Advertisment

কৈলাশ বিজয়বর্গীয়: বাংলায় মেরুকরণ হলে তো সব হিন্দু ভোটই পেতাম

"বাংলায় এসে দু'বার রাজ্যটা ঘুরে দেখার পর আমার মনে হয়েছিল, শাসক দলকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জায়গায় আসতে অন্তত পনের বছর লাগবে। সেটা শুনে অমিত শাহ আমাকে বলেছিলেন, আপনাকে আমি পাঁচ বছরের জন্য পাঠিয়েছি, পনের বছরের জন্য নয়।"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
West Bengal Lok Sabha Election 2019 Live মিছিলে কৈলাশ বিজয়বর্গী। ফোটো- শশী ঘোষ

West Bengal Lok Sabha Election 2019 Live মিছিলে কৈলাশ বিজয়বর্গী। ফোটো- শশী ঘোষ

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের 'আইডিয়া এক্সচেঞ্জ' শীর্ষক নিয়মিত বৈঠকে এক্সপ্রেস সাংবাদিকদের মুখোমুখি বিজেপির বাংলার ভারপ্রাপ্ত নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয়

Advertisment

লিজ ম্যাথু: বাংলার রাজনীতিতে কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হলো?

প্রায় সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনের পর অনেক লড়াই করে মমতা ব্যানার্জি ক্ষমতায় এসেছিলেন। বাংলার মানুষ পরিবর্তন চেয়েছিলেন, গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা চেয়েছিলেন, স্বৈরাচার এবং হিংসার অবসান চেয়েছিলেন, শান্তি আর উন্নতি চেয়েছিলেন। কিন্তু মমতার আমলে কিছুই বদলায়নি। বরং হিংসা আর খুনের রাজনীতি শুরু হয়েছিল। প্রথমে বামপন্থী এবং কংগ্রেস কর্মীদের খুন করা হত, গত কয়েক বছরে বিজেপি কর্মীদের খুন করা হয়েছে। গত সাড়ে চার বছরে, আমি দলের তরফে বাংলার দায়িত্ব নেওয়ার পর, রাজ্যে ১০৩ জন বিজেপি কর্মী খুন হয়েছেন। এঁদের মধ্যে অনেকে নিহত হয়েছেন বিভিন্ন নির্বাচনের পরেই।

বাংলায় সিন্ডিকেট রাজ চলে। সরকার রাজ্য চালায়, আর সিন্ডিকেট চালায় জেলাগুলোকে। শাসক দলের লোকেরা এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত। পশ্চিমবঙ্গে আপনি সিন্ডিকেটকে খুশি না করে একটা বাড়িও বানাতে পারবেন না।

বাংলার মানুষের মনে একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল, কোন দিকে যাব? কংগ্রেসের অস্তিত্ব প্রায় নেই, বামেরাও প্রায় নিশ্চিহ্ন। আমাকে বাংলার দায়িত্ব দেওয়ার সময় অমিত শাহ বলেছিলেন, "দুটো রাজ্য জেতা সবচেয়ে কঠিন। কেরালা আর পশ্চিমবঙ্গ।" বাংলায় এসে দু'বার রাজ্যটা ঘুরে দেখার পর আমার মনে হয়েছিল, শাসক দলকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জায়গায় আসতে অন্তত পনের বছর লাগবে। সেটা শুনে অমিত শাহ আমাকে বলেছিলেন, "আপনাকে আমি পাঁচ বছরের জন্য পাঠিয়েছি, পনের বছরের জন্য নয়। আমি আপনার পিছনে আছি, বলুন কী কী প্রয়োজন আপনার।"

এরপর পশ্চিমবঙ্গে ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে শুরু করলাম, ঘুরতে শুরু করলাম জেলাগুলোয়। ওড়িশার এক দলীয় কর্মী সুরেশ পূজারী এবং আমাদের জাতীয় সংগঠনের নেতা শিবপ্রকাশজি-র সঙ্গে বাংলা চষে ফেলেছিলাম। ক্লকওয়াইজ এবং অ্যানটি-ক্লকওয়াইজ। প্রতি দু'মাসে এভাবে আমরা প্রতিটা জেলা দু'বার চষে ফেলতে পেরেছিলাম। এতে আমরা কর্মীদের সংহত করতে পেরেছিলাম ব্যাপকভাবে, আত্মবিশ্বাস বেড়েছিল তাঁদের।

