/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2019/01/dilip-ghosh.jpg)
রাজ্য়ে পাঁচটি সভা করবেন অমিত শাহ। জানালেন বিজেপির রাজ্য় সভাপতি দিলীপ ঘোষ।
রাজ্য রাজনীতিতে তাঁর তথাকথিত আলপটকা মন্তব্যের জন্য যথেষ্ট নামযশ হয়েছে দিলীপ ঘোষের। তিন বছর ধরে তিনি বিজেপির রাজ্য সভাপতি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রদের নিয়ে খোলা মনে আমাদের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে মতপ্রকাশ করলেন দিলীপ ঘোষ। কাউকে বললেন বাচ্চা, কারোর তুলনা করলেন পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে। কখনও মুচকি হাসলেন, কখনও হলেন 'সিরিয়াস'। ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনে বিজেপির সদর দপ্তরেই কথা হল। আজ সাক্ষাৎকারের প্রথম কিস্তি।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, তত রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়ছে। চিটফান্ড কেলেঙ্কারি ও নারদা কাণ্ডে তৃণমূল সাংসদদের নাম জড়ানোর সঙ্গেই শাসকদলের নেতাদের নামে গুঞ্জন বেড়েছে বিজেপিতে যোগ দেওয়া নিয়ে। অন্য দলের নেতাদের বিজেপিতে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে কী বলছেন?
'সিজন চেঞ্জ' হলে যেমন ফুটবলাররা ক্লাব চেঞ্জ করেন, তেমনই ভারতের রাজনীতিতে নির্বাচন এলে দলবদল শুরু হয়ে যায়। পশ্চিমবাংলায় সিপিএম-কংগ্রেস যেভাবে ডুবে যাচ্ছে, যাঁরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে বা তৃণমূলের অপশাসন দূর করতে চান, তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই বিজেপিকে বিকল্প বাছবেন। এরকম বহু লোক আমাদের দলে এসেছেন, আসছেন, আসবেন।
বিভিন্ন দলের নেতা, যাঁরা ভাবছেন ওই দলে থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে এমপি, এমএলএ হতে পারবেন না, তাঁরাও বিজেপিতে আসছেন। বা অন্য কোনও রাজনৈতিক কারণে আসছেন। তাঁদের আমরা নিয়েছি। আমাদের দরজা খোলা রয়েছে। কেউ যদি বিজেপির আদর্শ মেনে কাজ করতে চান, কোনও অসুবিধা নেই। এখন তো বিধানসভায় দেখা হলে অনেকেই জিজ্ঞেস করেন, 'দিলীপদা, কেমন আছেন?' আগে তো পাত্তাই দিতে চাইতেন না। ওই নৌকা ডুবলেই এই নৌকায় পা দেবেন বলে আগাম রাস্তা খোলা রাখতে চান।
আরও পড়ুন: ‘এমনও তো হতে পারে, মমতাকে জেলে যেতে হল’
রাজনীতিতে চর্চা রয়েছে, ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে আসন জয়ের ব্যাপারে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির একটা বোঝাপড়া হয়েছিল, যা শেষ অবধি মানে নি তৃণমূল কংগ্রেস। সারদা-নারদা নিয়ে আঁতাতের কথা কান পাতলেই শোনা যায়। মোদি-দিদি আঁতাত নিয়ে গুঞ্জন শুধু রাজনৈতিক মহলে নয়, সাধারনের মধ্যেও রয়েছে। এটা ঘুচবে কী করে?
এই গুঞ্জনটা সিপিএম কংগ্রেস করছে। তাদের অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টায়। বলতে চাইছে যে বিজেপি-তৃণমূল এক। কেন আপনারা বিজেপিকে আনছেন? কারণ বিজেপিতে ওঁদের সদস্যরা চলে আসছেন বাঁচবার জন্য। কিন্তু আমরা যদি তৃণমূলকে তেল মেরে জিততাম, তাহলে আমাদের ৩৯ জন মারা যেতেন না। হাজার লোক কেস খেতেন না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, লড়াই করছি। আমাদের গণতন্ত্র যাত্রা করতে দিত। তাতে কী ছিল? গণতন্ত্র যাত্রা এমন একটা যাত্রা, যদি হয়, তাহলে রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে। তৃণমূল সেটা বুঝতে পেরেছিল। সেজন্য এটা বন্ধ করে দিয়েছে। কংগ্রেস-সিপিএম সান্ত্বনার জন্য, আত্মতুষ্টির জন্য এসব কথা বলতে পারে। এতে ওই দুই পার্টি বাঁচবে না। নেতারাও বাঁচবেন না। সব বিজেপিতে যোগ দেবেন।
লোকসভার আসন জয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব টার্গেট দিয়েছেন রাজ্য বিজেপিকে। ২২ টির পর পুরুলিয়ায় গিয়ে আর একটি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। আদৌ লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন আপনারা?
