Advertisment

'শহিদ' হয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, কেন একথা বলে আরএসএস?

২৩ জুন মারা যান।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
SC verdict on Article 370: Lal Chowk

সুপ্রিম কোর্ট ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারের সিদ্ধান্তে অনুমোদন দেওয়ার পর শ্যামাপ্রসাদ ফের প্রচারের আলোয়। (পিটিআই)

সুপ্রিম কোর্ট জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে সিলমোহর দেওয়ায় ফের প্রচারে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ১১ ডিসেম্বর, সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ৩৭০ প্রত্যাহারের পক্ষে রায় দিয়েছে। যা ফের প্রচারের আলোয় টেনে এনেছে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। কারণ, তিনিই প্রথম ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের দাবিতে ভারতব্যাপী আন্দোলনে নেমেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯০১ সালের ৬ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছেলে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিইউ) উপাচার্যও হয়েছিলেন। একটি উজ্জ্বল একাডেমিক কেরিয়ার ছিল শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। যা তাঁকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে লন্ডনের লিংকনস ইনে নিয়ে গিয়েছিল।

Advertisment

মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ উপাচার্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। তিনি ১৯২৯ এবং ১৯৩০ সালে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে নির্বাচিত হন। প্রথমে কংগ্রেস থেকে জিতেছিলেন। পরে, নির্দল হিসেবে জয়ী হন। ১৯৩৯ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে তিনি হিন্দু মহাসভায় যোগ দেন। দুই বছর পরে তিনি মুসলিম লিগের ফজলুল হকের প্রগতিশীল জোট সরকারে যোগদান করেন। তবে, সরকারের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য ছিল। তিনি ১৯৪২ সাল পর্যন্ত সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এই বলে তাঁর সরকারে যোগদানের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন যে, হিন্দুদের সংগঠিত করা এবং হিন্দু-মুসলিম, এই দুই সম্প্রদায়ের যৌথভাবে কাজ করায় বিশ্বাসী মুসলমানদের সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। ব্রিটিশদেরকে লেখা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বিরুদ্ধে শ্যামাপ্রসাদের একটি বিতর্কিত চিঠিও সেই সময়ে অনেকের সমালোচনার মুখে পড়ে।

১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হিন্দু মহাসভার সভাপতি ছিলেন। দেশভাগের সময় বাংলার হিন্দুদের জন্য কাজ করেন। তিনি মুসলিম লিগ নেতা ও বাংলার প্রধানমন্ত্রী এইচ এস সোহরাওয়ার্দীর ইউনাইটেড বেঙ্গল পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। পরিকল্পনাটি ছিল, ভারত-পাকিস্তান দুই দেশ থেকে স্বাধীন একটি পৃথক বাংলা রাজ্য গঠন। যাকে শ্যামাপ্রসাদ, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দ্বারা হিন্দুদের ওপর আধিপত্য ফলানো ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেননি। পরিবর্তে, তিনি হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের মধ্যে রেখে বঙ্গভঙ্গের আহ্বান জানান।

তিনি একজন হিন্দুত্ববাদী মধ্যপন্থী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পর, তিনি মহাসভার ওয়ার্কিং কমিটিকে প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য করেন যে, 'গান্ধীর হত্যাকারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে যাতে তারা লজ্জা প্রকাশ করে। আর, যে কোনও ভাবে নাশকতামূলক কার্যকলাপ দমনের জন্য যাতে ভারত সরকারের প্রতি সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেয়।' বিডি গ্রাহাম তাঁর হিন্দু জাতীয়তাবাদ এবং ভারতীয় রাজনীতি বইতে এই কথা লিখেছেন। সেই শ্যামাপ্রসাদই কিন্তু, ১৯৪৮ সালের নভেম্বরে মহাসভা থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ, দল তাঁর পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেছিল। শ্যামাপ্রসাদ প্রস্তাব দিয়েছিলেন, হিন্দু মহাসভা কেবল একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন হয়ে রাজনীতি থেকে দূরে থাকুক। আর, যদি আধুনিক রাজনৈতিক দলও হতে চায়, তবে যেন অমুসলিমদের হয়েই কাজ করে। কিন্তু, সেই সব প্রস্তাব মহাসভা মানেনি।

