রাবিক ভট্টাচার্য, অত্রি মিত্র
বগটুই গণহত্যা, আনিস খানের মৃত্যু এবং ঝালদার কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু খুনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি রাজ্য-রাজনীতি উত্তাল হয়েছে। বর্তমানে এই বগটুইকাণ্ড ও ঝালদার ঘটনার তদন্ত করছে সিবিআই। কিন্তু দাবি থাকলেও আনিসের মৃত্যুর সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়নি আদালত। এই তিনটি মামলার ক্ষেত্রে রাজ্যের অবস্থান স্পষ্টই ভিন্ন।
বীরভূমের বগটুইতে একমাসেই আগেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছিল। একের পর এক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে শিশু, মহিলা সহ মেরেফেলা হয় ৯ জনকে। নিহত এবং অভিযুক্ত- উভয়ই এক্ষেত্রে তৃণমূলের স্থানীয় নেতা, কর্মী ও সমর্থক বলে পরিচিত। যা স্বীকার করেছেন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলও। ফলে অস্বস্তিতে পড়তে হয় রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলকে। বগটুইকাণ্ডের পর-পরই কালবিলম্ব না করে পদক্ষেপ করেছে রাজ্য প্রশাসন। সেখানে গিয়ে ছিলেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরই কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে স্থানীয় থানার পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করা হয়। পলাতক তৃণমূল ব্লক সভাপতি আনারুল হোসেনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। গঠন করা হয় সিট। এর ২৪ ঘন্টার মধ্যেই আনারুলকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনার ৭২ ঘন্টার মধ্যেই গ্রেফতার হয় ২২ জন অভিযুক্ত। আগ্নিকাণ্ডে ৯ নিহতদের পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি দিয়েছে রাজ্য প্রশাসন ও আর্থিক সহায়তাও করা হয়। বগটুইতে দাঁড়িয়েই মুখ্যমন্ত্রী বোমা ও বেআইনি বন্দুক উদ্ধারে রাজ্যব্যাপী তল্লাশির জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
তবে, বগটুইয়ের ঘটনার সত্য অনুসন্ধানে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিল কলকাতা হাইকোর্ট। আদালতে এর কোনও প্রতিবাদ রাজ্যের তরফে করা হয়নি। উচ্চতর বেঞ্চেও আপিল করা হয়নি। হাইকোর্টের আদেশে ভাদু শেখ হত্যার ঘটনাতেও চলছে সিবিআই তদন্ত।
বগটুইয়ের ঘটনার প্রতি নবান্নের অবস্থানের সঙ্গে বিস্তর ফারাক আনিস খান মৃত্যু বা ঝালদার কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু হত্যার তদন্তের প্রতি রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির।
ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রনেতা আমতার আনিস খানের মৃত্যু হয়েছে। রাতে বাড়িতে ঢুকে পুলিশই আনিসকে খুন করেছে বলে অভিযোগ মৃতের পরিবারের। এই মৃত্যুর কিনারায় রাজ্য প্রশাসন সিট গঠন করে। দুই পুলিশ কর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। মমতা আনিসকে নিজের দলের কর্মী বললেও তার বিরুদ্ধে মুখ খোলেন মৃত ছাত্রনেতার বাবা সালেম খান। শুরু থেকেই আনিসের পরিবার সিটের বদলে সিবিআই তদন্তের দাবিতে সোচ্চার। সিবিআই তদন্তের দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও হয়েছে। তবে আদালত এখনও সেই আবেদনে সায় দেয়নি, এবং সিটকেই এই মামলার তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল। আনিস মামলার তদন্তভার সিবিআইকে দেওয়ার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে জোর সওয়াল করেছিলেন রাজ্য সরকারের আইনজীবী।
অন্যদিকে, ঝালদার কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু হত্যার ঘটনাতে সিবিআই তদন্ত করছে হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চের নির্দেশে। যার বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে আপিল করেছে নবান্ন। কিন্তু, এখনও এই আপিলের প্রেক্ষিতে কোনও রায় দেয়নি আদালত। ফলে জারি রয়েছে সিবিআই তদন্ত।
