স্বপ্ন যে বাস্তবে রূপ নেয় তা কলকাতাবাসী প্রথম দেখেছিল ২৪ অক্টোবর, ১৯৮৪-তে। মহানগরের উত্তর ও দক্ষিণে ২৭.২৩ কিলোমিটার মেট্রো পথে যুক্ত হয়েছিল। এদেশে প্রথম মাটির নীচ থেকে ট্রেন যাতায়াত শুরু করল মেট্রো শহর কলকাতায়। ওভারহেড তারের কোনও বালাই নেই। সেই ট্রেন পরিচিতি পেয়েছিল পাতাল রেল হিসাবে। পরবর্তীতে সংযােজিত মেট্রো রেল মাটির ওপর দিয়ে চলাচল দেখা শুরু করায় পাতাল রেলের পাতাল পরিচয় হারাতে থাকে। এবার ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর হাত ধরে ফের পাতালে প্রবেশ করবে মেট্রো। শুধু তাই নয়, গঙ্গার নিচ থেকে টানেলে সহজেই জলপথ পার হওয়া যাবে। ২০২১ সালে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর হাত ধরে ফের যাত্রী পরিবহণে বিপ্লব ঘটবে। তবে এ বিপ্লবে কলকাতা একা নয়, তার সাথী হবে যমজ শহর হাওড়াও।
হাওড়া স্টেশন থেকে দিনে গড়ে ৭ লক্ষ মানুষ মেট্রো চড়ে গঙ্গা পার হবেন। ঢুকে পড়বেন শহর কলকাতায়। হাওড়া ময়দান থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের ব্য়বধানে মেট্রো রেল আপনাকে পৌঁছে দেবে সল্টলেক সেক্টর ফাইভে। এর মধ্য়ে থাকছে মোট ১২টি স্টেশন। ১৬.৬ কিলোমিটার রেল লাইনের ১০.৮ কিলোমিটার মাটির নীচ দিয়ে যাবে, বাকি ৫.৮ কিলোমিটার থাকছে মাটির ওপরে। হাওড়া ময়দান থেকে একেবারে ফুলবাগান স্টেশনের পর সুভাষ সরোবর পর্যন্ত মেট্রো থাকবে মাটির নীচে। তারপর মাটির ওপরে থাকবে মেট্রোর লাইন। সেখান থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত মেট্রো চলবে মাটির ওপরে।
ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ তিনটি পর্যায়ে সম্পূর্ণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ ফেজ ওয়ানে মেট্রো দৌড়বে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে সল্টলেক স্টেডিয়াম পর্যন্ত। তারপরের পর্যায়ে মেট্রোর যাত্রা সল্টলেক স্টেডিয়াম থেকে ফুল বাগান পর্যন্ত, শেষ পর্যায়ে ফুলবাগান থেকে হাওড়া ময়দান পর্যন্ত। কেএমআরসিএল সূত্রে খবর, প্রথম পর্যায়ের কাজ এই অর্থনৈতিক বছরে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। চলতি বছরের অক্টোবরে সেক্টর ফাইভ থেকে সল্টলেক স্টেডিয়াম পর্যন্ত মেট্রো চালু করার লক্ষ্য়মাত্রা থাকলেও নিরাপত্তা সংক্রান্ত ছাড়পত্রসহ আরও অনেকগুলি বিষয়ের উপর রেল চলাচলের বিষয়টি নির্ভর করছে।
হাওড়া ময়দান থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত কাজ শেষ হওয়ার লক্ষ্য়মাত্রা ধরা হয়েছে জুন, ২০২১।হাওড়া স্টেশনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ওই স্টেশনে যাত্রী ভিড়ের কথা মাথায় রেখে ডাবল ডিসচার্জ স্টেশন করা হবে, অর্থাৎ অন্য় স্টেশনগুলির মতো একদিকে যেমন একদিকে ওঠা-নামা করা যায়, এখানে দুদিকে সেই ব্য়বস্থা থাকবে। হাওড়া স্টেশনটি তৈরি হচ্ছে মাটি থেকে ২৭ মিটার নীচে। এখনও পর্যন্ত ভারতবর্ষে ২৭ মিটারের নিচে ২ টো মেট্রো স্টেশন তৈরি হয়েছে। দিল্লির হাউসখাস ও চৌরিবাজারে। সেক্ষেত্রে হাওড়া স্টেশনও এবার সেই তালিকায় নাম লেখাতে চলেছে। এখানে ১২ টি এসকেলেটর ও ৪ টি লিফ্ট থাকবে। ২০৩৫ সালে হাওড়া থেকে আড়াই মিনিট অন্তর ট্রেন চালানোর লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন ওই স্টেশন দিয়ে রোজ ১০ লক্ষ মানুষ যাতায়াত করবেন।