দেশভাগের পরেও তিনি বাঙালি হিন্দুদের জন্য ন্যায়বিচারের দাবিতে অটল ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দু 'নিপীড়ন'-এর বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন। সে সময় জওহরলাল নেহেরু সরকারের শিল্প ও সরবরাহ মন্ত্রী ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। কিন্তু, নেহরু-লিয়াকত চুক্তি নিয়ে মতপার্থক্যের কারণে ১৯৫০ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। পরের বছর আরএসএস স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় ভারতীয় জনসংঘ গঠন করেন। আর, ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। নতুন দলটি মাত্র তিনটি আসন জিতেছিল।

এর আগে ১৯৪৭ সালে যুদ্ধের পরে রাষ্ট্রসংঘের মধ্যস্থতায় কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। যা নিয়ন্ত্রণ রেখাকে মেনে নেয়। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজোলিউশন ৪৭, উভয় পক্ষকে যুদ্ধে বিরতি টানতে বলেছিল। যাতে জম্মু ও কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছা নির্ধারণের জন্য একটি গণভোট হতে পারে। যেহেতু নিরস্ত্রীকরণ কখনও উভয়পক্ষে ঘটেনি, তাই প্রস্তাবটি একটি মৃত চিঠি হয়েই থেকে যায়। নেহেরু সরকার ভেবেছিল, কাশ্মীরের জন্য বিশেষ সাংবিধানিক বিধানের প্রয়োজন। এটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য, সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ কাশ্মীরের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা, বিদেশ এবং যোগাযোগের ব্যাপারে সংসদকে ক্ষমতা দেয়। বাইরের লোকেদের কাশ্মীরে যাওয়ার জন্য অনুমতির প্রয়োজন ছিল। বাইরের লোকদের কাশ্মীরে জমি কিনতেও বাধা দেওয়া হয়েছিল।

কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ ১৯৫১ সালে বিগ ল্যান্ডেড এস্টেট অ্যাবলিশন অ্যাক্টের অধীনে জম্মু ও কাশ্মীরের বড় জমির মালিকানা বাতিল করেছিলেন। কোনও ক্ষতিপূরণ না-দিয়েই ডোগরা সম্প্রদায়ের হিন্দু জমিদারদের ওপর আঘাত হেনেছিলেন। তিনি উর্দুকেও সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। ফলে, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর প্রতিবাদে, আরএসএসে প্রাক্তন স্বয়ংসেবক প্রেমনাথ ডোগরার প্রজা পরিষদ সংগঠন শেখ আবদুল্লাহ সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি আন্দোলন শুরু করে। আবদুল্লার সরকার, জনসংঘ এবং ডোগরা ও তাঁর অনুগামীদের গ্রেফতারি শুরু করে। ১৯৫২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, কাশ্মীরে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। এরপরে জনসংঘও জম্মু-কাশ্মীর গণপরিষদের নেওয়া রাজ্যের জন্য পৃথক পতাকা গ্রহণের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে। ১৯৫২ সালের ২৬ জুন, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে পুরোপুরি মিলিয়ে দেওয়ার দাবিতে কেন্দ্রের ওপর চাপ দেন। জনসংঘ এবং প্রজা পরিষদ একটি স্লোগান গ্রহণ করে, 'এক দেশ মে দো বিধান, দো প্রধান অর দো নিশান নেহি হো সক্তে (এক দেশে দুটি সংবিধান, দুটি প্রধানমন্ত্রী এবং দুটি পতাকা থাকতে পারে না)।'

