বিনা যুদ্ধে নাহি দিব, সূচ্যগ্র মেদিনী। কার্যত এই সুরেই মুম্বইয়ের মাটি থেকে হুংকার ছাড়লেন বিরোধী দলেরা নেতারা। এককাট্টা ভাব স্পষ্ট করে দিয়ে তাঁদের সম্মিলিত স্বর একটাই কথা তুলে ধরল- 'জুড়েগা ভারত, জিতেগা ইন্ডিয়া।' এই স্লোগান সামনে রেখে দেশজুড়ে প্রচারে নামার আগে বিরোধী জোটের নেতারা বুঝিয়ে দিলেন, তাঁদের মধ্যে কোনও বিভেদ নেই। সবার গলাতে একই স্বর, একই সুর। চলুন দেখে নিই, কে কী বললেন।
উদ্ধব ঠাকরে- ওঁরা (বিজেপি) প্রচার করে যে তারা বিরোধীদের মানে না। আমরা সবাই একজোট হয়ে লড়ছি। এই জোটের নাম ইন্ডিয়া বা ভারত। এখন ভারত বিরোধী কারা, তা আপনারা ভালোই জানেন। আমরা মোদী সরকারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে লড়ব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করব। পরিবারবাদের বিরুদ্ধেও লড়াই করব। কারণ 'মিত্র' (মোদী)-র যে পরিবারবাদ চলছে, তার বিরুদ্ধেই আমাদের লড়াই। মাঝরাতে গিয়ে ঘোষণা করা হচ্ছে এই হবে, ওই হবে। আমরা সাধারণ মানুষকে এই ভয় থেকে মুক্তি দিতে চাই। আজ এলপিজি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ২০০ টাকা কম হয়েছে ঠিকই। কিন্তু, ২০১৪ সাল থেকে ঠিক কত টাকা বাড়ানো হয়েছে, আপনারা সবাই জানেন। মাঝের বছরগুলোয় গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম যে ১,০০০ টাকা বাড়ানো হল, তার কী হবে?
মল্লিকার্জুন খাড়গে- আমাদের বৈঠক বেশ ভালোই হয়েছে। পটনা, বেঙ্গালুরুর পর আমরা আজ মুম্বইয়ে বৈঠক করলাম। সকলেই নিজের মতামত দিয়েছেন। সকলের একটাই কথা, মূল্যবৃদ্ধি কমাতে হবে। যেভাবে পেট্রোল-ডিজেলের দাম বেড়েছে, সাধারণ মানুষ বিরাট সমস্যায় পড়েছেন। মোদীজির কায়দাই হল, ১০ টাকা দাম বাড়িয়ে তারপর ২ টাকা দাম কমিয়ে দেন। গ্যাসের দাম ১,০০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে এখন বলছেন গরিবদের জন্য গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ২০০ টাকা কমানো হল। মোদীজি কখনও গরিবদের জন্য কোনও কাজ করেন না। তিনি গরিবদের থেকে চুরি করেন। আর, বড় বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সব কাজ করেন। আজই যেমন বিরোধীদেরকে কোনওরকম জিজ্ঞাসা না-করেই সংসদে বিশেষ অধিবেশন ডাকা হল। মণিপুর যখন জ্বলল, করোনা যখন সংক্রমণ ছড়াল বা চিনের ইস্যু যখন প্রবল হয়ে উঠল, নোটবাতিল যখন সাধারণ মানুষকে সমস্যায় ফেলল, পরিযায়ী শ্রমিক ইস্যু নিয়ে দেশ যখন তোলপাড়, কখনও কিন্তু কোনও বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়নি। আমি জানি না এবারের অধিবেশনের উদ্দেশ্য ঠিক কী! কিন্তু, দেশের ইস্যু থেকে এভাবে মুখ ফেরানো যায় না। আমরা আসলে ধীরে ধীরে একনায়কতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। গতকালই তো রাহুল একটা রিপোর্ট দেখিয়ে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছে, কীভাবে আদানির সম্পত্তি বেড়েছে। আর, এই কারণেই গরিবদের ওপর লুঠতরাজ রুখতে ইন্ডিয়া জোটের জয় জরুরি। আমরা প্রস্তাবনাতেই রেখেছি, প্রতিটি রাজ্যে যাব। সেখানে বৈঠক করব। সাধারণ মানুষের যা যা সমস্যা, সব সমাধান করব।
আদিত্য ঠাকরে- এবার বৈঠকে তিনটি প্রস্তাব আনা হয়েছিল। একনম্বর, আমরা সবাই মিলিতভাবে লোকসভা নির্বাচনে লড়ব। আসন ভাগাভাগি নিয়ে রাজ্যগুলিতে অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দ্বিতীয়, আমরা জনসাধারণের দাবি এবং সমস্যা নিয়ে দেশজুড়ে মিটিং-মিছিল করব। তৃতীয়, মিলিতভাবে মিডিয়ায় প্রচার চালাব।
নীতীশ কুমার- আমরা দেশজুড়ে নিয়মিত প্রচার চালাব। যারা কেন্দ্রে আছে, তারা হারবেই। সংবাদমাধ্যমকে কবজা করা হচ্ছে। খবর কম ছাপা হচ্ছে। একদলের খবরই বেশি প্রকাশ পাচ্ছে। এখন সংবাদমাধ্যম আর খবর করছে না। শুধুই প্রচার চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে আমরা মুক্তি দেব। বিজেপি দেশের ইতিহাসকে বদলে ফেলার চেষ্টা করছে। আমরা তা হতে দিতে পারি না। সময়ের আগে নির্বাচন হতে পারে। সবাইকে একজোট থাকতে হবে। সকলকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সংবাদমাধ্যমকে অনুরোধ, দয়া করে আমাদের কাজেরও প্রচার করুন।
আরও পড়ুন- ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক: বিশাল ভূমিকায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, কী হল সিপিআইএমের?
