/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/09/dabi-pokkho-LEAD.jpg)
ফটো ফ্রেমে অনিল বিশ্বাস। বাম দিকে অজন্তা। অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস।
তিনি ছিলেন প্রমোদ দাশগুপ্তের শিষ্য, সিপিআইএম-এর 'ফ্যাব ফাইভ'-এর অন্যতম। পরবর্তীকালে রাজ্য সিপিএমের প্রধান। বরফ শীতল মাথায় তাঁর ক্ষুরধার বুদ্ধি, কৌশল রচনায় অবিশ্বাস্য দক্ষতা একদিকে যেমন দলের বহু সংকট মোচন করেছে, তেমনই মাত করেছে বিরোধীদের। অনেকেই বলেন, তিনিই ছিলেন 'পার্টির মস্তিষ্ক', তিনি থাকলে এভাবে ভেঙে পড়ত না বাংলার লাল দুর্গ। সেই মানুষটার হয়ে ওঠার লড়াই কতটা কঠিন ছিল? সর্বক্ষণের পার্টিকর্মী হয়েও বাবা হিসাবে কেমন ছিলেন তিনি? আজ বেঁচে থাকলে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কীভাবে লড়তেন 'চাণক্য'? পিতৃপক্ষের শেষ দিনে এসব প্রসঙ্গেই ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র সঙ্গে আড্ডা দিলেন অনিল বিশ্বাসের কন্যা অধ্যাপিকা অজন্তা বিশ্বাস।
বাবা অনিল বিশ্বাস কেমন ছিলেন?
বাবা আমার খুবই ভাল বন্ধু ছিলেন। আমি আর বাবা, আমরা একে অপরের সঙ্গে আড্ডা দিতে খুব ভালবাসতাম। বাবা হিসাবে উনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন। আমার মা বরাবর চাকরি করতেন এবং বাবা ছিলেন পার্টির হোলটাইমার। তাই দু'জনেই সময় ভাগ করে নিয়ে আমাকে দেখাশোনা করতেন। বাবার তিনটে টাইম জোন ছিল। সকাল আটটা থেকে ন'টা, এ সময়টা বাবা আমার সঙ্গে থাকতেন। এরপর আমার স্কুল ছুটির পর, মানে বিকেল চারটে থেকে পাঁচটা পর্যন্ত আমার দায়িত্ব থাকত বাবার উপর। এই সময়টায় আমি আর বাবা টেবিলের উপর খাবার নিয়ে বসে নানা রকম গল্প করতাম এবং খেতাম। এরপর মা চলে আসতেন। আবার দিনের শেষে রাত সাড়ে দশটা নাগাদ বাবা যখন বাড়ি ফিরতেন, তখন এসে জোরে ডাক দিতেন, 'মা জেগে আছিস'? যদি কখনও আমি ঘুমিয়েও পড়তাম, বাবার ওই ডাক শুনে উঠে যেতাম। তখন আবার একপ্রস্থ আড্ডা হত। ছুটির দিনগুলিতেও একই রকম আড্ডা হত আমাদের। আমরা এন্টালিতেই থাকতাম, আমার জন্ম এখানেই। মা-বাবা এন্টালি চত্বরেই একটা চিলোকোঠার মতো জায়গায় ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতেন। মনে পড়ে, বাবা যখন সকালে বেরিয়ে যেতেন, তখন আমি জানলায় গিয়ে দাঁড়াতাম। আর বাবা নীচ থেকে আমাকে হাত নেড়ে বলতেন, 'টাটা, মা...'। এদিকে আমিও জানলা থেকে হাত নাড়তে নাড়তে বলতাম, 'টাটা, বাবা...'। এই ব্যাপারটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলত। পাড়ার লোকেরাও এই ব্যাপারটা দেখতেন। এখনও এই পাড়ায় অনেকেই আমাকে সেই কথা বলে হাসাহাসি করেন।
আরও পড়ুন- ‘যে সিপিএম-কে হারিয়েছেন, সেই সিপিএম-কে আর ফেরত আসতে দেব না’
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/09/inside-2-1.jpg)
বাবাকে ভয় পেতেন?
না, ঠিক ভয় ছিল না। তবে একটা শৃঙ্খলাবোধ ছিল তাঁর মধ্যে। আমি যখন প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হচ্ছি, মানে কলেজ জীবন শুরু হচ্ছে, তখন আড্ডা-বন্ধু-বান্ধব নিয়ে একটা নতুন জীবন শুরু হচ্ছে, সে সময় বাবা বলে দিয়েছিলেন, মোটামুটি সাড়ে ন'টার মধ্যে বাড়ি ঢুকতে হবে।
যদি এই নিয়মের নড়চড় হত, সে ক্ষেত্রে কি বকা খেতেন?