প্রজা পরিষদ দিল্লি চুক্তিও প্রত্যাখ্যান করে। এই চুক্তি নেহরু সরকার এবং জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসন ১৯৫২ সালের জুলাইয়ে স্বাক্ষর করেছিল। যার অংশ হিসেবে জম্মু-কাশ্মীর সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ার এবং ভারতীয় পতাকার আধিপত্য স্বীকার করেছিল। তবে, রাজ্যের পতাকাও ব্যবহার অব্যাহত থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। চুক্তির অংশ হিসেবে, জম্মু-কাশ্মীরের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের ক্ষেত্রে রাজ্যের সম্মতিতে ৩৫২ অনুচ্ছেদের অধীনে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যাবে। ভারতের রাষ্ট্রপতি রাজ্যের ক্ষমতা হাতে নিতে পারবেন বলে স্থির হয়েছিল। ১৯৫২ সালের শেষের দিকে, প্রজা পরিষদ একটি আন্দোলন শুরু করে। সেই সময় জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা জম্মু-কাশ্মীরের শেষ রাজা হরি সিংয়ের ছেলে করণ সিংকে রাজ্যের প্রধান (সদর-ই-রিয়াসত) নির্বাচিত করে। আন্দোলন থামাতে প্রেমনাথ ডোগরা এবং অন্যান্য প্রজা পরিষদ নেতাদের ফের গ্রেফতার করা হয়।

Dr Shyama Prasad Mukherjee
জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। (এক্সপ্রেস আর্কাইভ ছবি)

১৯৫২ সালের ডিসেম্বরে কানপুরে তার প্রথম বার্ষিক অধিবেশনে, জনসংঘ ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সম্পূর্ণ একীকরণের দাবিতে চলা প্রজা পরিষদের জম্মু সত্যাগ্রহকে সমর্থন করে একটি প্রস্তাব পাস করে। নেহেরু এই ঘটনায় জনসংঘের অংশগ্রহণকে 'সাম্প্রদায়িক' কারণ হিসেবে দেখেছিলেন। এমনটাই লিখেছেন বিডি গ্রাহাম। তখন জনসঙ্ঘ আন্দোলনের পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অটলবিহারী বাজপেয়ী, যিনি ১৯৫৩ সালের শুরুতে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির ব্যক্তিগত সচিব হয়েছিলেন, আন্দোলনকে জনপ্রিয় করার জন্য তাঁকে হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোয় পাঠানো হয়েছিল। দিল্লিতে, জনসঙ্ঘের কর্মীরা হঠাৎ বিভিন্ন পার্কে ঢুকে পড়তে শুরু করেন। আর, কাশ্মীরের সম্পূর্ণরূপে ভারতভুক্তির দাবিতে স্লোগান দেন।

আরও পড়ুন- বিরাট কেলেঙ্কারি! শিল্পপতি সজ্জন জিন্দলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, ভয় দেখানোর অভিযোগে এফআইআর

১৯৫৩ সালের মে মাসে, শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ জানাতে অনুমতি ছাড়াই জম্মু-কাশ্মীরে প্রবেশ করেন। অটলবিহারী বাজপেয়ীও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। ১৯৫৩ সালের ১১ মে, শ্যামাপ্রসাদ রাভি নদী পার হয়ে জম্মু ও কাশ্মীরে প্রবেশ করেন। সেই সময় কাশ্মীর পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। শ্যামাপ্রসাদ বাজপেয়ীকে দিল্লিতে ফিরে যেতে বলেন। আর, সবাইকে জানিয়ে দেন যে তিনি অনুমতি ছাড়াই কাশ্মীরে প্রবেশ করেছেন। শ্যামাপ্রসাদকে শ্রীনগর থেকে আট মাইল দূরে একটি কটেজে রাখা হয়। তবে তিনি রক্তচাপের সমস্যা এবং হৃদরোগে ভুগছিলেন। নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি। ব্যাপক হৃদরোগে আক্রান্ত হন। আর, ২৩ জুন মারা যান।

kashmir RSS Jawaharlal Nehru
Advertisment