শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলা শেষ হলো শুক্রবার, আর রাজ্য সরকারের উদ্যোগে বোলপুুরে ঢোকার মুখে শিবপুরে প্রথম গীতবিতান মেলা শুরু হলো আজ, শনিবার। এবছর পরিবেশ সংক্রান্ত কারণে আদালত পৌষ মেলার মেয়াদ তিনদিনের বদলে ছ'দিন করার অনুমতি দিয়ে নির্দেশ দেয়, ছ'দিন পরে যেন ভাঙা মেলার অজুহাত দিয়ে কোন স্টল না থাকে, এবং জেলাশাসককে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এবার শুক্রবার ভুবনডাঙার মাঠ থেকে স্টল সরিয়ে নিয়ে গিয়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে শিবপুরের মাঠে মেলায় যোগ দিলেন দোকানীরা।
পৌষ মেলার ভিড়ে ক্লান্ত বোলপুরেই হঠাৎ করে সরকারী খরচে আবার মেলা কেন, এই প্রশ্ন উঠেছিল আগেই। এই পরিস্থিতিতে মেলার বিরোধিতা করে মিছিল করছেন এলাকার কিছু মানুষ, যার ফলে আগামী সপ্তাহে সংলগ্ন এলাকায় মুখ্যমন্ত্রীর সফরের আগে কিঞ্চিৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে অঞ্চল।
মেলা উদ্বোধন করে রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী এবং এলাকার বিধায়ক চন্দ্রনাথ সিংহ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে জানান, "ওখানে আগামীতে বড় প্রকল্প হবে। হস্তশিল্পের স্থায়ী দোকানও হবে ২০০ টা। এখন বিজ্ঞাপনের যুগ, তাই আমরা একদিকে চাইছি এলাকাটা মানুষের কাছে তুলে ধরতে, অন্যদিকে দোকানীদেরও স্থায়ী দোকানের জায়গা চেনাতে। কেউ কেউ মিছিলের নামে নাটক করছেন, কিন্তু এভাবে উন্নয়ন আটকানো যাবে না। বিরাট প্রকল্পের কাজ চলছে।"
কেন এই বিরোধিতা, তা জানতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে কিছুটা। শিবপুর মৌজায় শিল্পতালুক গড়ে বাম আমলে জমি অধিগ্রহন করা হয়। বোলপুরের তৎকালীন সাংসদ সোমনাথ চ্যাটার্জি ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। ২০০১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ১১০০ জনের কাছ থেকে প্রায় ৩০০ একর জমি অধিগ্রহন করে বাম সরকার। কিন্তু অল্পকাল পরেই দেখা দেয় একটি বড় সমস্যা। রেল এবং সড়ক যোগাযোগ ভালো থাকায় শিল্প স্থাপনের অনুকূল বলে ওই এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছিল, কিন্তু প্রয়োজনীয় জলের সমস্যা দেখা দেওয়ায় শিল্পের কাজ পিছিয়ে যেতে থাকে।
আরও পড়ুন: জিন্সের প্যান্ট-স্নিকার সহযোগে কীর্তন বীরভূমে, দেখা নেই রাম নামের
একাধিক শিল্পগোষ্ঠী প্রকল্পের কাজে উৎসাহী হয়েও পিছিয়ে যায়। বিদেশী একটি বহুজাতিক সংস্থা ২০০৬ সালের শেষে বিরাট প্রকল্প গড়তে এগিয়ে আসে, কিন্তু সরকারের সহযোগিতার সবরকম আশ্বাস থাকলেও তারা পুঁজির যোগান আনতে সময় বাড়িয়ে নেয়। এরপর সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনে শিবপুরের প্রকল্প ধামাচাপা পড়ে যায়।
সরকার বদলের পর তৃণমূল সরকার সেখানে প্রথমে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প গড়ার কথা বললেও পরে ঐ এলাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী বোলপুরে সভা করে জানান। বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় নামের প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি একটি আবাসন প্রকল্পের ঘোষনাও করেন তিনি।
এতেই ক্ষোভ ছড়িয়েছে জমিদাতা কৃষকদের মধ্যে, যাঁরা মেলার বিরুদ্ধে মিছিল করছেন। তাঁদের বক্তব্য, "আগের সরকার যখন জমি নেয়, আমাদের দাবি ছিল শিল্পে পরিবার পিছু একজনের চাকরি। কিন্তু এখন সরকার শিল্পের নামে নেওয়া জমিতে ফ্ল্যাট বানানোর কথা বলছে। আমরা কি ঐ ফ্ল্যাটে বাসন মাজা, ঘর মোছার কাজ করবো? এলাকার শিক্ষিত বেকার, যাদের পরিবার জমি দিয়েছে, তারা প্রতিবাদ করে দাবি জানালে নেতারা মারধর করছে, পুলিশ দিয়ে সাজানো মামলায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। ভয়ে অনেকে গ্রামছাড়া হয়ে আছে। এ অবস্থায় মেলা আমরা মানব না।"
তাঁদের বিক্ষোভের মুখে পড়ে শাসকদলের নেতারা নাকাল হয়েছেন খবর পেয়ে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ঘটনাস্থলে এসে জেলার সহকারী পুলিশ সুপারকে ডেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে "উন্নয়নের বিরোধিতাকারীদের" বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে বলেন।
বীরভূমের জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু শনিবার এই বিতর্ক প্রসঙ্গে বলেন, "ওটা হিডকোর (পশ্চিমবঙ্গ আবাসন পরিকাঠামো উন্নয়ন সংস্থা) প্রোগ্রাম, ওঁরাই এ বিষয়ে বলতে পারবেন।"
আরও পড়ুন: একা বিমান টেনে চলেছেন লাল রথ, ফের প্রমাণ করল বীরভূম
কলকাতার বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন জমিদাতা কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আইনজীবি এবং বর্ষীয়ান বাম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য তিনবার এলাকায় গিয়ে কৃষকদের আইনি সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে এসছেন। বর্তমানে পুলিশ এবং শাসকদলের কর্মীরা তাঁকে এলাকায় যেতে বাধা দিচ্ছেন, এই অভিযোগ করে বিকাশরঞ্জনবাবু ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে বলেন, "শিল্পের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে নেওয়া জমিতে অর্থবান মানুষদের জন্য আবাসন করছে সরকার, এটা জনস্বার্থে সরকারের কাজ নয়। ওখানে মেলা করার কোন প্রয়োজন নেই। কৃষকদের সঙ্গে জালিয়াতি করা হচ্ছে।"
সরকারের খরচায় মেলা অনেক হয়, কিন্তু এক্ষেত্রে দোকানীরা দেখছেন, মেলার ধারেকাছে কোন জনবসতি নেই, তার ওপর বিক্ষোভ, তাই তাঁরাও কিছুটা বিব্রত। আয়োজনের কমতি নেই। গেট, তোরণ, আলো, অনুষ্ঠান সব আছে, কিন্তু মেলার মেজাজটাই নেই।