না, বকতেন না। তবে, একদম চুপ করে যেতেন। ওটা আরও মারাত্মক ছিল। বকলে তবু রাগটা বেরিয়ে যেত।
আপনার যাপনে বাবা কীভাবে মিশে আছেন?
আসলে বাবার থেকে অনেক কিছু শেখার ছিল। এইসব শিক্ষাগুলি নিয়েই আমি বেঁচে আছি। যেমন একটা উদাহরণ দিই, আমার যে বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল এবং আজও আছে, সে যখন ক্লাস নাইনে পড়ে, তখন তার মায়ের মৃত্যু হয়। এরপর থেকেই আমার বন্ধুটি অধিকাংশ সময় আমাদের বাড়িতেই থাকত। একদিন স্কুল ছুটির পর বাড়িতে এসে ওর সামনেই আমি আমার মা-কে খুব আদর করছিলাম। বাবা সে সময় সামনেই ছিলেন। পরে রাতে আমাকে বলেছিলেন, যার যেটা নেই, তার সামনে সেই বিষয়টাকে নিয়ে বিশেষ আনন্দ-উপভোগ করতে নেই। বাবা মানুষটা ভীষণ সংবেদনশীল ছিলেন। বাবা সব সময় বলতেন, মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলো না, এটা অন্যায়। আবার কখনও যদি রেগে গিয়ে কারও সমালোচনা করতাম, তখন বাবা রেগে যেতেন। বলতেন, মানুষের ভাল দিকগুলি নিয়ে আলোচনা কর, নেতিবাচক দিক নিয়ে চর্চা করে কখনও লাভ হয় না। বাবার এই শিক্ষাগুলি আমার মধ্যে গেঁথে গিয়েছে।
আরও পড়ুন- যাদবপুরে বাবুল সুপ্রিয় ও নতুন বাম নেতার সন্ধান
করিমপুরের এক অখ্যাত গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে উঠে এসে সিপিআই(এম)-এর মতো একটা দলের রাজ্য সম্পাদক এবং পলিটব্যুরো ও সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ প্রাপ্তি- এতো স্বপ্নের উত্থান। অনিলবাবুর শুরুর দিনগুলো কেমন ছিল?
প্রথমেই বলি আমাদের পরিবার কিন্তু, কংগ্রেসি ঘরানার ছিল। তিন ভাই এবং এক বোনের মধ্যে আমার বাবাই ছিলেন কনিষ্ঠ। আমার জ্যেঠুরা রীতিমতো কংগ্রেসি আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু মাঠে ময়দানে রাজনীতি করতেন না। আমাদের পারিবারিক ব্যবসাও ছিল। তবে দারিদ্র্যও ছিল চরম। আমার ঠাকুরদা তখন নেই, জ্যেঠুরাও চাননি যে তাঁদের ছোট ভাই রাজনীতি করুক। তাঁরা চাইতেন, ভাইও ব্যবসাটাই দেখুক। কিন্তু, বাবার বরাবরের ঝোঁক বাম রাজনীতির প্রতি। বাবা কিছুতেই ব্যবসা করতে চাননি। সে সময় আমার বাবাকে আগলে রেখেছিলেন আমার মেজ জ্যেঠিমা। তিনি আমার বাবার থেকে বছর তিনেকের বড় ছিলেন। ফলে সম্পর্কটা একেবারেই বন্ধুর মতো ছিল। এবার বাবা তো কিছুতেই ব্যবসা করবেন না। তিনি বরং নদীয়ার করিমপুর ছেড়ে কৃষ্ণনগরে এসে কলেজে পড়তে চান। সে সময় আমার মেজ জ্যেঠিমাই তাঁর গয়না বিক্রি করে বাবাকে কৃষ্ণনগরে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। তখন থেকেই বাবা সরাসরি ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/09/inside-1-1.jpg)
অনিলবাবু কি প্রাক যৌবন থেকেই ঠিক করে ফেলেছিলেন যে পেশাদার রাজনীতিক হবেন?