উল্লেখ্য, বগটুইতে নিহতদের পরিবারগুলির সদস্যদের তড়িঘড়ি চাকরি, ক্ষতিপূরণ দিয়েছে রাজ্য সরকার। কিন্তু বাকি দু'টির ক্ষেত্রে তেমন কোনও পদক্ষেপের আশ্বাস মুখ্যমন্ত্রীর মুখে শোনা যায়নি। ফলে নবান্নের অবস্থানগত বিভাজন স্পষ্ট।
মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এই হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ করেছেন বগটুইয়ের প্রত্যক্ষদর্শী মিহিলাল শেখ। সরকারি চাকরির বেতন নিয়েও অসন্তোষ রয়েছে তাঁর। তবুও সরকারের ভূমিকায় আশ্বস্ত তিনি। ফোনে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে তিনি জানিয়েছেন যে, 'আমরা মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রশাসনের কাজে খুশি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন এবং আমাদের ক্ষতিপূরণ ও চাকরি দিয়েছেন। আমরা শুরু থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে ছিলাম। এখন আমরা বিচার পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। অভিযুক্তদের ফাঁসি দেওয়া উচিত।'
কেন বগটুইয়ের থেকে অন্যদুটি অস্বাভিক মৃত্যুর তদন্ত মামলায় রাজ্যের অবস্থান ভিন্ন? জবাবে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, 'প্রথমত, বগটুইতে মৃত এবং অভিযুক্ত- উভয়ই তৃণমূলের লোক। দ্বিতীয়ত, রাজ্যপুলিশ ভালো কাজ করলেও অনেক প্রশ্ন উঠছে। ফলে এটা সিবিআই তদন্তের জন্য উপযুক্ত ছিল। তৃতীয়ত, সব হারানো পরিবারগুলির জন্য যা যা করণীয় মুখ্যমন্ত্রী তা করেছেন। দলের কোনও নেতাকে রেয়াত করা হয়নি।'
যদিও বিরোধীদের দাবি, বগটুইয়ের ঘটনা তৃণমূলের প্রকট গোষ্ঠীকোন্দলের প্রতিফলন। ফলে অস্বস্তি ধামাচাপা দিতেই এই মামলাকে ভিন্ন নজরে দেখছে মমতা সরকার। সিপিএম নেতা কল্লোল মজুমদারের কথায়, 'বিধানসভা এবং পুর নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকে, তৃণমূল তার নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ। ছোট থেকে বড়, শাসক শিবিরের সব স্তরেই অভ্যন্তরীণ বিরোধ চরমে। সুতরাং, বগটুইয়ের ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পেরেছিলেন যে, দলকে সামলাতে হলে এবার সিবিআইকে তদন্তের প্রয়োজন।'
বঙ্গ বিজেপি মুখপাত্র শমিক ভট্টাচার্য বলেছেন, 'সরকার আনিস খান মামলা এবং কান্দু হত্যাকাণ্ডে সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করেছে কারণ এক্ষেত্রে পুলিশই প্রধান অপরাধী। পুলিশ এখন টিএমসির পক্ষে কাজ করছে। এই পরিস্থিতিতে, রাজ্য সরকার যদি সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা না করে, তবে দুটি জিনিস ঘটতে পারে, প্রথমত, সিবিআই প্রকৃতভাবে মামলার সমাধান করবে এবং মূল অপরাধীদের গ্রেফতার করবে। দ্বিতীয়ত, রাজ্য সরকার পুলিশকে রক্ষা না করলে, পুলিশ প্রশাসন তাঁর নিয়ন্ত্রণে নাও থাকতে পারে। তাই সিবিআই তদন্তের বিরোধিতা করা ছাড়া রাজ্য সরকারের আর কোনও উপায় নেই।'
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভময় মৈত্র বলেছেন যে, 'বীরভূমের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার সংবেদনশীল কারণ তারা চায় না যে এই এলাকায় টিএমসির নেতৃত্বের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি হোক। দলের কর্মীদের একটি অংশের জন্য ন্যায়বিচারের আশা ফুরোচ্ছিল, এটি টিএমসির জন্য বুমেরাং হতে পারত। তাই, দল কোনও পদক্ষেপ বাকি রাখেনি এবং বগটুই মামলায় কোনও আপস করেনি।' তাঁর সংযোজন, '২০২১ সালের আগে, টিএমসি একটি পেশাদার দলের সমর্থন এবং তত্ত্বাবধান ছিল। তারপর পেশাদার দলের সমর্থন হ্রাস হয়েছে। বিজেপি বা সিপিআই(এম)-এর থেকে তৃণমূলের চরিত্র ভিন্ন। টিএমসি দুর্বল রেজিমেন্টেড ও এজেন্ডা-ভিত্তিক দল।'
Read in English