পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিকে অফিসে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে নাকি তিনি ছুটি নিয়েছেন সেই বিতর্কের মধ্যেই উন্নয়ন প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে পূর্ব বর্ধমানের ভাতারে। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির অভিযোগ, ‘স্থানীয় বিধায়কসহ সমিতির সহসভাপতি তাঁকে জোর করে ছুটির আবেদনে স্বাক্ষর করিয়েছেন। তাঁকে অফিসে আসতে নিষেধ করেছেন।’ তাঁর অভিযোগ রয়েছে টেন্ডারের কাটমানি নিয়েও। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিধায়ক, তবে উন্নয়ন যে বাধা পাচ্ছে তা স্বীকার করেছেন সহসভাপতি থেকে বিডিও। এই নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
বৃহস্পতিবার সমিতির বৈঠকের পর এসকর্ট করে পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সুন্দরী মার্ডিকে বাড়িতে পৌঁছে দেয় ভাতার থানার পুলিশ। করোনা আবহেও উত্তাপ ছড়িয়েছে ভাতার পঞ্চায়েত সমিতিতে। সুন্দরী মার্ডির বক্তব্য, ‘বিধায়ক মানগোবিন্দ অধিকারী আমাকে বলেছেন, কেন এসেছেন অফিসে? আপনাকে আর আসতে হবে না। আপনি ছুটি নিয়ে নিন। আপনি বাড়ি চলে যান। কেন বলছেন জানি না। আমি আদিবাসী মহিলা বলে আমাকে সবসময় হুমকি দেবে তা আমি মানবো না। আমি কোনও অন্যায় করিনি।’ এখানেই থামেননি সুন্দরী মার্ডি। অভিযোগ তুলেছেন টেন্ডার প্রক্রিয়া নিয়েও। তাঁর বক্তব্য, ‘আমাকে না জানিয়ে টেন্ডার নিয়ে পার্টিদের সঙ্গে আলোচনা করছে। সব কাজগুলি ভাগ করে নিচ্ছে। আমার সঙ্গে আলোচনা করছে না। তারপর বলছে ফাইলে সই করুন। সবাই করছে না আমাকে সই করতে বলছে। প্রতি টেন্ডারের ১০-১২ শতাংশ নিয়ে নিচ্ছে আমাকে কিছু জানাচ্ছে না। সহসভাপতি, সহ অন্য কয়েকজন সদস্য এই কাজ করছেন।’
আগের আড়াই বছর ভালোভাবে কাজ করেছেন বলে দাবি সমিতির সভাপতির। সুন্দরী জানিয়েছেন, জেলাসভাধিপতি, দলের জেলা সভাপতি, মহকুমা শাসক বর্ধমান(উত্তর) সহ সকলকেই বিষয়টা জানানো হয়েছে। এর ফলে রাস্তা, ড্রেনের কাজ বন্ধ হয়েছে ভাতারের বেশ কিছু গ্রামে।
সভাপতির সঙ্গে টেন্ডার নিয়ে সমস্যা, অফিসে আসতে না দেওয়া প্রসঙ্গে ভাতারের বিধায়ক মানগোবিন্দ অধিকারী বলেন, ‘আমার সঙ্গে কিছু হয়নি। আমি টেন্ডার কমিটিতে নেই, কিছুতেই নেই। পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ মারা গিয়েছেন, তাই একটা টেন্ডার কমিটি হয়েছে। সভাপতির বাচ্ছা হয়েছে উনি একমাস আসেননি। এখন তিনি তিন মাসের ছুটি নিয়েছেন। জোর করার কোনও বিষয় নেই। আমি পঞ্চায়েত সমিতি যাই না।’