নাহ্। বরং যেটা বলতে চাই, আমার বাবা কিন্তু খুব ভাল ছাত্র ছিলেন। অর্থকষ্ট এবং চরম দারিদ্রের জন্য কৃষ্ণনগরে থাকাকালীন বহুদিন না খেয়ে বা আধপেটা খেয়ে থেকেছেন। এরফলেই বাবার যক্ষা হয়ে গিয়েছিল। বাবার শরীর বরাবর দুর্বল ছিল। এই যে এত কম বয়সে (৬২ বছর) চলে গেলেন, সেটাও ওই কারণেই। আমি প্রায় ছোট বেলা থেকেই জানি, বাবার কিডনির সমস্যা। হ্যাঁ, যাই হোক যে কথা বলছিলাম, বাবা কৃষ্ণনগরে কলেজে পড়ার সময় থেকেই সক্রিয় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন। আর এই গোটাটাই কিন্তু, আদর্শবোধ এবং পার্টির প্রতি গভীর ভালবাসা থেকে। সেখানে 'কেরিয়ার' গড়ার বা 'পেশাদার' হওয়ার ঠিক কোনও ব্যাপার ছিল না। কৃষ্ণনগর থেকে বাবা এরপর কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ পাশ করেন। রাজ্যে তখন কংগ্রেসি শাসন। বাবা সম্ভবত জেল থেকে এম.এ পরীক্ষা দিয়েছিলেন এবং রীতিমতো ভাল নম্বরও পেয়েছিলেন। কলকাতায় আসার পর থেকেই দীনেশ মজুমদার-সহ আরও বেশ কয়েক জন সিনিয়রের নেতৃত্বে কাজ শুরু করে দেন। প্রথম থেকেই বাবা গণশক্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এরপর গণশক্তির সঙ্গেই দীর্ঘ যাত্রা। পরে পার্টির রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব...এই আরকি। আসলে বাবা পার্টিকে মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছিলেন। সেই ভালবাসা এতটাই ছিল যে মৃত্যুর আগে শেষ কথাটাও বাবা প্রকাশ আঙ্কেলের (প্রকাশ কারাট) সঙ্গেই বলেছিলেন।
আরও পড়ুন- বুদ্ধদেববাবুর চীন-তর্পণ
মৃত্যুর আগে শেষ কথা মানে?
সেদিন আমার জ্বর হয়েছিল। বাবা এসে আমার মাথায় একবার হাতও বুলিয়ে দিয়ে গেলেন। এরপর হঠাৎ দেখি, বাবার ঘরে আলোটা জ্বলছে-নিভছে। রাত তখন ন'টা বাজে। মা আর আমি বাবার ঘরে গিয়ে দেখি। সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে। পরের দিন বাবার মালদা যাওয়ার কথা ছিল। সঙ্গে সঙ্গে পার্টি অফিসে (আলিমুদ্দিনে) ফোন করি। অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে কয়েকজন চলে আসেন। এরপর বাবাকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে, তখন তিনি পার্টিরই একজনকে বললেন, 'একটু প্রকাশকে ধরিয়ে (মোবাইল ফোনে) দাও'। বাবা ওই অবস্থাতেও প্রকাশ আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলেন। বাবা বলেছিলেন, 'প্রকাশ, আমার শরীরটা খুব খারাপ। হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে'। মৃত্যুর আগে এটাই বাবার শেষ কথা। এই ছিলেন তিনি। সারাটা জীবন, এমনকী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শুধু পার্টিকেই ভালবেসেছেন এবং দায়বদ্ধ থেকেছেন। তিনি তখন পার্টির রাজ্য সম্পাদক, আর প্রকাশ আঙ্কেল ছিলেন সাধারণ সম্পাদক।
মৃত্যুটা কি একেবারেই হঠাৎ?
হ্যাঁ, তবে বাবা কিছু একটা আঁচ করেছিলেন। মৃত্যুর বছর দেড়েক আগে থেকেই আমাকে বলতেন, 'মা, আমি আর বেশি দিন নেই'। সে জন্যই খুব তাড়াতাড়ি আমার বিয়েটাও দিয়ে দিলেন...
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/09/inside-3-1.jpg)
আপনি গণশক্তির কথা বলছিলেন, এই গণশক্তিতেই তো অনিলবাবুর তেত্রিশটি বছর কেটেছিল। এরমধ্যে ১৫ বছর সম্পাদক হিসাবে। পার্টি মুখপত্রে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অনিলবাবুকে কীভাবে দেখেছেন?