কেজরিওয়াল- ইন্ডিয়া জোট শুধুমাত্র কেবল ২৮ দলের জোট নয়। এটা দেশের ১৪০ কোটি মানুষের জোট। এই জোট একবিংশ শতাব্দীর ভারত তৈরি করার জন্য তৈরি হয়েছে। দেশের ইতিহাসে সবথেকে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার হল এই মোদী সরকার। কয়েকদিন ধরে বিদেশের সমস্ত সংবাদমাধ্যমের পাতায় লেখা হচ্ছে, মোদী সরকার কেবল একজনের জন্যই কাজ করছে। তিনি আবার দেশ থেকে টাকা বিদেশে পাচার করছেন। এসব দেখলে দুঃখ বেড়ে যায়। এতে কখনও দেশের নাম উজ্জ্বল হতে পারে? দেশের যুব সম্প্রদায়ের কি কোনও কাজ নেই। কোনও রোজগার নেই। আর, খরচ বেড়েই যাচ্ছে। এই অহংকারী সরকারকে অনেকে নিজেদের ভগবান ভাবছে। ইন্ডিয়া জোট এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে এই জোট ভাঙার বারবার চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের কারও মধ্যে কোনও লড়াই নেই। এখানে কেউ পদের জন্য আসেনি। আমরা ১৪০ কোটি মানুষের জন্য একজোট হয়েছি। প্রত্যেকে দায়িত্ব নিয়েছি। কেউ আসন ভাগাভাগির দায়িত্ব নিয়েছে। কেউ দায়িত্ব নিয়েছে প্রচারের।
লালুপ্রসাদ যাদব- এতদিন আমরা সবাই আলাদাভাবে লড়ছি। একজোট ছিলাম না। তারই সুবিধা নিয়ে মোদী এগিয়ে যাচ্ছিল। এবার আর তা হবে না। সবাই জানে কী হচ্ছে। দেশে দারিদ্র বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। সবজির দামও বাড়ছে। তাই আমরা আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে একসঙ্গে লড়ব। মোদী সরকার হাজারো মিথ্যা বলে ক্ষমতায় এসেছে। সকলেই তা জানেন। আমার নামে এবং আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে বলেছিল যে আমাদের নাকি সুইস ব্যাংকে টাকা আছে। মোদীজি বলেছিলেন যে উনি ক্ষমতায় এসে সুইস ব্যাংক থেকে সেই টাকা ফিরিয়ে আনবেন। আর, দেশের সকলের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে জমা করবেন। আমিও তখন ঠকে গিয়েছিলাম। সেই সময় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম। আমার ৭ মেয়ে, ২ ছেলে আর স্ত্রী মিলিয়ে ১১ জন। কারও অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা ঢোকেনি। দেশের এমন কোনও নেতা নেই, যাঁকে ইডি বা সিবিআই দিয়ে ফাঁসানো হয়নি। আমি কিডনি বদলেছি। আমার মেয়ে আমাকে কিডনি দিয়েছে। আমার ৫ থেকে ৬টা অপারেশন হয়েছে। আপনাদের আশীর্বাদে বেঁচে আছি। এবার মোদীজিকে ক্ষমতাচ্যুত করেই দম নেব। গুজরাট দাঙ্গার সময় থেকে আমি আপনার বিরুদ্ধে লড়ছি। সেই সময় বিদেশে মোদীর প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তখনই আমি বলেছিলাম যে মোদীকে গ্রেফতার করা হোক।
সীতারাম ইয়েচুরি- আমি বলতে ওঠার আগে লালুজি আমায় লাল সেলাম বললেন। আমি ওনাকে পালটা জয় হিন্দ বললাম। এটাই ইন্ডিয়ার স্পিরিট। আমরা রাজ্যভিত্তিক আসন ভাগাভাগি করব। সকলের এখন একটাই লক্ষ্য, দেশের গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হবে। সংবিধানকে বাঁচাতে হবে। আর সেজন্যই আমরা একসঙ্গে লড়ব। বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করব। আমরা বৈঠক করছি শুনেই গ্যাসের দাম ২০০ টাকা কমিয়ে দিল মোদী সরকার।