ভাতার পঞ্চায়েত সমিতিতে মোট ৩৮ জন সদস্য। একজন সিপিএম, বাকি সবাই তৃণমূলের। একজন সদস্য মারা গিয়ছেন। সভাপতিকে জোর করে ছুটি নিতে বাধ্য করানো হয়েছে, একথা মানতে নারাজ সহসভাপতি সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। সহসভাপতির দাবি, ‘উন্নয়নের কাজ আটকে গিয়েছে ওনার না আসার কারণেই। জোর করে সই করানোর অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সদ্যজাতকে নিয়ে অফিসে এসেছিলেন। আমাদের মহিলা জনপ্রতিনিধিরা তাঁকে বলেছেন এই অবস্থায় অফিসে এসো না। তিন মাস পর আবার এসো। ব্লক অফিসে বিডিও, জয়েন্ট বিডিও সহ অনেকেই করোনা আক্রান্ত। সেই কথাতেই রাজি হয়েছে। কিন্তু আবার যদি ঘুরিয়ে অভিযোগ করে তাহলে আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।’
টেন্ডার নিয়ে অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, ‘টেন্ডার ওপেন করা যাচ্ছে না। প্রশাসনের কর্তারা কড়া ভাষায় কথা বলছেন। এদিকে বছর শেষ হতে চলল।’ সভাপতি অভিযোগ করছে আপনারা টেন্ডারগুলিতে জোর করে সই করাতে চাইছেন, ছুটি নিতে বাধ্য করেছেন। সুমন্তবাবুর জবাব, ‘আমার জানা নেই। শুক্রবার আমাদের জেনারেল বডি মিটিং ছিল। এবার আমাদের কাজ এগোবে। টেন্ডার অফলাইন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে সমিতির বৈঠকেই। সেখানে সভাপতি ছিলেন।’
শুক্রবারের বৈঠকের পর উন্নয়নের বাকি কাজ এগোবে বলে জানিয়েছেন ভাতারের বিডিও। অরুণ কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘সভাপতি ছুটির আবেদন করেছেন। শুক্রবার একটা জেনারেল বডি মিটিং হয়েছে। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে উনি যতদিন না আসছেন ততদিন সহকারি সভাপতি সব দায়িত্ব সামলাবেন। আশা করছি এবার কাজকর্মগুলি চালু হবে। এই সমস্যা আগে কখনও হয়নি। পঞ্চদশ অর্থ কমিশনেরফিফটিন ফিনান্সিয়াল ইয়ারের প্রায় ১৮টা টেন্ডার আটকে রয়েছে, প্রায় ১ কোটি টাকার ওপরে হবে। এক-দেড় মাস ধরে ঝুলে রয়েছে। সহসভাপতি সবে দায়িত্ব নিয়েছেন, দিন ১৫-এর মধ্যে কাজ শুরু হবে।’ তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য মুখপাত্র তথা বর্ধমান জেলাপরিষদের সহসভাধিপতি দেবু টুডু বলেন, ‘সভাপতি অফিসেও আসছিল না আবার ছুটিও নেয়নি।’ বিধায়ক বা সহসভাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যে কোনও ভাবে যেই হোক বুদ্ধি দিচ্ছে। ছুটি নেয়নি বলেই কাজ হচ্ছে না।’
সুন্দরী মার্ডির কথায়, ‘আমরা সবাই দিদির লোক তাহলে এমন হচ্ছে কেন?’ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ও বিধায়কসহ অন্যদের বক্তব্য যাই হোক না ভাতারের মানুষের আক্ষেপ, তাঁদের উন্নয়নের কাজ বাধা পাচ্ছে। আর্থিক বছর শেষ হতে আর মাত্র দুমাস বাকি। এই মুহূর্তে সমিতির ৩৭ জন সদস্যের ৩৬ জনই তৃণমূল কংগ্রেসের। সভাপতি, সহসভাপতি, বিধায়ক সবাই ঘাসফুলের টিকিটেই মসনদে বসেছেন। এদিকে উন্নয়নের দাবিকে সামনে রেখেই তৃণমূল ভিন রাজ্যে নির্বাচনী লড়াইতে নেমেছে। সেখানে রাজ্যে এক পঞ্চায়েত সমিতির এমন ঘটনায় বিতর্ক বাড়তে বাধ্য।