কলকাতায় চলে আসার পর থেকে বাবার সারাটা জীবনই আসলে গণশক্তির সঙ্গেই কেটেছে। বাবা যে কোনও বস্তুবাদী দৃষ্টিতে দেখতেন। বাবার সব থেকে বড় অবদান বলতে আমি মনে করি, নতুন সাংবাদিকদের তুলে নিয়ে আসা। বাবা পার্টির ছাত্র সংগঠন থেকে যোগ্য এবং প্রতিভাবানদের খুঁজে এনে গণশক্তির সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। এরপর বাবার অভিভাবকত্বে তাঁরা সাংবাদিক হয়ে উঠেছেন। আমার ছোটবেলায় দেখেছি, সম্পাদকের যাবতীয় দায়িত্ব সামলেও রাত অবধি জেগে থেকে বাবা গণশক্তি ছাপার গোটা প্রক্তিয়াটা দেখভাল করতেন।
অনিল বিশ্বাসের আমলেই গণশক্তির প্রচার সংখ্যা সর্বাধিক হয়েছিল। উনি পার্টির সর্বস্তরে কাগজ বিক্রির টার্গেট বেঁধে দিয়েছিলেন। অনেকে বলেন, একজন সার্কুলেশন ম্যানেজারের যাবতীয় দক্ষতাও...
(প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়েই) হ্যাঁ, একেবারেই। শুধু কি আপনি যা বলছেন তাই! এছাড়াও পাড়ার মোড়ে মোড়ে গণশক্তির স্ট্যান্ড তৈরি করা, পথে ঘাটে এমন জায়গায় কাগজটাকে রাখা যাতে সকলের চোখ পড়ে, এ সবই বাবার মস্তিষ্কপ্রসূত। আসলে আমি মনে করি, মাসকমিউনিকেশনের ব্যাপারে বাবার যে জ্ঞান, সেটাই এই সাফল্য এনে দিয়েছিল।
এই দক্ষ ও হিসেবি প্রশাসক মানুষটা পারিবারিক জীবনে কতটা হিসাব কষে চলতেন?
একদমই না। সংসার মূলত সামলাতেন আমার মা। বাবা বরং অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ছিলেন। বিশেষত, আমার বিষয়ে। আমার বিয়ের দিন সকালে আমি যখন লাল পাড়-সাদা শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে, বাবা সে দৃশ্য দেখে প্রচন্ড কেঁদেছিলেন। সেইসব ভিডিও আজ যখন আমি দেখি...
আচ্ছা, এবার একটু প্রসঙ্গান্তরে আসি। অনিলবাবু যেদিন পার্টির রাজ্য সম্পাদক ঘোষিত হলেন, সেই দিনটায় আপনাদের বাড়ির পরিবেশ কেমন ছিল?
(হাসতে হাসতে বললেন) আমি পরের দিন গণশক্তি পড়ে জেনেছিলাম। আমার মাও বোধহয় সে ভাবেই জেনেছিলেন।
(প্রশ্নকর্তা রীতিমতো অবাক) বলেন কী! রাজ্যে প্রবল পরাক্রমশালী সিপিএম-এর সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হলেন আপনার বাবা, আর আপনি নাকি পরের দিন পার্টি মুখপত্র পড়ে সে কথা জেনেছিলেন!
সত্যিই তাই। আসলে আমি জানতাম, বাবা পার্টির কাজ করেন। সেই কাজটা কখনও গণশক্তি-র সম্পাদনা, আবার কখনও পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব। এগুলো সব একেকটা ভূমিকা। বাবা নিজেও এই পদ-টদকে তেমন আমল দিতেন না। অন্যান্য দিনের মতোই বাবা রাতে বাড়ি ফিরে গল্পগুজব করে খেয়েছেন এক সঙ্গে। শুধু অনেক টেলিফোন এসেছিল সেদিন। তাও তেমন বুঝিনি।
কমরেডদের তরফ থেকে লাল গোলাপ আসেনি সেদিন?
এসেছিল বোধ হয়। কিন্তু, সেটা পরের দিন।
রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পর অনিলবাবুর জীবন কতটা বদলে গিয়েছিল?
বাবা আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। সব সময়েই জেলায় জেলায় ঘুরতে হত।
পার্টি কমরেডদের মধ্যে অনিলবাবুর বন্ধু ছিলেন কে কে?
সকলের সঙ্গেই বাবার বন্ধুত্ব ছিল। তবে বুদ্ধকাকু আর বাবা ছিলেন একেবারে সমবয়সী। ওঁদের একই দিনে জন্ম। এছাড়া, সুভাষকাকু, বিমান জ্যেঠু, শ্যামল জ্যেঠু সকলের সঙ্গেই খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। জ্যোতি বসুও বাবাকে খুব স্নেহ করতেন। আমার মনে পড়ে, আমাদের সেই ভাড়া বাড়িতে একবার জ্যোতি বসু এসেছিলেন।
বুদ্ধবাবুর কন্যা, শ্যামলবাবুর কন্যা, সুভাষ চক্রবর্তীর পুত্র, সূর্যকান্ত মিশ্রের কন্যার সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব আছে? আপনারা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন?
