পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়নের দিন থেকে অশান্তি শুরু হয়েছে। সেই রক্তের রাজনীতি পিছু ছাড়ছে না পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনের সময়েও। মৃত্যু মিছিল অব্যাহত। এমনকী রেহাই মিলল না দুগ্ধপোষ্য শিশুরও। শুধু চলছে শাসক এবং বিরোধীদের মধ্যে দোষারোপ এবং পাল্টা দোষারোপের পালা। আর ন'মাসের মধ্যেই লোকসভা নির্বাচন। তাই অশান্তির পারদ আরও চড়ছে। এর শেষ কোথায়, তা জানে না রাজনৈতিক দলগুলিও।
২৫ অগাস্ট উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরে খুন হন লাল মহম্মদ (৫০)। শুরু হয়ে যায় বোর্ড গঠনে রক্তের হোলি। বিরোধাীদের অভিযোগ, এই খুনের পিছনে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, যদিও তৃণমূল ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। দুদিন পর ২৭ অগাস্ট মালদার গোপালপুরে খুন হন শেখ সালাম (৩৪) এবং আজহার শেখ (৬০)। বোমার আঘাতে মৃত্যু হয় সালামের, মাথায় গুলি লাগে আজহারের। স্থানীয় সূত্রে খবর, দুজনের কেউই সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন।
খুনের মিছিলে তারপর যোগ হতে থাকে একের পর এক নাম। উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ায় গুলি করে, কুপিয়ে খুন করা হয় মহম্মদ খইরুলকে। দাবি, তিনি তৃণমূল সমর্থক। ঝাড়গ্রামে খুন হয়েছেন জামবনির তৃণমূল নেতা চন্দন ষড়ঙ্গী। পুরুলিয়ার ঘাঘরায় মৃত্যু হয়েছে নিরঞ্জন গোপ এবং দামোদর মন্ডলের। বিজেপির দাবি, তাঁদের ওই দুই কর্মীর মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে। যা নিয়ে সিবিআই তদন্ত দাবি করেছে বিজেপি।
না, তালিকা এখনও শেষ হয়নি। উত্তর ২৪ পরগনার আমডাঙ্গায় আতঙ্ক এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে। বহু গ্রাম এখন পুরুষ-বিহীন। বাড়িঘর, দোকান ভেঙে চুরমার। শুক্রবারও সেখানে ব্যাপক পুলিশি অভিযান চলেছে। আমডাঙ্গায় ২৯ অগাস্ট খুন হয়েছেন নাসির হালদার (২৫), কুদ্দুস গনি (৩৫), এবং মুজফ্ফর আহমেদ। প্রথম দুজন তৃণমূল এবং শেষের জন সিপিএমের কর্মী বলে দাবি। ৬ সেপ্টেম্বর আমডাঙ্গায় শান্তি মিছিল করবে তৃণমূল। মিছিলের নেতৃত্ব দেবেন তৃণমূল যুবর সর্বভারতীয় সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার জেলার পুলিশ সুপার সি সুধাকর জানান, এখন আর কোনও অশান্তি নেই। এই ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: মালদায় পঞ্চায়েত বোর্ড গঠন নিয়ে হিংসার শিকার তিন বছরের শিশু
নির্বাচিতদের নিয়ে বোর্ড গঠন করতে গিয়েই রাজ্য়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়ে গেল! মৃত্যু মিছিল নিয়ে কী বলছেন রাজনৈতিক নেতারা? রক্তপাতের দায় নিতে রাজি নয় কোনও দলই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনে এই খুনোখুনির দায় চাপিয়েছেন বিরোধীদের ওপর। তাঁর সাফ কথা, বিরোধীরা খুনের রাজনীতি করছে। পুরুলিয়ায় কয়েকটা আসনে জয় পেয়ে খুনোখুনিতে মেতেছে বিজেপি। রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, "বিরোধীরা অনবরত উসকাচ্ছে। তথাকথিত বিরোধীরা এই ধরনের রাজনীতি করছে। মাস্তানি পলিটিক্স। বিরোধীরা এক হয়ে খুনের রাজনীতি করছে।"
অন্যদিকে একজোট হয়ে বিরোধীরা খুনের রাজনীতির জন্য দায়ী করেছে তৃণমূল কংগ্রেসকে। সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমের বক্তব্য, "মুখ্যমন্ত্রী যদি বলেন ১০০ শতাংশ চাই, তাহলে এছাড়া আর কী হবে! পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে শেষ করতে গিয়ে গণতন্ত্রের খুন করছে তৃণমূল। কোচবিহার থেকে ২৪ পরগণা পর্যন্ত নিজেরাই খুনোখুনি করছে।" বিজেপি নেতা রাহুল সিনহা জানান, "বিজেপি খুনের রাজনীতি করে না। তৃণমূল কংগ্রেস পঞ্চায়েতের মনোনয়ন থেকে বোর্ড গঠন পর্যন্ত সন্ত্রাস আর খুনের রাজনীতি করে যাচ্ছে।" রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও রাজ্যে এই খুনের রাজনীতির দায়ভার চাপিয়েছেন তৃণমূলের ওপর।
আরও পড়ুন: পঞ্চায়েত বোর্ড গঠন নিয়ে আমডাঙায় সংঘর্ষে হত ৩
রাজনৈতিক মহল মনে করছে, লোকসভা ভোটের আগে পঞ্চায়েত দখল অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। ত্রিশঙ্কু পঞ্চায়েতগুলোতেই বেশি অশান্তি হচ্ছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও পঞ্চায়েত দখল করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিরোধীরা অশান্ত করছে এলাকা। একে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মদত, তার ওপর এলাকার ক্ষমতা দখল। সর্বোপরি পঞ্চায়েতের বিভিন্ন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকার হাতছানি। এসবের ফলেই বাড়ছে রক্তপাত।
কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এত অস্ত্র, গোলাবারুদ কোথা থেকে আসছে? ক্ষমতা দখলের অভিযানে মদত দিতে গিয়ে এ ব্যাপারটায় গুরুত্ব না দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ যে অস্ত্রভান্ডারে পরিণত হচ্ছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অভিজ্ঞ মহলের মত, মুঙ্গের থেকে যেমন অস্ত্র আসত তেমনই আসছে, পাশাপাশি রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় বেআইনি অস্ত্র কারখানা গড়ে উঠেছে। তার প্রমাণ আগেই মিলেছে। হাওড়া, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা-সহ নানা অঞ্চলে পুলিশ অস্ত্র কারখানা খুঁজে পেয়েছে। পুলিশ সূত্রেরই খবর, গ্রাম বাংলায় নানা জায়গায় এখন বোমা বানানো কুটির শিল্পে পরিণত হয়েছে। আদৌ কী করে বন্ধ হবে খুনের রাজনীতি?