হুগলির চুঁচুড়ায় পেয়ারাবাগানের বিজেপির অফিসঘরে নরেন্দ্র মোদীর ছবির নিচে রাখা পোস্টারের উপর বসে কথা বলছিলেন অরূপ দাস। বলছিলেন ২০১১ সাল থেকে এ অফিস চারবার ভেঙে তছনছ করে দেওয়া হয়েছে, দুবার আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ শাসক তৃণমূলের দিকে। অরূপ দাস এখন এ অফিসের দায়িত্বে। তিনি বিজেপির ওয়ার্ড প্রেসিডেন্টও বটে। বলছিলেন, "একবার আগুন লাগানোর সময়ে তো আমি অফিসের ভিতরেই ছিলাম। পুলিশ কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।"
প্রতিবারই বিজেপির অফিস নিজের পায়ে খাড়া হয়েছে। শেষবার হামলা হয়েছিল ২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি। ২৬ জানুয়ারির মধ্যেই অফিস ফের চলতে শুরু করে। এখন এ অফিস মণ্ডল কার্যালয় হয়েছে। এখান থেকেই লকেট চট্টোপাধ্যায়ের বিজয় মিছিল বেরিয়েছে। বিজেপি মহিলা মোর্চার সভানেত্রী লকেট তৃণমূলের রত্না দে নাগকে ৭৩, ৬৩২ ভোটে হারিয়েছেন।
এখন বিজেপির একটা জেলা অফিসও আছে, সেটা তৈরি হয়েছে বছর খানেক আগে। নিজের তেম্বারে বসে বিজেপি হুগলি জেলার সভাপতি সুবীর নাগ পুরনো দিনের কথা বলছিলেন। "তৃণমূলের সন্ত্রাসের জন্য আমরা অন্যের বাড়িতে মিটিং করতাম, তাও রাতের বেলায়। আমরা হোয়াটসঅ্যাপে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখতাম, জনসভা করতে পারতাম না... কৌশল বদলাতাম নিজেদের।"
সিপিএম জমানায় এই একই পদ্ধতি নিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটারদের তিনি বলতেন চুপচাপ ফুলে ছাপ। বিজেপি সেটা সামান্য বদলে নিয়েছে। সুবীর নাগের কথায়, "এবার ছিল চুপচাপ কমল ছাপ।"
কিন্তু শুধু ভোটাররাই চুপচাপ বিজেপিকে জিতিয়ে আনেননি এবার। কিছুটা বুথ ম্যানেজমেন্ট, রজ্যের সর্বত্র নিজেদের উপস্থিতির মাধ্য়মে যেখান থেকে যতটুকু সম্ভব সাহায্য নিয়েছে বিজেপি এমনকী সিপিএমের অভিজ্ঞ কর্মীদের কাছ থেকেও। কোনও কোনও বামপন্থী ক্যাডাররা এ কাজ করেছেন খোলাখুলি, কেউ কেউ আড়ালে থেকে। উদ্দেশ্য় তৃণমূলের বিরুদ্ধে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখা।
ছিল মুকুল রায় ফ্যাক্টরও। আর শেষ ধাক্কা দিয়েছিলেন মোদী-শাহ জুটি, যাঁরা দুজনে ১৭টা করে সভা করেছেন, সাত দফার ভোটে একবারও বাংলা থেকে নজর হঠাননি। ২৯ এপ্রিলের সবায় মোদী ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মমতার ৪০ বিধায়ক বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।
ভোটের ফল বেরোনোর দুদিন পর ৪০ সংখ্যাটা নিয়ে কেউ আর বিদ্রূপ করছে না। কেউ কেউ তো এও বলছেন তেমন বিধায়কের সংখ্যা ১০০ ও হতে পারে। তৃণমূল কংগ্রেসের এখন ২১১ জন বিধায়ক রয়েছেন।
সুবীর নাগ বলছিলেন নেতৃত্ব তাঁদের বলেছিল সংগঠন মজবুত করতে, হাওয়া ওঠানোর দায়িত্ব নেতাদের।
২০১৪ সালে লোকসভা ভোটজয়ের পর বিজেপির পশ্চিমবঙ্গে উপস্থিতি জোরদার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। হিন্দি বলয় জয়ের পর পার্টির লক্ষ্য ছিল বাংলা। ১৪-র ভোটে ১৬.৮০ সথাংশ ভোট এবং দুটি আসন পাওয়ার পর বিজেপি এ জায়গায় সম্ভাবনা দেখেছিল। ১৪ সালে দলের সমস্ত কাজকর্ম হত নেতাদরে বাড়ি থেকে, বড়সড় মিটিংয়ের জন্য ভাড়া নেওয়া হত বিয়েবাড়ির হলগুলি। সে সময়েই সিদ্ধান্ত হয় জমি কিনে প্রতি জেলায় আধুনিক অফিস বানানো হবে। কলকাতা, হাওড়ার মত শহরে, যেখানে জমি কেনা সম্ভব নয়, সেখানে বাড়ি কিনে সে বাড়িকেই অফিস বানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ২০১৫-র বিধানসভা ভোটে বামেদের ভোটহ্রাসের পর এ সিদ্ধান্তের উপর জোর দেওয়া হয়।
পাঁচ বছর পর বিজেপি সে সিদ্ধান্ত প্রায় পুরোটাই কার্যকর করেছে। নদিয়ার রাণাঘাটে দোতলা বাড়িতে শীতাপনিয়ন্ত্রিত ৫০০ জনের বসার মত সেমিনার হল রয়েছে, নেতাদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা রয়েছে, রয়েছে কনফারেন্স রুম, যুব মোর্চা, মহিলা মোর্চা, আইটি সেলের জন্য আলাদা ঘর রয়েছে, এমনকি পার্টির নেতা-কর্মীদের থাকার আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে, রয়েছে ক্য়ান্টিনও।
