Advertisment

'খারাপ' হতে চান, পারেন না; সময়ের প্রতীক্ষায় অভিষেকের পড়শি সুশান্ত ঘোষ

"আমি যদি সত্যিই এত সন্ত্রাস করে থাকি, কঙ্কাল কাণ্ডে জড়িয়ে থাকি, আমাকে কেন আট বছরেও মমতার সরকার জেলে ঢোকাতে পারল না? কেন ওরা আদালত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে?"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
garbeta susanta ghosh cpm

ভবানীপুরের ফ্ল্যাটে সুশান্ত ঘোষ

দেখা করার জন্য সময় চাইতেই তিনি যেন বিনয়ের অবতার! বললেন, "আমি তো ২২ তারিখ পর্যন্ত প্রায় সর্বক্ষণই ফ্রি আছি, ভাই। আপনি কখন আসতে পারবেন জানান, আমি তৈরি থাকব।" বাম জমানার 'ত্রাস'কে জানানো গেল, তাঁর কলকাতার ফ্ল্যাটে প্রতিবেদকের কখনও যাওয়ার সুযোগ ঘটেনি। দয়া করে যদি পথনির্দেশ দেন, তাহলে আর কাউকে বিব্রত করতে হয় না। শুনেই দরাজ হাসি, "আরে আমি তো এখন অভিজাত এলাকার বাসিন্দা। পাড়া তো নয়, যেন দুর্গ। দিনরাত পাহারা চলছে। যাক গে, ২৩ পল্লীর পুজো প্রাঙ্গনের ঠিক উল্টোদিকে অভিষেকের বাড়ি নিশ্চয় চেনেন, সেখান থেকে ঠিক এক মিনিট।"

Advertisment

বাস্তবে, হাই প্রোফাইল পড়শির বাড়ি থেকে সুশান্তের আস্তানার দূরত্ব এক মিনিটও নয়, পায়ে হেঁটে ঠিক ৪৫ সেকেন্ড। পুরনো আমলের ফ্ল্যাটবাড়ি। জং ধরা লিফটের ঘটাং-ঘট পেরিয়ে তাঁর চারতলায় ফ্ল্যাট, বেল বাজাতেই ভিতর থেকে গলা ভেসে এল, "চলে আসুন, ভাই। দরজা খোলা আছে। দিনের বেলা সাধারণত দরজা খোলাই রাখি।" ভিতরে ঢুকে দেখা গেল, লম্বাটে বসার ঘরে সুশান্ত বসে রয়েছেন। পরণে সাদা গোল-গলা গেঞ্জি আর লুঙ্গি। দলীয় মুখপত্রের এক প্রতিনিধির সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন 'কঙ্কাল-কাণ্ডে' অভিযুক্ত। পুরনো বক্স টিভি চলছে, মিউট করা। সেখানে বক্তৃতারত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক ঝলক দেখে নিয়ে সুশান্ত হাসলেন, "রোদ থেকে এসেছেন, জল খান। দাঁড়ান, একটু ঠান্ডা জল মিশিয়ে দিই।"

আরও পড়ুন: আমি চাই: মমতা-কানহাইয়া প্রধানমন্ত্রী হোন, জিতুক নকশালরাও

প্রায় তিন দশকের বিধায়ককে ব্যস্ত না হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রশ্ন করা গেল, নির্বাচনের ভরা বাজারে ভবানীপুরের ফ্ল্যাটে বন্দি হয়ে থাকতে ভাল লাগছে? সুশান্তের উত্তর, "বন্দী হয়ে থাকব কেন! এই ফেজটা গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ব প্রচারে। এই তো ২২ তারিখ থেকে রোজ বেরোতে হবে। একটার পর একটা জেলা থেকে কমরেডরা ডাকছেন। সময়ই পাব না।" এখনও তাঁর এত চাহিদা! কারণ কী? সুশান্ত ফের বিনয়াবনত, "কমিউনিস্ট পার্টির আমি একজন কর্মী মাত্র। আমাদের দলে ব্যক্তির কোনও গুরুত্ব নেই। দলই সব। দলের নির্দেশেই প্রচারে যাচ্ছি। দল যা বলবে তাই করব।"