হ্যাঁ। সকলেই নিজের নিজের কাজ নিয়ে আছেন এবং নিজের মতো করে পার্টির আদর্শের সঙ্গেও যুক্ত।
'অনিল-কন্যা' এই পরিচয়টা আপনার কাছে কেমন ছিল?
বাবা-মা ছোট থেকেই খুব সাধারণভাবে বাঁচতে শিখিয়েছিলেন। আমার মা বাসে চড়ে অফিস যেতেন।
সে তো আপনার পারিবারিক শিক্ষা। কিন্তু, দুনিয়াটা তো আর আপনার পরিবার নয়। আপনি না চাইলেও সেই দুনিয়া আপনাকে 'অনিল-কন্যা' হিসাবেই দেখত। সেই অভিজ্ঞতাটা কেমন?
সকলের কাছে অনেক ভালবাসা পেয়ছি এই পরিচয়টার জন্য। বাজারের মাছ বিক্রেতা থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা, সকলেই আমাকে খুব ভালবাসতেন।
/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/09/inside-4-1.jpg)
আজ তৃণমূল সরকারের আমলে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। এই সময়ে 'অনিল-কন্যা' পরিচয়টা কেমন?
আমার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সম্পর্ক খুবই ভাল। তাঁরা আমায় 'অজন্তা দি' নামে ডাকে এবং সহজভাবেই মেশে।
কিন্তু, চাকরিটা তো শুধু ছাত্রদের নিয়েই নয়। রাজ্যের শিক্ষা প্রশাসনে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের কাছে এই পরিচয়টার জন্য কোনও 'বিশেষ ব্যবহার' পেতে হয়েছে?
নাহ্। তেমন অভিজ্ঞতা আমার নেই এখনও। আমি আমার কাজ নিয়েই থাকি। আমার লেখাপড়ার জগৎ, পরিবার এবং পার্টি- এই আমার জীবন।
আরও পড়ুন- ‘এমনও তো হতে পারে, মমতাকে জেলে যেতে হল’
অনিল বিশ্বাসের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ বা সমালোচনা যে তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে 'অনিলায়ন' ঘটিয়েছিলেন। অর্থাৎ রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে বেছে বেছে দলের অনুগত ব্যক্তিদের বসিয়েছিলেন। আপনি নিজে শিক্ষা ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত। কী বলবেন?
দেখুন, আমার এ বিষয়ে কিছু বলা উচিত না (মুখের রেখায় অসন্তোষের আভা)। তাছাড়া, উনি বেঁচে থাকাকালীন সংবাদমাধ্যম এই শব্দটি প্রয়োগও করেনি। তাই আমি এ বিষয়ে কিছুই বলব না।
অনিলবাবু গত হয়েছেন ২০০৬ সালে। সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে ২০১১ সালে। আর আজ ২০১৯। তবু এখনও চায়ের আড্ডা থেকে মিটিং-সেমিনার সর্বত্র অনেকেই বলেন, অনিল বিশ্বাস বেঁচে থাকলে পার্টির আজকের এই হাল হত না। আপনার কী মনে হয়?
হ্যাঁ, অনেক মানুষ আজও বলেন। তবে আমি মনে করি, কমিউনিস্ট পার্টি কোনও একজনকে নিয়ে চলে না। এখনও অনেকে আছেন, যাঁরা লড়াই করছেন।
তবুও তো অনিলের শুন্যতা অনুভূত হয়। আপনার বাবাই তো ছিলেন পার্টির শীতল ও কৌশলী মস্তিষ্ক...
(প্রশ্ন টেনে নিয়ে বললেন) দেখুন, বাবা পার্টির জন্য যে কৌশলই নিয়ে থাকুন না কেন, সেটা এককভাবে নেননি। সকলে মিলে সহমতের ভিত্তিতেই হয়েছে।
আজ দল ক্ষমতা হারানোর পর কঠিন সময়ে যদি আপনার বাবা বেঁচে থাকতেন ও পার্টির দায়িত্বে থাকতেন, তাহলে ঠিক কী করতেন বলে মনে হয়?
বাবা আরও বেশি লড়াই করতেন। কমিউনিস্টদের কাছে ক্ষমতায় থাকা বা না থাকাটা লড়াইয়ের ক্ষেত্রে খুব ফারাক করে দেয় না। বাবা তাঁর কমরেডদের নিয়ে আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে লড়তেন বলেই আমার বিশ্বাস।