২২টার বেশি আসনে জিতব বলে লড়ছি। এটাই আমাদের প্রথম থেকে সংকল্প। ধীরে ধীরে আমাদের ভোট বাড়ছে। পুরুলিয়া জেলার কথা যদি বলি, সেখানে আমাদের সাত শতাংশ ভোট ছিল। পঞ্চায়েতে নির্বাচনে তা ৩৫-৪০ শতাংশে পোঁছে গিয়েছে। তাও তো স্বচ্ছ ভোট হয় নি। পশ্চিমবাংলায় রাজনৈতিক পরিবর্তন মাটির তলায় হয়ে গিয়েছে। তাই তৃণমূল পঞ্চায়েতে রক্তাক্ত রাজনীতি করেছে। তাদের বদনাম হয়েছে। ভয়ে পেয়েছে বলেই ১৭টা পুরসভা আর দুটো কর্পোরেশনের ভোট পিছিয়ে দিয়েছে। কারণ তৃণমূলকে ভোট দেবে না কেউ।
এমতাবস্থায় মারপিট করে, খুনোখুনি করে ভোট নিতে হবে। কিন্তু তাহলে লোকসভা ভোটে ইমেজ খারাপ হয়ে যাবে। তৃণমূল পিছোচ্ছে। বিজেপি এগোচ্ছে। এটা তার প্রমাণ। লোকসভায় আমাদের কত আসন হবে তা নিয়ে কেউ ১২ টা বলছেন, কেউ ১৬ টা বলছেন। কেউ ৫-১০ টা বলছেন। ওঁদের কাজ ওঁরা করুন। আমাদের কাজ আমরা করছি। আমাদের পুরো আত্মবিশ্বাস, ৫০ শতাংশের বেশি আমন আমরা জিতবো।
এরাজ্যে এখন সোজা হিসাব - বিরোধী ভোট কাটাকাটি করতে পারলে জয় পাওয়া সহজ হয় শাসক দলের পক্ষে। বিরোধী ভোট একত্র হলে কি তৃণমূলকে হারানো যাবে? স্থানীয় স্তরে আঁতাত করবেন কি?
কোনও অ্যাডজাস্টমেন্ট হবে না। তবে সমস্ত বিরোধী ভোট বিজেপির ঝান্ডার তলায় আসবে। এটাই অ্যাডজাস্টমেন্ট। কারণ মানুুষ চাইছেন তৃণমূলকে সরাতে। সেই কাজ একমাত্র বিজেপিই পারবে। আজ সিপিএম-কংগ্রেসের ভোট সংখ্যা কেন কমে গেল? বিজেপির ভোট কারও কেনা ভোট নয়। টিএমসির ভোট কাটাকাটি হবে। সেটা হচ্ছে সংখ্যালঘু ভোট। গতবার তৃণমূল ২০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বাকি আট শতাংশ পেয়েছে সিপিএম-কংগ্রেস। মালদায় পেয়েছে, কেউ দিনাজপুরে পেয়েছে, মুর্শিদাবাদে পেয়েছে। সেই সিপিএম-কংগ্রেসের সংখ্যালঘু ভোটটা তৃণমূলের দিকে যাচ্ছে।
টোটাল তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটে আমরাও ভাগ বসাচ্ছি। অনেক সংখ্যালঘু সিপিএম পার্টির নেতা আমাদের হয়ে কাজ করছেন। আমাদের দলে এসেছেন, সফলভাবে কাজ করছেন। প্রাক্তন এমপি, এমএলএ-রা আসছেন। ব্যাপকভাবে দলে আসছেন। এলাকার পুরো পরিবর্তন হচ্ছে। এই যে সংখ্যালঘু ভোট, তৃণমূল ভাবছে গরম গরম কথা বলে, বিজেপিকে গালাগালি দিয়ে একচেটিয়া ভোট পাবে। সেটা আর হবে না। তাদের হিসাবটাই গন্ডগোল হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: ‘যে সিপিএম-কে হারিয়েছেন, সেই সিপিএম-কে আর ফেরত আসতে দেব না’
অমিত শাহর সভাতে সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহকে দেখা গিয়েছে। তবে কলকাতা শহরে যাঁদের বুদ্ধিজীবী বলা হয়, তাঁদের আপনাদের সঙ্গে সেভাবে দেখা যায় না। কেন আসছেন না আপনাদের দলে?