আমরা বাংলাকে চষে ফেলেছিলাম। ক্লকওয়াইজ এবং অ্যানটি-ক্লকওয়াইজ। প্রতি দু'মাসে এভাবে আমরা প্রতিটা জেলা দু'বার চষে ফেলতে পেরেছিলাম। এতে আমরা কর্মীদের সংহত করতে পেরেছিলাম ব্যাপকভাবে, আত্মবিশ্বাস বেড়েছে কর্মীদের।

এরপর আমাদের দলীয় কর্মীদের উপর অত্যাচার শুরু হলো। কেউ ছাড় পান নি। তৃণমূল আর তাদের মদতপুষ্ট সিন্ডিকেটগুলোর মধ্যেও আবার বেশ কয়েকটা গোষ্ঠী আছে, যারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। মমতার আমলে শেষ তিন বছরে এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার হয়েছেন তৃণমূলেরই ৬৫ জন কর্মী। পশ্চিমবঙ্গই বোধহয় একমাত্র রাজ্য, যেখানে শাসক দলের লোক নিজেদের দলের লোককেই খুন করে বিরোধীদের ঘাড়ে দোষ চাপায়। জীবনে একটা মশাও মারেন নি, এমন অন্তত দেড়শো জন বিজেপি কর্মীকে খুনের মিথ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।

এই অত্যাচারের আবহে দলীয় সংগঠনের ভিত মজবুত করার কাজটা দুরূহ ছিল। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বগুণ, দলীয় সভাপতির রণকৌশল এবং মাঠে নেমে আমাদের পরিশ্রমের জন্যই পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি রাজ্যে আমরা দলীয় সংগঠনের বিস্তার করতে পেরেছি।

গত লোকসভায় আমাদের দুটো আসন ছিল বাংলা থেকে। সবাই ভেবেছিলেন, এবার বড়জোর চারটে থেকে ছ'টা পাব। আমি টার্গেট রেখেছিলাম ২৫। শুনে অনেকে হাসতেন। কিন্তু আমি সবাইকে বলতাম, অভাবনীয় রেজাল্ট হবে। হিংসা না হলে, মানুষকে ভোট দিতে বাধা না দেওয়া হলে ২৫ টাই পেতাম। তবু মানুষের ভোটে আমরা ১৮ টা আসন পেয়েছি।

লিজ ম্যাথু: আপনাকে দলের তরফে বাংলার দায়িত্ব দেওয়ার কারণ?

এই প্রশ্নটা অমিত শাহকে করা উচিত (হাসি)। আমার মনে হয়, দলের সমস্ত সাধারণ সম্পাদকের তুলনায় আমার অভিজ্ঞতা বেশি। আমি কাউন্সিলর ছিলাম, মেয়র ছিলাম, ছ'বার এমএলএ ছিলাম। তাছাড়া আমি হিংসা আর অশান্তিকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আশি আর নব্বইয়ের দশকে ইন্দোরে অনেক টেক্সটাইল মিল আর ট্রেড ইউনিয়ন ছিল। আমার বাবা মিলের কর্মচারী ছিলেন। আমরা মজদুর বস্তিতে থাকতাম। সে সময় হিংসাকে কাছ থেকে দেখেছি... সে সময় অবশ্য গুলি-বন্দুকের তুলনায় লাঠি-তরোয়ালই মূলত ব্যবহার হতো। অমিত ভাই আমার সম্পর্কে সব জানেন, হয়তো তাই আমাকে বেছেছেন আমার অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে।

রভিশ তিওয়ারি: আপনাদের বিরোধীরা বলছেন, ভোটে বিজেপি-র ভাল ফলে পিছনে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কাজ করেছে।

