একসময় সিপিএম নেতৃত্বের একাংশের খুবই স্নেহধন্য় ছিলেন। কিন্তু ক্রমে প্রশ্ন উঠেছিল তাঁর বিলাসবহুল জীবনযাপন নিয়ে। বর্তমানে, সিপিএমের এককালের যুব আইকন তৃণমূল কংগ্রেসের কট্টর সমর্থক। মুখ্য়মন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের উন্নয়ন কর্মসূচিতেও সামিল তিনি। "ঝান্ডা না ধরলে কি তৃণমূল করা যায় না?" সোজা প্রশ্ন ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সিপিএমের ভবিষ্য়ৎ কী? যে দল তাঁকে সাংসদ করেছে সেই সিপিএম সম্বন্ধে বললেন, "সাইনবোর্ড নয়, ভিজিটিং কার্ড হয়ে যাবে সিপিএম।" এমন আরও অনেক অকপট কথা ঋতব্রত বললেন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধি জয়প্রকাশ দাসকে।
দেশ ও রাজ্য়ের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএমের হাল খুবই খারাপ। তবু কী এমন হয়েছিল যে দল থেকে বহিষ্কার করা হল এক সাংসদকে? যেখানে এই মুহূর্তে এই রাজ্য় থেকে সিপিএমের রাজ্য়সভায় কোনও সাংসদ নেই?
সিপিএমের একটা প্রচন্ড পছন্দ, অপছন্দের বিষয় রয়েছে। সেই শিকড় খুব গভীর। আমি এটা বিশ্বাস করি। আমি সিপিএম ছাড়িনি। পরিস্থিতি তৈরি করে বহিষ্কার করা হয়। অনেকে আমাকে বলেছে আপনি সংসদে এত বেশি অ্যাকটিভ না হলে এত সমস্য়া হত না। সিপিএমের নির্দিষ্ট কোটারির লোকেরা এই কাজ করেছেন। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র করে আমাকে সরিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছিল আপনার পেন এবং ঘড়ি নিয়েও!
আমি কী পরব, কী পরব না, তা অন্য়রা ঠিক করে দেবে? আলিমুদ্দিনের যে সব নেতারা এসব বলেছেন, তাঁদের ব্য়বহার করা জিনিস দেখেছেন? তাঁরা সব অ্য়াপেল ফোন ব্য়বহার করেন। ওটাও ছিল সিপিএম নেতাদের বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের একটা অংশ।
এখন সিপিএমের ভেতরে যে ক্রাইসিস তৈরি হয়েছে, কী বলবেন আপনি?
ক্রাইসিস তো তৈরি হয়েছেই। সিপিএম বহুত্ববাদকে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়।.সংসদীয় রাজনীতিতে বহুত্ববাদকে স্বীকৃতি দিতে রাজি না হওয়ায় যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আসনের মূল্য় নেই, তাহলে ভোটে লড়ব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। গতবছর সিপিএম পার্টি কংগ্রেসের নিজেদেরই তথ্য অনুযায়ী, ষাট হাজার সদস্য় পার্টি ছেড়ে দিয়েছেন। সদস্য়পদ পুনর্নবীকরণ করেননি। এঁদের দল ছেড়ে দেওয়াটাকে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হল না। দল বলল, এঁরা কাজ করতেন না। ছেড়ে দিয়েছেন ভাল হয়েছে। এটা তো বিশ্বাস করা সম্ভব নয় যে ষাট হাজার লোক ভয় পেয়ে দল ছেড়ে দিলেন। সিপিএম নেতৃত্বের মূল সমস্য়া, এঁরা ডিনায়াল (denial) মোডে রয়েছেন। অবাস্তব কথা বলছেন।
CPIM MP Ritabrata Banerjee campaigns with Comrade @Sujan_Speak in #Jadavpur #LeftforBengal @RitabrataBanerj pic.twitter.com/H4jQbWPTBQ
— Left for Bengal (@leftforbengal) March 28, 2016
সিপিএম যুবনেতা ছিলেন যখন
সিপিএমের মূল প্রতিপক্ষ বিজেপি না তৃণমূল?
বিজেপিকে হারাতেই হবে। সীতারাম ইয়েচুরি পার্টি কংগ্রেসে বলে দিলেন, এটাই পার্টির মূল লক্ষ্য়। আমি একদিকে বলব বিজেপিকে হারাতে হবে, অন্য় দিকে বলব আগে তৃণমূলকে হারাও, তাহলেই বিজেপিকে হারানো যাবে। এটা একটা সোনার পাথরবাটির মত ব্য়াপার হয়ে যাচ্ছে।
সিপিএমের কাছে একটাই পথ, তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করা। সম্প্রতি কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএমের ২০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জামানত খুইয়েছেন। ওই ভোটে সিপিএম বলল, বিজেপি বিরোধী শক্তিকে ভোট দিন। অর্থাৎ কংগ্রেসকে ভোট দিন। কর্নাটকে যদি কংগ্রেসকে ভোট দিতে বলতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে তো তৃণমূল শক্তিশালী। এ রাজ্য়ে বিজেপিকে যদি ঠেকাতে হয় তাহলে তৃণমূলকে ভোট দিতে হবে।
সিপিএমের সঙ্গে বিজেপির কোনও সম্পর্ক রয়েছে?