আমি যে কথাটা বলি সেটা লোকের ভাল লাগে না। সত্যি কথা তো। শুনুন, বুদ্ধিজীবীরা পরিবর্তন করেন না। পরিবর্তনের সঙ্গে থাকেন। পরিবর্তন হলে সঙ্গে চলে আসেন। জ্যোতি বসুর সময় কোনও বুদ্ধিজীবী ছিলেন না। বুদ্ধবাবুর সময়ও তাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন লড়াই করেন, জেতেন, তখনও বুদ্ধিজীবীরা সঙ্গে ছিলেন না। পরবর্তী সময় সবাই তাঁর সঙ্গে চলে এসেছেন। এখন কেউ লাল জামা পরেন না। তাঁরাই এখন সবুজ জামা পরছেন।
বুদ্ধিজীবীদের ওপর ভরসা করে রাজনীতি করলে আমরা সফল হতে পারব না। তাঁরা তাঁদের কাজ করুন, আমাদের গাালাগালি করলেও কোনও আপত্তি নেই। আমরা রাজনীতি করি। বুদ্ধিজীবীরা সুখে-দুঃখে মানুষের সঙ্গে থাকেন না। তাই ওই নিয়ে আমরা চিন্তা করি না। কেউ যদি বিনা কারণে আমাদের গালাগালি দেন, আমরা চুপ করে বসে থাকি না। তার উত্তর দেওয়া দরকার। যখন বাংলায় শিক্ষা উঠে যাচ্ছে, খুনখারাপি চলছে, রোজ গুলিগোলা চলছে, তখন বুদ্ধিজীবীদের বলা উচিত। তাঁদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এই প্রশ্নটা তাঁদের কাছে আছে।
রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব কি অস্বীকার করতে পারবেন?
(ভ্রূ কুঁচকে) এসব প্রভাব কিছুই নয়। সরকারে থাকলে নিজের জীবনী লোককে পড়ানো যায়। নিজের কবিতা সরকারি স্তরে ছাপানো যায়। আমরা লালুপ্রসাদকেও (যাদব) দেখেছি। এসব ক্ষমতার দম্ভ। পুলিশ সঙ্গে আছে। মানুষ সঙ্গে নেই। তাই উনি নির্বাচনে যেতে ভয় পাচ্ছেন। এবার তিনি বুঝতে পারবেন।
মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দলের যুব সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি। দলের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি জেলার দায়িত্বে রয়েছেন। যুবরাজ অভিষেকই যে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্তরাধিকারী, অনেকেই তা মনে করেন। কী বলবেন আপনি?
বাচ্ছা ছেলে। তাঁর সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই। এখনও অনভিজ্ঞ। কোলে বসে 'ডায়ালগ' বলার অভ্যাস। দলের মুখ হতে যাচ্ছেন। তবে বাস্তবে কেউ মুখ নয়। বাস্তবে দাঁড়িয়ে লড়াই করতে হয়। তখন কে মুখ, আর কে কী বোঝা যাবে। অন্যের ভরসায় দাঁড়িয়ে লিফটে ছাদে উঠে বড় বড় কথা বলা যায়। হেঁটে চারতলা ওঠো না, তখন বুঝবে!
তিন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সাফল্য এরাজ্যে কংগ্রেসের মরা গাঙে জোয়ার এনেছে। সোমেন মিত্র ময়দানে নেমে পড়েছেন। নির্বাচনে একা চলবে কংগ্রেস...