বাংলার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আমরা দায়ী নই। মমতাজি দায়ী। প্রথম যখন কলকাতা গিয়েছিলাম, সল্ট লেকে মানুষের নমাজ পড়ার ছবি দিয়ে বড় বড় হোর্ডিং চোখে পড়েছিল। ভাল করে দেখে নজরে এসেছিল, হোর্ডিংগুলোতে মমতার মুখের ছবি রয়েছে। আমি শুনেছি, মমতা নমাজে অংশ নেন। কোনও হিন্দু নেতা এটা কখনও করেছেন বলে শুনি নি। সীমা ছাড়ালে প্রতিক্রিয়া তো হবেই।

দুর্গাপূজা বাংলার সবচেয়ে বড় উৎসব। সেই দুর্গাপূজার বিসর্জন যদি মহরমের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়, প্রতিক্রিয়া হবে না? কোর্টে গিয়ে বিসর্জনের অনুমতি নিতে হয়েছিল। এসবের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। যে মণ্ডপে এক হাজার লোক দেবী দর্শনে আসত, সেখানে দশ হাজার লোক এসেছেন। এটা মানুষের প্রতিক্রিয়া, আমাদের পার্টির নয়।

আমি নমাজ পড়ার ছবির বড় বড় হোর্ডিং দেখেছি বাংলায়। সেই হোর্ডিংগুলোয় মমতার ছবি থাকে। আমি শুনেছি উনি নমাজে অংশ নেন। কোনো হিন্দু নেতা কখনও এটা করেছেন বলে শুনি নি আমি। একটা সীমা থাকে সবকিছুর, সেটা ছাড়ালে প্রতিক্রিয়া তো হবেই।

২০১৬ সালে মালদার কালিয়াচকে একটা থানায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এলাকার অধিকাংশ হিন্দু পরিবারকে ঘরছাড়া করা হয়েছিল। কোনও মিডিয়া শুরুতে খবরটা করে নি। করতে বাধ্য হয়েছিল যখন একটি সর্বভারতীয় চ্যানেলের একজন সিনিয়র সাংবাদিক এলাকায় গিয়ে স্টোরিটা করেন। কীভাবে ওই হামলায় একে-৪৭ (রাইফেল) ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটা জনসমক্ষে এসেছিল ওই স্টোরিতে, কেন বহু পরিবার ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন সেটাও জানা গিয়েছিল। এসব মানুষেরই প্রতিক্রিয়া।

বাংলার ভোটে সব জায়গায় আমাদের দলীয় সংগঠন মজবুত না হলেও তাই মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছেন। রাতে গ্রামে বোমাবাজি হয়েছে, তবু সকালে পুলিশকে ডেকে মহিলারা দল বেঁধে গিয়ে ভোট দিয়েছেন।

কোন বিজেপি কর্মী হিংসায় যুক্ত ছিলেন না। বলা হচ্ছে, আমরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেছি। এটা ঠিক নয়, আমরা এটা করি নি। আমরা হয়তো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে উপকৃত হয়ে থাকতে পারি, কিন্তু সে দায় আমাদের নয়। দায় রাজ্য সরকারের।

লিজ ম্যাথু: আপনি বলছেন, রাজ্যে ভয়ের বাতাবরণ ছিল। তাহলে হিন্দু ভোটের পুরোটাই পেলেন না কেন?

সে জন্যই তো বলছি, মেরুকরণের অভিযোগটা ভিত্তিহীন। তেমন হলে তো সব হিন্দু ভোটই পেতাম। আমরা মেরুকরণ করি নি। আমরা নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে যুবকদের কর্মসংস্থানের কথা বলেছি, মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথা বলেছি, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার মানের কথা বলেছি। একশো শতাংশ ভোট সে জন্যই পাইনি, মেরুকরণ হলে পেতাম।

অবন্তিকা ঘোষ: বিদ্যাসাগর কলেজের ঘটনা কি সপ্তম দফার ভোটে বিজেপি-র ক্ষতি করল?

