কিড স্ট্রিটের এমএলএ হস্টেলকে ডান হাতে রেখে কয়েক পা এগোলেই বাঁদিকে অতিকায় গেট। উপরে লেখা, ইরান সোসাইটি। বাইরে থেকেই আভাস পাওয়া যায় ভিতরের পুরনো আমলের অট্টালিকার। গেটের নিরাপত্তারক্ষীকে সিপিএম নেতা ডাঃ ফুয়াদ হালিম কোথায় থাকেন জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর এল, ''একটু এগোলেই দেখবেন ডানদিকে ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গিয়েছে। দোতলার প্রথম ফ্ল্যাটটাই ওঁর।'' চওড়া সিঁড়ি, স্যাঁতস্যাঁতে। বাড়ির ওই অংশে রোদ ঢোকে না। ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থীর ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজল ঠিক ৮.৫৫ মিনিটে। ইতিমধ্যেই "মার খাওয়ায় হ্যাট-ট্রিক" করে ফেলা বাম প্রার্থী আগের দিন রাতে অনুরোধ করেছিলেন, দেখা করার সময় নটা মানে কিন্তু নটাই। নয়তো তাঁর প্রচারে বেরোতে দেরি হয়ে যাবে।
দেরি করলেন অবশ্য ফুয়াদ নিজেই। মিনিট পাঁচেক। তাঁর একচিলতে অফিসঘর বাহুল্য বর্জিত। ইতিউতি কয়েকটি বই, ব্যাগ, কাগজপত্র। মিনিট দশেকের অপেক্ষায় চোখে পড়ার মতো একটি বিষয়ই নজরে এল। পাশাপাশি শোয়ানো রয়েছে দুটি বই - 'ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস' এবং 'নিশানের নাম তাপসী মালিক'। দ্বিতীয়টির লেখকের নাম কবীর সুমন। বিষয়বস্তু, বাম জমানার শেষ লগ্নে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলন। ফুয়াদ হালিম কি কবীর সুমনের গান শোনেন?
ঠিক ৯.০৫ মিনিটে ফুয়াদ অফিসঘরে এলেন। পরনে কালো শার্ট, হাল্কা রঙের ট্রাউজার। প্রচারে বেরোনোর জন্য তৈরি। জানালেন, তিনি গান শুনতে ভালবাসেন। নানা ধরনের গান। সুমনের গানও রয়েছে প্লে-লিস্টে। প্রশ্ন করা গেল, "আপনি তো আন্ডারডগ। সুপার হেভিওয়েট প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাও এতবার আক্রান্ত হওয়ার কারণ কী?" ফুয়াদ হাসলেন, রিমলেস চশমা চোখ থেকে নামিয়ে জল খেলেন। তারপর বললেন, ''কার ওজন বেশি আর কার কম, সেই হিসেব আপনারা করুন। আমি সিপিআইএম করি। দল নির্বাচনে লড়তে বলেছে, লড়ছি। প্রচারে মানুষের বিপুল সাড়া পাচ্ছি। গ্রাম থেকে গ্রামে হাঁটছি। দেখছি, মানুষের চোখেমুখে স্বস্তি। তাঁরা ভরসা পাচ্ছেন। ভয় ভাঙছে। সেই জন্যই তো আমার উপরে হামলা হচ্ছে। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে ফলাফল আমাদের পক্ষেই যাবে।''
কবে প্রথম আক্রান্ত হলেন? ফুয়াদ বলেন, "আমি তো ইতিমধ্যেই মার খাওয়ার হ্যাট-ট্রিক করে ফেলেছি। প্রথম আক্রান্ত হই নির্বাচনী প্রচারের একদম শুরুর দিকে। তখনও বাড়ি বাড়ি প্রচার বা পদযাত্রা শুরু হয়নি। একটা কর্মীসভায় যোগ দিতে যাচ্ছিলাম। তৃণমূলের গুণ্ডারা চড়াও হল। কমরেডদের মারধর করল। আমিও হাতে চোট পেলাম।" তাঁর কথায়, "প্রচার পুরোদমে শুরু হওয়ার পর ওরা আক্রমণের তীব্রতা বাড়াল। গত ৯ এপ্রিল ভয়াবহ হামলা হল। সুতেরপুল মোড় বলে একটি জায়গায় আমরা প্রচার করছিলাম। নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নেওয়া ছিল। আচমকাই বিরাট বাহিনী আমাদের ঘিরে ফেলে। আমি কিছুক্ষণ কথা বলে নিরস্ত করার চেষ্টা করলাম, লাভ হল না। আমাদের কমরেড বীভৎস মার খাচ্ছেন দেখে আমি এগিয়ে গেলাম। দেখলাম, একজন তৃণমূল কর্মী গালাগালি দিতে দিতে আমার দিকে তেড়ে আসছেন। হাতে একটা বাঁশ। আমার কিছু করার ছিল না, সরাসরি মাথায় আঘাত পড়ল।"