সমস্য়া হল মুখে নেতারা যাই বলুন, রাজ্য় জুড়ে বিজেপির সঙ্গে সিপিএমের একটা অনৈতিক জোট হয়েছে। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে সিপিএম নেতারা অস্বীকার করতে পারেন, কিন্তু রাজ্য় কমিটির সদস্য় বিধায়ক রমা বিশ্বাস নদীয়ায় বিজেপিকে ভোট দিতে বলেছেন। সে ঘটনার ছবি আছে। তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্য়বস্থা নেওয়া হয়েছে? হয়নি। পুরুলিয়ায় সিপিএমের একটা বড় অংশ বিজেপিতে চলে গিয়েছে। সিপিএমের যে নেতৃত্ব বিজেপি এবং মাওবাদীদের সঙ্গে গাঁটাছড়া বেঁধেছেন, তাঁদের দল প্রমোট করছে। এর সঙ্গে যুক্ত দুই লিডারকে সেন্ট্রাল কমিটিতে নিয়েছে।
আপনার সঙ্গে সিপিএমের একটা অংশের এখনও খুব ভাল যোগাযোগ রয়েছে।
আমার সঙ্গে সমস্ত জেলার সিপিএম নেতা-কর্মীদের যোগাযোগ রয়েছে। বিশেষ করে গ্রাউন্ড লেভেল কর্মীদের সঙ্গে। সিপিএমের এখন দুটি অংশ। একটি বিজেপি বিরোধী, একটি মমতা বিরোধী। এই মুহূর্তে ফ্য়াসিজম আমাদের সামনে সব থেকে বড় বিপদ। অর্থাৎ বিজেপিকে ঠেকাতে হবে। সিপিএম এখন আঞ্চলিকবাদে বিশ্বাস করছে।
সিপিএম তো কমিউনিষ্ট পার্টি। আঞ্চলিকবাদের অভিযোগ কেন করছেন?
চেন্নাইয়ের একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে ছিলেন সিপিএমের সাধারন সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিও। তিনি বক্তব্য়ে সিপিএম তামিল ন্য়াশনাল রাইটসকে সাপোর্ট করেছেন। শুনে আমার আকাশ থেকে পড়ার মত অবস্থা। পার্টিতে থাকাকালীন আমি জয় বাংলা বলার জন্য় পার্টি নেতৃত্ব বলেছিলেন আমি প্রাদেশিক। জয় হিন্দ বলারও বিরোধিতা করেছিল দল। সীতারাম যখন বললেন তখন প্রাদেশিক নন, আমি জয় বাংলা বলায় প্রাদেশিক হয়ে গেলাম?
আমাকে প্রাদেশিক বললে আমার মুকুটে পালক বলে মনে করব। আমার কাছে সবসময় বাঙলা প্রায়োরিটি পায়। পার্লামেন্টেও তাই। আমি যে একজন গর্বিত বাঙালী এটা আমি সবসময় বলি। এমন নয় যে এটা এখন বলছি। সবসময় বলেছি। আমার প্রায়োরিটি সব সময় বাঙলা। সংসদেও রেকর্ড ঘাঁটলে দেখতে পাবেন, বেঙ্গল ইস্য়ুতে আমি সরব হয়েছি। সিপিএমে থাকাকালীন বলেছিলাম ডিভিসি জল ছাড়ায় বন্য়া হয়েছে। সেজন্য় পার্টি আমার কঠোর নিন্দা করেছিল। বলেছিল মমতার পক্ষে বলেছি। মূল কথা হলো, এটা বাংলার স্বার্থে বলেছি। ডিভিসি জল ছাড়ায় বাংলার মানুষের সমস্য়া হচ্ছে, এটা তো বাস্তব।
রাজনৈতিক মহলে খবর, আপনি তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন।
আমায় কি ঝান্ডা তুলে বলতে হবে আমি তৃণমূল? রাজ্য়ের বহু মানুষ যেমন তৃণমূলকে সমর্থন করেন, আমিও তাই। আমার অবস্থান সম্পূর্ণ ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে। আমি জয় শ্রীরাম বলার লোক নই। একাধিক এজেন্ডায় আমি তৃণমূলকে সমর্থন করি। রাজ্য়সভার ডেপুটি চেয়ারম্য়ান নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থী থাকলে আমি তৃণমূলকেই ভোট দেব। বিজেপিকে দেব না। বাংলার পার্টি, বাংলার কোনও এমপি যদি প্রার্থী হন আমার ভোট তাঁর জন্য় থাকবে। সিপিএমের সাধারন সদস্য়রা মনে করছেন মমতা প্রকৃত বামপন্থী। প্রত্য়েক জেলা থেকে সিপিএমের একটা বড় অংশ, বিশেষ করে ছাত্র ও যুব, মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের হাত শক্ত করবে। কোনও জেলা বাদ যাবে না।
#BestBengal surging ahead under @MamataOfficial Humbled to be a part in Didi’s endeavour of transforming the state. More power to #Bengal and her Leader @MamataOfficial pic.twitter.com/7J12GCS9yp
— Ritabrata Banerjee (@RitabrataBanerj) July 6, 2018
বাংলায় কী উন্নয়ন ঘটছে?
