Advertisment

বাঙালিয়ানার জটিল ধাঁধায় পদ্মশিবির

অন্য রাজ্যের ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব বেড়েছে এই রাজ্যে। এখন রাজ্যের আনাচে-কানাচে হনুমান মন্দিরও গড়ে উঠছে। তবে গেরুয়া বাহিনীর বোধদয় হয়েছে মা উমার মর্তে আগমন নিয়ে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
tmc, bjp, তৃণমূল, বিজেপি

বিধানসভা ভোটের কথা মাথায় রেখে বিজেপি তৈরি করছে রণকৌশল

সন ২০১৫। দক্ষিণ ২৪ পরগণার রায়চকে বসেছিল বিজেপির চিন্তন বৈঠক। নামীদামি হোটেলে সেই বৈঠকের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু খাবারের মেনু দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়েছিল বঙ্গ বিজেপি নেতৃত্বের একাংশের। বিস্মিত হয়েছিলেন আরও অনেকেই। দু-দিনের বৈঠকে খাবারের মেনুতে ছিল নিরামিষ আহার। কেন আমিষ নয়? সেদিন এই প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়েছিলেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। আম বাঙালির পছন্দের মেনুতে মাছ পর্যন্ত নেই, যেখানে হরেকরকমের মাছ রয়েছে বাজারে। এই ঘটনা নিয়ে দলের অভ্যন্তরে চরম বিতর্ক হয়েছিল।

Advertisment

সেদিনের চিন্তন বৈঠকের ঘটনা যে সুচিন্তিত মস্তিকের ফসল, তা নিয়ে অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনার চেষ্টা হলে বুমেরাং হতে পারে, তা অনুধাবন করছে গেরুয়া শিবির। বাঙালিয়ানা প্রমাণ করতে তাই পরবর্তী অনেক ক্ষেত্রে মেনুতে মাছ-ভাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাও উপলব্ধি করেছেন দলের নেতৃত্ব।

তবে শুধু খাদ্যাভ্যাসে নয়, দল নানা ক্ষেত্রে এখনও বাঙালিয়ানা প্রশ্নের সম্মুখীন। বাংলা ভাষা ব্রাত্য, এই নিয়েও অভিযোগ রয়েছে গেরুয়া শিবিরের বিরুদ্ধে। বাংলা কথার মাঝে হিন্দী বলাটাও এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিন্দি বলতে গিয়ে মুখ বেঁকে গেলেও, হাসির খোরাক হলেও বলার চেষ্টার কসুর করেন না কেউ কেউ। এতে নাকি দিল্লীর কাছে নম্বর বাড়ে। অবশ্য শনিবার হিন্দি ভাষা দিবসে অমিত শাহর ঘোষণার পর এসব অভ্যাস আরও বাড়বে বলেই ধারনা অভিজ্ঞ মহলের। তার ফল কি দাঁড়াবে তা সময় বলবে।

আরও পড়ুন: ‘দিদিকে মেরেছে…দিদিকে মেরেছে, মমতা তখন রক্তাক্ত’

আইএএস বা আইপিএস ক্যাডাররা যে ভাষাভাষীই হোন না কেন, তাঁদের কর্মক্ষেত্র যে রাজ্য, সেখানকার ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক। রাজনীতির ক্ষেত্রে ঠিক এর বিরোধী চিত্র দেখতেই আমরা অভ্যস্ত। তবে মাতৃভাষা নিয়ে বাঙালির একটা বড় অংশের উন্নাসিকতা রয়েছে, তাও মানতে হবে। তাঁরা অবশ্য হিন্দী নয়, ইংরেজী ভাষার দিকে ঝুঁকে রয়েছেন। 'স্ট্যাটাস' বলে কথা! একদিকে হিন্দী ভাষার আগ্রাসন ও অন্য দিকে ইংরেজীর টান, এই দুইয়ে মিলে বাংলা ভাষার প্রাণ ওষ্ঠাগত।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজরে আসতে বঙ্গ বিজেপি নেতাদের একাংশের হিন্দীতে কথা বলার কসুরের শেষ নেই। অভিজ্ঞ মহলের মতে, মাতৃভাষার ভাবাবেগে আঘাত লাগলে সাধারণ মানুষের গেরুয়া প্রীতি হোঁচট খেতে পারে। অন্য ভাষা শিখতে আপত্তি নেই, তবে ভাষা চাপিয়ে দিলে ফল মারাত্মক হতে পারে। এমনিতে 'গুটখা' সংস্কৃতি নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-মন্ত্রীরাও সোচ্চার। বিজেপির অভ্যন্তরেও এসব নিয়ে গুঞ্জন চলছে।

হনুমান জয়ন্তী, রামনবমী ইত্যাদি গেরুয়া শিবিরের ঘোষিত কর্মসূচি। সংঘ পরিবার এই কর্মসূচি পালনের জন্য রীতিমত দলের অভ্যন্তরে ফতোয়া জারি করে। বিজেপির প্রসারের সঙ্গে এই দুই অনুষ্ঠানও রাজ্যের সর্বত্র বেড়ে চলেছে। একইসঙ্গে এবার রাজ্যে রেকর্ড সংখ্যক গণেশ পুজো হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবে অন্য রাজ্যের ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাব বেড়েছে এই রাজ্যে। এখন রাজ্যের আনাচে-কানাচে হনুমান মন্দিরও গড়ে উঠছে। তবে গেরুয়া বাহিনীর বোধদয় হয়েছে মা উমার মর্তে আগমন নিয়ে। এবার আর দুর্গাপুজোকে উপেক্ষা করার সাহস দেখাচ্ছে না বিজেপি।

আরও পড়ুন: অগ্নিকন্যা থেকে ‘প্রশান্ত’, মমতার ভোলবদল!

