সংসদে বড় ধরণের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনায় নাম জড়িয়েছে বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহার। কেন? জানা গিয়েছে বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) লোকসভার কক্ষে যে দু’জন প্রবেশ করেছিলেন এবং হলুদ ধোঁয়া বের করার ক্যানিস্টার খুলেছিলেন, তাঁদের কাছে বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহার অনুমোদন পাস ছিল।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে অভিযুক্তদের একজন মনোরঞ্জন ডি, সহ-অভিযুক্ত সাগর শর্মাকে এমপির অফিসে বন্ধু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। নতুন সংসদ ভবন দেখার অজুহাতে তাঁদের পাস ইস্যু করা হয়েছিল। এই ঘটনা সামনে আসতেই হুলস্থূল পড়ে যায়। বিরোধী নেতারা সাংসদ প্রতাপ সিমহাকে বহিষ্কারের দাবি করেছেন এবং সংসদের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের জন্য তাকে দায়ি করেছেন। এদিকে লোকসভার তরফে গোটা ঘটনার যথাযথ তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে । প্রাথমিক তদন্তে জানা গিয়েছে ‘ক্যানিস্টার’ থেকে নির্গত ধোঁয়া “নিরাপদ” এবং “চিন্তার কোন কারণ নেই”। এমনটাই জানিয়েছেন লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা।
সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, সংসদের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত অভিযুক্ত পঞ্চম ব্যক্তিকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল সংসদের নিরাপত্তা লঙ্ঘনের ঘটনায় পঞ্চম সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করেছে। ঘটনাটি, এমন এক দিনে ঘটে, ২০০১ সালের সেই দিনেই সংসদ ভবনে হামলার ঘটনা ঘটেছিল। এই দিনই ছিল সংসদে হামলার ২২ তম বার্ষিকী। গোটা ঘটনায় মোট ৬ জন যুক্ত ছিলেন। এমনটাই জানানো হয়েছে দিল্লি পুলিশের তরফে।
সূত্রের খবর, আটক চারজন ছাড়াও আরও দু'জন এই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ছিল। পাঁচজনকে শনাক্ত ও ধরা পড়লেও ষষ্ঠজন এখনও পলাতক। দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল, গোটা ঘটনার তদন্ত করছে। অনুপ্রবেশ, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, বাধা, দাঙ্গার উদ্দেশ্যে উস্কানি এবং কঠোর বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন (ইউএপিএ) সহ বিভিন্ন ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে।
জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্তরা জানায় যে তারা সবাই সোশ্যাল মিডিয়ায় 'ভগত সিং ফ্যান ক্লাব'-এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তারা প্রায় দেড় বছর আগে মাইসুরুতে দেখা করেছিলেন এবং পরে তাদের পরিকল্পনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সিআরপিএফ ডিজি অনীশ দয়াল সিংয়ের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে যাতে নিরাপত্তার ত্রুটির তদন্ত করা হয় এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা রোধ করার জন্য ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়।
একজন অনুপ্রবেশকারীর ব্যবহৃত ভিজিটর পাসটি বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমার নামে ইস্যু করা হয়েছিল। সিমা পরে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে অভিযুক্তের বাবার অনুরোধের পরে তিনি পাসটি জারি করেছিলেন।
সিমহা স্পিকারকে বলেছিলেন যে অভিযুক্তের বাবা সাগর শর্মা তার নির্বাচনী এলাকা মাইসুরুতে থাকেন এবং নতুন সংসদ ভবন দেখার জন্য পাসের অনুরোধ করেছিলেন। সাংসদ আরও বলেন, তিনি তার ব্যক্তিগত সহকারী এবং তার অফিসে ক্রমাগত যোগাযোগ করছেন যাতে সাগর শর্মা সংসদে যেতে পারে তার একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। সিমহা লোকসভার স্পিকারকে জানিয়েছিলেন যে তিনি যে তথ্য তুলে ধরেছেন তা ছাড়া তার কাছে অতিরিক্ত তথ্য নেই।
সাগর শর্মা প্রতাপ সিমার নামে ইস্যু করা একটি ভিজিটর পাস ব্যবহার করে লোকসভায় প্রবেশ করেছিলেন একথা প্রকাশ্যে আসতেই কংগ্রেস কর্মীরা মাইসুরুতে তাঁর অফিসের বাইরে বিক্ষোভ দেখান। কংগ্রেসও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে সংসদের নিরাপত্তা ইস্যুতে কটাক্ষ করেছে। কংগ্রেস সাংসদ অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেন, এই ঘটনা প্রমাণ করে আমাদের যতটা সতর্ক হওয়া উচিত ছিল, আমরা ততটা সতর্ক ছিলাম না? আমাদের সাংসদরা অনুপ্রবেশকারীদের ধরেছে… নিরাপত্তাকর্মীরা কোথায় ছিল সেই প্রশ্নও তুলেছেন তিনি।
লোকসভার নিরাপত্তার গাফিলতি প্রসঙ্গে সমাজবাদী পার্টির সাংসদ ডিম্পল যাদব বলেন, ‘এটি নিরাপত্তা ব্যবস্থার সম্পুর্ণ ত্রুটি। আজ হাউসের ভেতরে যে কোন কিছুই ঘটতে পারত… এখানে যারাই আসেন – তারা দর্শক হোক বা সাংবাদিক, কারও কোন ট্যাগ নেই! সরকারকে এ দিকে নজর দেওয়া উচিত’।
কীভাবে সংসদে ভিজিটর পাস জারি করা হয়?