এসপ্ল্যানেড স্টেশনে জুড়বে তিন দিকের মেট্রো, যা ভারতের আর কোথাও নেই। নর্থ-সাউথের মেট্রো স্টেশন রয়েছে। জোকা-ধর্মতলা মেট্রো এখানে এসে থামবে। আবার নির্মীয়মাণ ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর স্টেশন তৈরির কাজও চলছে এখানে। ধর্মতলার ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো স্টেশন হবে মাটির ২৬.৩২ মিটার নিচে, যা কবি সুভাষ থেকে দমদম মেট্রো স্টেশনের অনেকটাই নিচে। অন্য় দিকে এখানে জোকা-ধর্মতলা মেট্রো স্টেশন নির্মাণ করা হবে মাটির ১১.৭৩ মিটার নীচে। পুরনো ধর্মতলা স্টেশনও ওই গভীরতাতেই নির্মিত হয়ে আছে।
এই প্রথম ভারতে নদীর তলা দিয়ে যাত্রী পরিবহণের জন্য় টানেল তৈরি হয়েছে। হাওড়া স্টেশনের পর মেট্রো নেমে যাবে ওই টানেলে। গঙ্গার নিচে টানেলের ভিতর দিয়ে ছুটবে মেট্রো। এই টানেলের দৈর্ঘ্য় ৫২০ মিটার। টানেলের ব্য়াস ৬ মিটার। গঙ্গায় জলের গভীরতা ১৩ মিটার। গঙ্গার তলার মাটি থেকে গঙ্গার টানেলের ওপরিভাগের দৈর্ঘ্য় ১৬ মিটার। জলস্তর থেকে টানেলের তলদেশ ৩৫-৩৬ মিটার। এই টানেল তৈরির কাজও শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য মাঝে মাঝে এই রুটে ট্রেন চালানোহচ্ছে।
ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো চলবে নতুন সিবিটিসি, অর্থাৎ communication base train control টেকনোলজির মাধ্যমে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ট্রেন চালাতে কোনও চালক লাগে না। সল্টলেক সেক্টর ফাইভে তৈরি হচ্ছে একটি অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার। ট্রেন চালানো হবে ওই সেন্টার থেকে। যাত্রী সুরক্ষার জন্য আধুনিকতম যে প্রযুক্তি সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হয়, সেই প্রযুক্তিই ব্যবহৃত হবে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোতেও।
ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর ট্রেনের লাইনও নর্থ-সাউথ ও জোকা-ধর্মতলা মেট্রোর থেকে অনেকটাই আলাদা হবে। ইস্ট-ওয়েস্টের লাইন হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড গেজ(১৪৩৫মিলিমিটার)। অন্য় দিকে বাকি দুই মেট্রোর লাইন ব্রড গেজ(১৬৭৬মিলিমিটার)।
ইস্ট ওয়েস্টে ৬টি কোচ সম্বলিত প্রতিটি ট্রেনই হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। প্রতিটি ট্রেনে ২০৬৮ জন যাত্রী সওয়ার হতে পারবেন। নিরাপত্তার জন্য় সব কোচেই থাকবে অনলাইন নজরদারি ক্য়ামেরা। কন্ট্রোলরুম থেকেই চলবে কড়া নজরদারি। আন্ডারগ্রাউন্ডের সমস্ত স্টেশনও হবে এয়ার কন্ডিশনড। থাকছে অত্য়াধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্য়বস্থা।
ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোয় ২০২০ সালেই যাত্রী সংখ্য়া ধরা হয়েছে ৭লক্ষ। ২০২৫ সালে যাত্রী সংখ্য়া দাঁড়াবে ৮ লক্ষে। সেই হিসেব মোতাবেক ২০৩৫-এ ১০ লক্ষ যাত্রী যাতায়াত করার সম্ভাবনা রয়েছে। হাওড়া ময়দান থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত ১২টি স্টেশন করা হচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী মাটির নীচে থাকবে ৬টি স্টেশন। হাওড়া ময়দান, হাওড়া (রেলস্টেশন), মহাকরণ, এসপ্লানেড, শিয়ালদা(রেলস্টেশন), ফুলবাগান। এরপর সুভাষ সরোবরের কাছে গিয়ে মাটির ওপরে উঠবে মেট্রো। মাটির ওপরে যে ৬টি স্টেশন থাকবে।সেগুলি হল সল্টলেক স্টেডিয়াম, বেঙ্গল কেমিক্য়াল, সিটি সেন্টার, সেন্ট্রাল পার্ক, করুণাময়ী ও সেক্টর ফাইভ।