হরিয়ানার এক নেতার কাজ দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন বিজেপি নেতারা। বিজেপি জাতীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাশ বিজয়বর্গীয় ২০১৫ সালের জুলাই মাসে তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের সহকারী পর্যবেক্ষক মনোনীত করেন। রাজ্য বিজেপির এই ফলের জন্য তাঁকে কৃতিত্বের ভাগীদার বলে মনে করা হচ্ছে। তিনি বলছিলেন, "আমাদের বুথ পর্যায় পর্যন্ত সংগঠন রয়েছে এবং রাজ্যের সব জেলায় পরিকাঠামোও রয়েছে।"
বিজেপির হাওড়া টাউন জেলার সভাপতি সুরজিৎ সাহা বললেন, আমাদের বুথ কমিটির দেখভাল করার জন্য পান্না প্রমুখ রয়েছে, পাঁচ থেকে সাতটি বুথ কমিটি দেখভাল করার জন্য রয়েছে শক্তি কেন্দ্র এবং প্রতিটি মণ্ডলের দায়িত্ব ৯ থেকে ১২টি শক্তি কেন্দ্র দেখভালের।
রাজ্যস্তরের নেতা প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, "২০১৪ সালে রাজ্যের ৭৭ হাজার বুথের অর্ধেকে আমাদের কোনও সাংগঠনিক শক্তি ছিল না। এখন আমাদের ৭২ হাজার বুথ কমিটি আছে, ১৩০০ শক্তি কেন্দ্র রয়েছে। বেশ কিছু বুথে আমরা পান্না প্রমুখদের ৩০ জন ভোটারের দায়িত্ব নেওয়ার ট্রেনিংও দিয়েছি।"
ঝাড়গ্রাম জেলা সম্পাদক দীপক বেরা বললেন, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের পর তাঁরা সেখানে অফিস তৈরির কাজ সম্পন্ন করেছেন। দোতলা সে অফিসে আইটি সেল, কনফারেন্স রুম এবং চেম্বার রয়েছে।
ঝাড়গ্রামে ৭৯টির মধ্যে ৩৫টিতে পঞ্চায়েত বিজেপির দখলে, ৯টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে দুটি এবং ১৬টি জেলা পরিষদের মধ্য়ে ২টি পেয়েছে তারা। এখানে লোকসভায় প্রার্থী হয়েছিলেন খড়গপুর আইআইটি-র এঞ্জিনিয়র কুনার হেমব্রম। তিনি তৃণমূলের বীরবাহা সোরেনকে ১১,৭৬৭ ভোটে হারিয়েছেন।
দলের সাধারণ সম্পাদক প্রতাপ বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, "২০১৪ সালে তাঁদের সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ থেকে ১২ লাখ। শয়ে শয়ে তৃণমূল ও সিপিএম কর্মী আমাদের দলে যোগ দিয়েছেন। এখন আমাদের সেলফোন সদস্য় সংখ্য়া ৪২ লক্ষের কাছাকাছি।"
খোলাখুলি না হলেও বিজেপি স্বীকার করছে তৃণমূল স্তরের বাম কর্মীরাই ভোটের দিন তাঁদের প্রধান চালিকাশক্তি ছিলেন।
শেষ দফার ভোটের দুদিন আগে দমদম, বারাসত ও বসিরহাট বিধানসভার সিপিএমের বেশ কিছু দফতর ছিল তালাবন্ধ। সামান্য কয়েকটি অফিসে হাতেগোণা কয়েকজন কর্মীর দেখা মিলেছিল।
সেদিনই নাগের বাদারে কথা হচ্ছিল দক্ষিণ দমদম এরিয়া কমিটির পার্টি অফিস সম্পাদক গোপাল নাগ চৌধুরীর সঙ্গে। ৪৬ বছরের গোপাল নাগ চৌধুরী ২২ বছর ধরে সিপিএমের সঙ্গে রয়েছেন। "অনেকে তৃণমূল কংগ্রেসের হাত থেকে বাঁচতে বিজেপিতে যোগ দিয়েছে। আমরা বলেছি চোর তাড়াতে ডাকাত এনো না। বিজেপি-তৃণমূল দুপক্ষই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে।"
বসিরহাটের প্রাক্তন সাংসদ অজয় চক্রবর্তীর পুত্র শান্তনু চক্রবর্তী এক সময়ে সিপিআইয়ের রাজ্য কমিটির সদস্য ছিলেন। এখন তিনি বিজেপির জেলা সম্পাদক। দু বছর আগে বসিরহাটে দাঙ্গা হয়েছিল। তার আগেও এ জায়গা মুসলিম মৌলবাদীদের আখড়া হয়েছিল। এর সঙ্গে ছিল তৃণমূলের সন্ত্রাস। আমাদের মত অনেকেই বিজেপিতে যোগ দিয়েছে।
একদা সিপিএমের ব্রাঞ্চ কমিটির সদস্য তাপস ঘোষ ২০১৬ সালে বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। এখন তিনি দলের ওয়ার্ড প্রেসিডেন্ট। তিনি বললেন, "আমরা বামপন্থী কর্মীদের বলেছিস আগে নিজের জীবন বাঁচাও তার পর ইনকিলাব জিন্দাবাদ কোর। আমাদের সঙ্গে এক হাজারেররও বেশি বাম কর্মী বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বসিরহাটের অধিকাংশ বুথে আমরাই বিজেপির পান্না প্রমুখ, বুথ সভাপতি, শক্তি কেন্দ্র প্রমুখের দায়িত্বে।"
Read the Full Story in English