৯ এপ্রিলের ঘটনা নিয়ে একাধিকবার নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছেন বাম নেতারা। অভিযোগ, তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ফুয়াদ জানান, তাঁদের পদযাত্রার ভিডিও রেকর্ডিং করছিলেন কমিশনের কর্মীরা। তিনি কমিশনকে অনুরোধ করেছেন, ওই ভিডিও ফুটেজ দেখে ব্যবস্থা নিতে।
ফুয়াদ তৃতীয়বার আক্রান্ত হয়েছেন বিভাসনগরে। কেমন সেই অভিজ্ঞতা? নুন-চিনি-লেবুর শরবতে চুমুক দিয়ে হাসলেন মেডিক্যালের প্রাক্তন পড়ুয়া। বললেন, "বিভাসনগরে প্রচার করতে চেয়ে কমিশনের অনুমতি চেয়েছিলাম। ওঁরাও সবুজ সংকেত দিয়েছিলেন। কিন্তু আগের রাতে জানালেন. ভুলবশত একই সময়ে তৃণমূলকেও অনুমতি দেওয়া হয়ে গিয়েছে। আমরা রাস্তায় নামতেই যুব তৃণমূলের এক নেতার নেতৃত্বে আমাদের ঘিরে ফেলা হল। কমরেডরা আমাকে ঘিরে ব্যারিকেড করে রাখলেন। তার বাইরে বিরাট সংখ্যক সমাজবিরোধীরা একটানা গালিগালাজ, হুমকি দিতে থাকল। আমরা প্রতিবাদ করায় শুরু হল বেধড়ক মারধর। ১৬ জন কর্মী গুরুতর আহত হলেন। টানা দুঘন্টা আমরা ঘেরাও হয়ে রইলাম। আইসি এলেন, বিডিও এলেন, কেউই ঘেরাও সরাতে পারলেন না। আমরা যদি জমি ছেড়ে দিয়ে চলে যেতাম, সমস্যা হত না। কিন্তু আমরা মাটি কামড়ে থেকেছি। অবশেষে দুঘন্টা পর অবরোধ উঠল। আমরা ফের প্রচার করলাম।"
হাসিম আব্দুল হালিমের ছেলেকে প্রকাশ্যে কোনও গুরুত্বই দিচ্ছে না রাজ্যের শাসকদল। একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর কথায়, ফুয়াদ কোনও প্রার্থীই নন। তার উপর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্রে সিপিএমের সংগঠনও দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়েছে গত কয়েক বছরে। বিরোধী পরিসর দখল করেছে বিজেপি। কিন্তু বাহ্যত দমছেন না ডায়মন্ড হারবারের বামফ্রন্ট প্রার্থী। তাঁর কথায়, ''তৃণমূল পঞ্চায়েত ভোটের মতো পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা লড়াইয়ে আছি। আমার যে প্রতিপক্ষকে হেভিওয়েট বলা হচ্ছে, তিনি গত পাঁচ বছরে এলাকায় কোনও কাজই করেন নি। সেই কারণেই ওরা ভয় পাচ্ছে। আমাকে বারবার মেরে মাঠের বাইরে বের করে দিতে চাইছে। কিন্তু ওরা তা পারবে না।''
রাজনীতিতে আসা কি বিখ্যাত বাবার হাত ধরেই? ফুয়াদ জানান, একেবারেই তেমন কিছু নয়। বিধানসভার স্পিকার হালিমসাহেব ছেলেকে রাজনীতিতে আসতে উৎসাহ দেন নি, নিরুৎসাহীও করেননি। ফুয়াদের কথায়, "বাবার জন্য বাড়িতে রাজনৈতিক পরিবেশ ছিলই। কিন্তু আমি পাড়ার নেতাদের হাত ধরেই দলে আসি। এই এলাকায় যুব সংগঠনের মাধ্যমে কাজ শুরু করেছিলান. তারপর মেডিক্যাল পড়তে গিয়ে ছাত্র ফেডারেশন করতাম। সেই শুরু।"
মার খেয়েও জমি ছাড়ছেন না সিপিএমের ডাক্তার নেতা, কিন্তু তৃণমূল-বিজেপি-র সঙ্গে ইভিএমের লড়াইতে এঁটে উঠতে পারবেন? ফুয়াদের জবাব, ''মাথায় বাঁশের বাড়িটা কয়েক ইঞ্চির তফাতে পড়লে আজ আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। তাই কোনও পিছুটান নেই। আর দুই ফুলে যে ফারাক নেই, তা তো অনুপম হাজরা আর অনুব্রত মন্ডল প্রমাণ করে দিয়েছেন। মানুষের ভয় ভাঙছে। তাঁরা এগিয়ে আসছেন, এটাই আমাদের শক্তি।"