কিন্তু তাঁর জন্য দলের ভাবমূর্তির কি ক্ষতি হয়নি? বাম জমানার পতনের জন্য সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড় যেমন দায়ী, তেমনই গড়বেতা-সহ মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সুশান্তর 'লাল সন্ত্রাস' কি কোনও ভূমিকা পালন করে নি? প্রায় তিন দশকের বিধায়ক রাগলেন না। একবার জল খেলেন। মুখ মুছলেন। তারপর গুছিয়ে বসে বললেন, "সন্ত্রাস শব্দটা অনেকবার শুনেছি। একঘেয়ে হয়ে গিয়েছে। আচ্ছা, বলুন তো, আমি যদি সত্যিই এত সন্ত্রাস করে থাকি, কঙ্কাল কাণ্ডে জড়িয়ে থাকি, আমাকে কেন আট বছরেও মমতার সরকার জেলে ঢোকাতে পারল না? কেন ওরা আদালত থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? কাগজপত্র জমা করতে পারছে না কেন?"

আরও পড়ুন: কেন বামপন্থী এই লোকসভা নির্বাচন

একটু থামলেন। অতিথিকে মিষ্টি অফার করলেন। তারপর ফের জলে চুমুক দিয়ে বললেন, "আসলে কী জানেন, পুরোটাই 'বনাওয়াট'। বানানো গল্প। মিথ্যা প্রচার। যেনতেন প্রকারেণ বামফ্রন্ট সরকারটাকে সরাতে চাইছিল ওরা। তাই নাৎসিদের কায়দায় এমন প্রচার করেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত ওরা জিততে পারবে না। আমরা আবার আসব। হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু আসব।" বলেন কী মশাই! প্রতিদিন আপনাদের ভোট কমছে! কর্মীরা হয় তৃণমূলে, নয়তো বিজেপিতে যাচ্ছে। এবারের ভোটে অধিকাংশ সমীক্ষাই আপনাদের একটিও আসন দেয়নি। আর আপনি বলছেন বামেরা আবার আসবে? সুশান্ত এবার ঈষৎ উত্তেজিত। বললেন, "সমুদ্রে যান নি কখনও? জোয়ার ভাঁটা দেখেন নি? রাজনীতিতেও তেমন। চিরন্তন জোয়ার বলে কিছু নেই। ভাঁটা আসবেই।"

আলিমুদ্দিন সূত্রের খবর, দলীয় নেতৃত্বের উপর তাঁর নাকি ক্ষোভের অন্ত নেই। বিশেষত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে নাকি তিনি দু'চক্ষে দেখতে পারেন না। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি নাকি বলেছেন, "ওই লোকটার জন্য রাজ্যের সর্বনাশ হল। দলটা শেষ হয়ে গেল।" সিপিএমের এক রাজ্য কমিটির সদস্য বলছিলেন, "নেতাইয়ের ঘটনার পর বুদ্ধবাবুর মন্তব্য শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল সুশান্ত। বলেছিল, 'আমাদের কর্মীরা মাওবাদী আর তৃণমূলের সঙ্গে জীবন বাজি রেখে লড়ছে, আর উনি বলে দিলেন ভুল হয়েছিল! কীসের ভুল, কার ভুল! ভুল তো হয়েছিল সরকার, পুলিশ আর প্রশাসনের। তার দায় কে নেবে?'"