দিল্লীতে রাজ্য শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে অমিত শাহর বৈঠকে যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে বাংলার দুর্গাপুজো। সর্বভারতীয় সভাপতি দুর্গাপুজোতে কলকাতায় আসতে পারেন বলে জানিয়েছেন দিলীপ ঘোষ। তৃণমূল কংগ্রেস রাজনীতির ধর্মীয় মেরুকরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে, পাল্টা রামনবমীর অনুষ্ঠান করেছে। তবে নিজেরা দুর্গাপুজো, কালীপুজোর আয়োজনের কথা বলে বিজেপির পুজো সংস্কৃতির বিরোধিতা করে থাকে। তাই কি এবার পুজোর উদ্বোধনে বাংলায় হাজির থাকছেন অমিত শাহ? এই প্রশ্ন রাজনৈতিক মহলের। রাজনীতির কারবারিরা মনে করেন, দুর্গাপুজোর বাইরে বাঙালি পুজো সংস্কৃতির কথা ভাবতেই পারে না। অবশেষে সেই উপলব্ধি হয়েছে বঙ্গ বিজেপির। বিশেষ করে ১৮টি লোকসভা আসনে জয়লাভের পর বিজেপি বুঝতে পেরেছে এই রাজ্যে বিধানসভায় জয় পাওয়া অসম্ভব নয়। পুজো সংস্কৃতিতে নিজেদের ষোলো আনা বাঙালী প্রমাণ করতে তাই মরিয়া পদ্মশিবির।

আরও পড়ুন: ব্যবসা নেই, তবে কি রাজনীতির গন্ধে বঙ্গে ঢুকছেন গণেশ?

বন্দে মাতরমের স্রষ্টা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম দিবস পালন করেছে গেরুয়া বাহিনী। যে সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন অমিত শাহ। রাজনৈতিক মঞ্চে বাংলার মণীষীদের নাম উচ্চারণ করাও স্বভাবে পরিণত করেছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দল যে বাংলার মণীষীদের কথা ভাবে, তা-ও প্রমান করা জরুরি। নেতাজী সুভাষ ইস্যু মাঝেমধ্যেই উসকে দেন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। ঘটা করে ফাইল প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু নেতাজির মৃত্যু রহস্যের কোনও কিনারা হয়নি। তবে লোকসভা ভোটের মুখে অমিত শাহর মিছিলের সময় বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙায় বিতর্কে জড়িয়েছে দল। যদিও মূর্তি ভাঙা নিয়ে বিজেপি ও তৃণমূল একে অপরকে দোষারোপ করেছে। শেষ দফার নির্বাচনে লোকসভার আসনগুলোতে ফলও বেশ খারাপ হয়েছে বিজেপির।

বিজেপির সাংগঠনিক ক্ষেত্রে শহর কলকাতায় অবাঙালিদের প্রভাব প্রশ্নাতীত। এই প্রভাব দক্ষিণেও রয়েছে, তবে উত্তর কলকাতায় একটু বেশি। দলের রাজনৈতিক ব্যানার, পোস্টার দেখলে যে কারও মনে হতে পারে এটা গোবলয়। এমনকী কলকাতায় রাজনৈতিক সভায় বাংলায় বক্তব্য রাখার কেউ থাকেন না। দলের অভ্যন্তরে এই নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। গ্রাম-বাংলায় বিজেপির ফল ভালো হওয়ার পিছনে সধারণের তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রবল ক্ষোভ-বিক্ষোভ কাজ করেছে, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কলকাতার দুই আসনেই কুপোকাত হয়েছে বিজেপি।

বঙ্গে বিজেপির প্রসার বেড়েছে, তা লোকসভার নির্বাচনে প্রমানিত। রাজনৈতিক মহলের মতে, নানা কারণে ভোটাররা লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের শাসকদলের প্রতি ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। তবে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বাঙালি 'সেন্টিমেন্ট'ও একটা বড় ফ্যাক্টর হতে পারে। বাংলা ভাষা, বাঙালির কৃষ্টি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার উৎসব রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এসবেও নজর রয়েছে আপামর বাঙালির। এসব কর্মকান্ডে বিধানসভা ভোটের অঙ্ক তাই আরও জটিল হতে বাধ্য।

tmc bjp
Advertisment