পিতামহ ভীষ্ম। উনি নিজে অসুস্থ। আশা করবো, উনি সুস্থ হয়ে যাবেন। ভাল কাজ করবেন। অভিজ্ঞ, ভদ্র লোক। কিন্তু ওঁর কী হবে জানি না, কংগ্রেসের কোনও চান্স নেই। সেজন্য ঠিক লোককেই বেছেছে। যেমন পার্টি, তেমন নেতা। এদের থেকে সাধারণ মানুষ কী আশা করবেন? তাই যুবসমাজ রোজ পালিয়ে বিজেপিতে চলে আসছে।
বলছেন কংগ্রেসের জেতা আসন ধরে রাখতে পারবে না?
সিটগুলো যাতে থাকে তার জন্য ওরা তৃণমূলের সঙ্গে লাইন করছে। পার্টি বাঁচানো নিয়ে কোনও চিন্তা নেই, নেতা বাঁচানোর রাজনীতি চলছে। সিপিএমের সঙ্গে গেলে সুবিধা হবে, না তৃণমূলের সঙ্গে গেলে সুবিধা হবে? যেদিকে গেলে সুবিধা হবে, সেদিকে যাবে। কখন কী স্টেটমেন্ট দিচ্ছে বোঝাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি কিষান ও ক্ষেতমজুরদের নিয়ে মিছিল করেছে সিপিএম। ফের নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। এরাজ্যে লোকসভায় সিপিএমের দুটো আসন দখলে রয়েছে। সেগুলো কী হবে?
বিরোধী সিট বলতে বিজেপির থাকবে। বাকি তৃণমূলের থাকবে। অন্যদের থাকার কোনও সম্ভাবনা নেই। সূর্যবাবু (সূর্যকান্ত মিশ্র) এক কথা বলছেন, বিমানবাবু (বিমান বসু) অন্য কথা বলছেন। প্রদীপবাবু (প্রদীপ ভট্টাচার্য) এক কথা বলছেন, সোমেনবাবু আর এক কথা বলছেন। এগুলো হচ্ছে 'কনফিউজড পলিটিক্স'। কী করবেন ঠিক করতে পারছেন না। জল মাপছেন। শেষ মুহূর্তে ঝাঁপ দেবেন। দুটোই ফুটো নৌকো, কোনও চান্স নেই।
ভবিষ্যতে বিজেপি একদিকে। বাকি কংগ্রেস, সিপিএম ও তৃণমূল অন্য দিকে। এমন সম্ভাবনা আছে কি?
আমরা চাইছি এটা পরিষ্কার হয়ে যাক। এঁরা একদিকে চাইছেন বিজেপিকে আটকাতে। সারা দেশে যেমন হচ্ছে। মানুষের বুঝতে হবে। এটা কনফিউজ করছে। আমরা চাইছি সিপিএম, কংগ্রেস, তৃণমূল একসঙ্গে আমাদের সঙ্গে লড়াই করুক। অলরেডি ব্রিগেডের সভায় সবাইকে ডেকেছেন। আসুন সবাই। এ লড়াই বাঁচার লড়াই। যাঁরা বাচতে চান তাঁরা ওদিকে যাবেন। আমরা বাঁচতে চাই না, আমরা জিততে চাই। আমরা জিতবো।
২০১৯ লোকসভা ভোটে আপনাদের কী হবে, রাজ্য স্তরে বা জাতীয় স্তরে?
এটা ঠিক, পশ্চিমবাংলার গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে কেন্দ্রের কাছে। আর সেই গুরুত্বের মর্যাদা দিয়ে আমরা তার ফল দেব। এটাও ঠিক যে দেশের প্রধানমন্ত্রী আর একবার নরেন্দ্র মোদীই হবেন। কোনও শক্তি তা আটকাতে পারবে না।
২০২১ বিধানসভা ভোটে কী হবে? পদ্ম ফুটবে এই রাজ্যে?
২০১৯ থেকে তার সূচনা বোঝা যাবে। আমরাও মানুষকে বুঝিয়ে দিতে চাই। আমরাই আসছি, আমরাই বিকল্প।
(পড়ুন, দিলীপ ঘোষের সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব: 'অমিত শাহকে ফোন করার প্রয়োজন পড়ে না আমার')