এটা স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই, রাজ্য়ে নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হচ্ছে। মুখ্য়মন্ত্রীর উদ্য়োগে এই পরিবর্তন হয়েছে। আমি যে এখন বলছি তা নয়। সিপিএমে থাকতেও বলেছি। মুখ্য়মন্ত্রীর উন্নয়ন নীতিকে সমর্থন করে আসছি। সংসদেও আমার সেই একই ভূমিকা। আগামী দুবছর সংসদে সরব থাকব বাংলা, বাংলার উন্নয়ন নিয়ে। রাজ্য়ের পক্ষে কথা যদি মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের কথা হয়ে যায়, তাহলে বলব আমার কাছে রাজ্য়ই প্রয়োরিটি।
মুখ্য়মন্ত্রীর সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎও করেছেন।
উনি রাজ্য়ের মুখ্য়মন্ত্রী, আমি একজন সাংসদ। স্বাভাবিকভাবে দেখা হতেই পারে। সৌজন্য়মূলক সাক্ষাৎ। মমতার উন্নয়ন কর্মসূচিতে বাংলা বদলাাচ্ছে। ওঁর এই রাজনীতির সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আছি। সেটার জন্য় তৃণমূল করার প্রয়োজন হয় না। কলকাতা থেকে টি বোর্ড সরানো, ডিভিসির হেডকোয়ার্টার, পশ্চিমবঙ্গের দশ হাজার কোটি টাকার বঞ্চনা নিয়ে সংসদে সরব হয়েছি।
অনেকের বক্তব্য়, মুকুল রায়ের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা ছিল।
মুকুল রায়ের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা, এটাতেও সিপিএমের হাত ছিল। সংসদের ট্রান্সপোর্ট, ট্য়ুরিজম, কালচার কমিটির চেয়ারম্য়ান ছিলেন মুকুল রায়। সপ্তাহে ওই কমিটির একটা মিটিং হত। তাই প্রতি সপ্তাহে একবার দেখা হত। সেটাকে এভাবে প্রচার করা হল।
বিজেপির বিরুদ্ধে কী অবস্থান আপনার?
আমি স্ট্রংলি আরএসএসের বিরুদ্ধে। আগেই বলেছি, আমার পক্ষে কখনও জয় শ্রীরাম বলা সম্ভব নয়। আমার পক্ষে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা সম্ভব নয়। আমি রাজনীতি করব না বসে যাব, কিন্তু বিজেপি করব না। আর বাংলার রাজনীতি হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি। বিজেপির কাছে সব থেকে বড় থ্রেট মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। বিজেপি অবাঙালি পার্টি, বাংলার মাটিতে অবাঙালি পার্টির জায়গা নেই। লোকসভা নির্বাচনেও হারবে।
২০১৯ লোকসভার নির্বাচনে সিপিএম আসন পাবে এই রাজ্য়ে?
বিভিন্ন জেলায় পঞ্চায়েতে যারা বিজেপির প্রার্থী হয়ে জিতেছেন তাঁরা এখনও সিপিএমের পার্টি মেম্বার। বিজেপির অরিজিন্য়াল লোক কটা? বাম-রাম জোট ছা়ড়া সিপিএম সাইনবোর্ড নয়, ভিজিটিং কার্ড হবে। ২০১৯-এ সিপিএম সিট পাবে না। এর জন্য় দায়ী সিপিএমের একশ্রেনীর নেতারা।
মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় প্রধানমন্ত্রীর হওয়ার কোনও সম্ভাবনা রয়েছে?
লোকাল কংগ্রেসের নেতারা সিপিএমের সঙ্গে যেতে আগ্রহী। তাই যা হওয়ার হবে। রাজ্য় থেকে ৪২টা সিট নিয়ে লোকসভায় গেলে প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায় হবেন না কেউ গ্য়ারান্টি দিয়ে বলতে পারে? অধীর চৌধুরীর আসন হারবে। ৪২ -এ ৪২ হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।