লোকসভার কার্যপ্রণালী এবং ব্যবসা পরিচালনার নিয়মের বিধি ৩৮৬ দ্বারা সংসদে দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত হয়। সংসদে ‘অপরিচিতদের প্রবেশ এবং অপসারণ’ বিধি অনুযায়ী, স্পিকারের আদেশে, ‘বৈঠকের সময় অপরিচিতদের প্রবেশ করার পর সভার কোন অংশগুলো নিয়ন্ত্রিত হবে’, তা ঠিক হয়। MN Kaul এবং SL Shakdher-এর লেখা, ‘সংসদের অনুশীলন এবং পদ্ধতি’ অনুসারে, ‘একজন সদস্য শুধুমাত্র তাঁদের জন্য ভিজিটর কার্ড ইস্যু করার আবেদন করতে পারেন, যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে ওই সদস্যের খুব পরিচিত। ভিজিটর কার্ডের জন্য আবেদন করার সময়, সদস্যদের একটি শংসাপত্রও দিতে হয় যে, ‘ওই দর্শনার্থী আমার আত্মীয়/ব্যক্তিগত বন্ধু/আমার ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত এবং আমি তার/তার জন্য সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছি।’ নিরাপত্তার কারণে দর্শনার্থীদের সঙ্গে ছবি-সহ পরিচয়পত্র বহন করতে হয়।
নিয়ম বলছে, ‘দর্শকদের পুরো নাম লিখতে হয়। শুধু আদ্যক্ষর লিখলে হয় না। একজন দর্শনার্থীর পিতা/স্বামীর নামও সর্বদা সম্পূর্ণ লিখতে হয়।’ একই নিয়ম চালু আছে রাজ্যসভাতেও। বিধি অনুযায়ী, ‘একজন সদস্য ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত এমন ব্যক্তির জন্য ভিজিটর কার্ডের আবেদন করতে পারেন বা নির্বাচিত ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তিদের জন্য ভিজিটর কার্ডের আবেদন করতে পারেন, যাঁরা ওই সদস্যের সঙ্গে পরিচিত, অথবা তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত। তার কারণ, ওই পরিচিতদের প্রবেশ করানোর জেরে সম্পূর্ণ দায়ভার সদস্যদেরকেই নিতে হয়।
উল্লেখযোগ্যভাবে, বিধি অনুযায়ী, ‘সদস্যদের মনে রাখতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে তাঁরা এই ধরনের সদস্যপদের অনুরোধে জারি করা কার্ডধারী ব্যক্তিদের ঘটানো গ্যালারিতে যে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য দায়ী থাকবেন।’ এই ক্ষেত্রে, মনোরঞ্জন ডি-এর বাবা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেছেন যে যেহেতু প্রতাপ সিমহা তাঁদের স্থানীয় এমপি, তাই তাঁদের সঙ্গে সিমহার ভালো সম্পর্ক রয়েছে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই অনুযায়ী, সিমহার অফিস সাফাইয়ে জানিয়েছে, সাংসদরা সাধারণত তাঁদের নির্বাচনী এলাকার সদস্যদের থেকে এই ধরনের ভিজিটর কার্ড ইস্যু করার অনুরোধ পেয়ে থাকেন। সেই কারণেই কার্ড ইস্যু করা হয়েছিল।