা ভাল রাখার জন্য ডিপ ফ্রিজে রাখবেন না কি পচাবার জন্য, সেটা তাঁরাই বলতে পারবেন। আমি কিছু বলব না।
আরও পড়ুন: উনি যেদিন আসবেন, সেদিনই বিজেপি ছাড়বেন শোভন: বৈশাখী
বিজেপিতে কী গেমপ্ল্যান?
তৃণমূলে ৪২টি বিধানসভার দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছিলাম, এর মধ্যে ৪০টিতেই জিতেছি। তৃণমূল হয়তো সে কথা মনে রাখেনি। তাছাড়া, কলকাতা শহরে গত ৩৫ বছর ধরে জনপ্রতিনিধিত্ব করছি। বিভিন্ন স্তরে কাজ করেছি। আমি ঝাড় দিতে দিতে কলকাতার মেয়র হয়েছিলাম। এরপর ৮ বছর কলকাতা পুরসভা পরিচালনা করেছি। ফলে আমি জানি, কোথায় সাংগঠনিকভাবে কাজে লাগতে চাই এবং কাজে লাগতে পারি। সে বিষয়টা দলের (বিজেপি) অভ্যন্তরে আলোচনা করব। এরপর দল যা কাজ দেবে, সেটাই করব। সকলের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করব। সবে সদ্যোজাত শিশু। হাঁটতে চলতে দিন, তারপর দেখবেন কীভাবে হাঁটছি।
সম্প্রতি একটি কর্মসূচিতে মমতা বলেছেন, ‘‘রত্নাকে দলে গুরুত্ব দাও’’, কলকাতা পুর নির্বাচনে রত্না মেয়র পদপ্রার্থী হতে পারেন বলে জল্পনা।
(প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়েই) কে? কে মেয়র হবেন?
রত্না, রত্না চট্টোপাধ্যায়ের নাম নিয়েই জল্পনা।
(হাঃ...হাঃ করে হাসলেন)। হাসতে হাসতেই বললেন, হাসালে বালক তুমি বাক্যের কৌশলে।
মুকুল রায়ের সঙ্গে কী কথা হল?
কথা বলার তেমন সুযোগ হয়নি। তবে অবশ্যই কথা হবে।
মোদী-শাহের সঙ্গে দেখা করছেন কবে?
বিজেপি করছি, আগামী দিনে নিশ্চয় প্রধানের সঙ্গে দেখা হবে, যেরকম বলবেন, তেমন কাজ করব।
তৃণমূলের নির্বাচনী স্ট্র্যাটেজিস্ট প্রশান্ত কিশোর, কী বলবেন?
প্রশান্ত কিশোর একজন ঠিকাদার কর্মী ছাড়া আর কিছু নন। একটা ঠিকাদার সংস্থার হাতে তৃণমূলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া মানেই বোঝা যাচ্ছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর আস্থা রাখতে পারছে না কেউ। মমতার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের অনেক সম্পদ (কর্মী অর্থে) রয়েছে, আর সেখানে প্রশান্ত কিশোরের জন্য এত টাকা খরচ করা হচ্ছে! ভাবতেই পারছি না।