বর্তমান রাজ্য নেতৃত্ব সম্পর্কেও নাকি তিনি বীতশ্রদ্ধ। ঘনিষ্ঠ মহলে প্রায়শই নাকি বলেন, "আমাদের কর্মীর অভাব নেই। তারা মারতে এবং মরতে প্রস্তুত। কিন্তু নেতৃত্বেরই তো জোর নেই। আমরা আদৌ একটা জীবন্ত পার্টি? এভাবে কমিউনিস্ট পার্টি বাঁচে?" এক সিপিএম নেতা জানিয়েছিলেন, বছরখানেক আগে সুশান্ত রাজ্য নেতৃত্বকে লোকসভা নির্বাচন নিয়ে নিজের পরিকল্পনা পাঠিয়েছিলেন। তাতে বলেছিলেন, গোটা রাজ্যের ৮-১০টা কেন্দ্র বেছে নেওয়া হোক। তারপর তার প্রতিটি ব্লকে শাসকদলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের তালিকা তৈরি করে নাম-সহ লিফলেট বিলি করা হোক। ভোটের ঠিক সপ্তাহখানেক আগে এই কেন্দ্রগুলির মধ্যে কয়েকটি থানার এলাকায় হাজার হাজার লোক নিয়ে দলের পতাকা ছাড়া এমন নেতাদের বাড়ি ঘেরাও করুক সিপিএম। থানায় জঙ্গী বিক্ষোভ হোক।

ওই নেতার কথায়, "সুশান্তদা বলছিলেন, এই কয়েকটা ঘটনার খবর আগুনের মতো ছড়াত। বিভিন্ন কেন্দ্রে যে নেতাদের নাম লিফলেটে ছিল, তাঁরা বাড়ি ছেড়ে পালাতেন জনরোষের ভয়ে। কিন্তু কিছুই তো হল না।" কংগ্রেসের সঙ্গে জোট না করা নিয়েও নাকি বিরক্ত সুশান্ত। ঘনিষ্ঠদের বলেছেন, যে পুরুলিয়া আসনের জন্য জোট হল না, বামেরা সেখানে চতুর্থ হবে। কিন্তু প্রকাশ্যে এখন এসব নিয়ে একটি কথাও বলতে রাজি নন 'স্ট্রংম্যান।' কেন? সুশান্তের এক ঘনিষ্ঠ বলেন, "উনি আপদমস্তক পার্টিজান। ভোটের সময় এমন কিছু বলবেন না, যাতে দলের কর্মীরা হতাশ হয়।"

আরও পড়ুন: আগামী সরকার হোক অনিশ্চিত সরকার

বিকেল ক্রমশ মিশে যাচ্ছে সন্ধ্যায়। বাইরের ঘর থেকে ভিতরের ছোট্ট ঘরে গেলেন সুশান্ত। লাল রঙের টেবিল আর ছোট্ট বিছানা। মাথার কাছের টেবিলে দিস্তে দিস্তে কাগজ। এসব কী? সুশান্ত যেন একটু লজ্জা পেলেন এবার, " বই লিখছি, বুঝলেন? মানে অনেক দিন তো হল, একটু গুছিয়ে লিখছি সব।" আপনার একটা বই তো বেরিয়েছে। সেখানে পার্টি নেতৃত্বকে তীব্র সমালোচনা করেছেন। দল কিছু বলে নি? 'পার্টিজান' সুশান্ত হাসছেন। বোঝা গেল উত্তর দেবেন না। বললেন, "চা খাবেন? চা বলি?" চা এল, সঙ্গে বিস্কুট। আপনি খাবেন না? সুশান্ত বললেন, "আমি কোনওকালেই চা পছন্দ করি না। তবে ডাক্তার ফুয়াদ হালিম বলেছিল রোজ এক কাপ করে চা খেতে। তাই সকালে উঠে বিস্কুট দিয়ে এক কাপ খাই শুধু।"

বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন হঠাৎ! "ওরা ফুয়াদের মতো ছেলেকেও মারল! ভেবেছেটা কী? যা খুশি তাই করবে? গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি পার্টির জেলা সম্পাদক, তাকেও মারল! আমরা কী করছি?" শোনা যায়, ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি বলেছেন, তৃণমূলের সন্ত্রাস দেখে তাঁর আবার 'খারাপ' হতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তাঁর পার্টি কি সেই সুযোগ দেবে? অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পড়শি উত্তর দিলেন না। পার্টিজান ভোটের সময় এমন প্রশ্নের উত্তর দেয় না বোধহয়।

CPIM left front abhishek banerjee Left
Advertisment