এটা তলিয়ে দেখতে হবে। সপ্তম দফায় নয়টি আসনের প্রতিটিই আমাদের পক্ষে কঠিন ছিল। তৃণমূলের প্রভাব ওই আসনগুলিতে বেশি ছিল। তাছাড়া তৃণমূলের গুন্ডামি তো ছিলই।

রভিশ তিওয়ারি: লোকসভা ভোটে আপনারা মোদীর নামে ভোট চেয়েছেন। বিজেপি-র 'মুখ' কোথায় বাংলায়? বিধানসভা ভোটে এটা ভোগাবে আপনাদের?

বিধানসভার আগে স্থানীয় স্তরে ভোট হয়ে থাকে। আমরা তাতে হয়তো মাত্র দশ শতাংশ ভোট পাব, কারণ ওটা ভোটই নয়। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার, তৃণমূলের গুন্ডারা এবং পুলিশ, সবাই একসঙ্গে স্থানীয় ভোটে লড়ে। শেষ পঞ্চায়েত ভোটে আপনারা দেখেছেন, অবস্থা কী ভয়ানক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। আটটা জেলার জনসংখ্যা-চিত্রটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সেখানের গ্রামে গেলে মনে হবে, এই জায়গাটা দেশের অংশ নয়। বাংলাকে বাঁচাতে বেআইনি অনুপ্রবেশ বন্ধ করা দরকার।

কৃষ্ণ কৌশিক: আপনি বলছেন, মেরুকরণ করেন না, অথচ বলছেন বাংলার কিছু জায়গাকে দেশের অংশ বলে মনে হয় না। মুসলিমদের আপনারা টিকিট দেন নি, মুসলিম ভোটারদের কথা বলেন নি...

আমাদের মুসলিম প্রার্থী ছিলেন, যাঁদের একজন মুর্শিদাবাদে দ্বিতীয় হয়েছেন। আমরা মুসলিম ভোটও পেয়েছি। একবারও বলছি না যে আমরা মুসলিম ভোট পাই নি। হয়তো কম পেয়েছি, কিন্তু পেয়েছি।

অবন্তিকা ঘোষ: প্রচারে বিজেপি পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল। কিন্তু দেখুন, অর্জুন সিং আর মুকুল রায়, দু'জনের ছেলেই এখন আপনাদের পার্টিতে...

এ ছাড়া উপায় ছিল না। অর্জুনের কেন্দ্র ব্যারাকপুরে আমরা প্রার্থী পাচ্ছিলাম না। এটা স্বীকার করতে আমার লজ্জা নেই যে অর্জুন ব্যারাকপুরে খুবই প্রভাবশালী, এবং ওই অঞ্চলে আমাদের সংগঠনও তেমন ছিল না। আমরা অর্জুনের এলাকায় পার্টি অফিস খুলেছিলাম, কিন্তু সেটা দখল হয়ে গিয়েছিল। অর্জুন মার্চে আমাদের দলে এসেছেন। গণতন্ত্রে নির্বাচনে সোনা-রূপো-ব্রোঞ্জের গল্প নেই। হয় জিতবেন, নয় হারবেন। জিততে হলে ভাল প্রার্থী চাই।

লিজ ম্যাথু: বাংলার সিপিএম ক্যাডারদের ভোট কি পুরোটাই আপনাদের বাক্সে ঢুকল?

মোদীজির স্লোগানটা মনে করুন, "চুপচাপ কমল ছাপ"। ভোটাররা অত্যন্ত বুদ্ধিমান। গ্রামের মানুষ জানতেন, বিজেপি-কে ভোট দেব জানতে পারলে তৃণমূল ভোটটাই দিতে দেবে না। তৃণমূলের ভোটার হিসেবে বুথে গিয়ে ওঁরা বিজেপি-কে ভোট দিয়ে এসেছেন। রাজনৈতিক হিংসা এবং অগণতান্ত্রিক কাজকর্ম তৃণমূলের সমস্যা বাড়িয়েছে বাংলায়। আমরা তৃণমূলীদের ভোট পেয়েছি। সিপিএম আর কংগ্রেসের ভোটও পেয়েছি।

রভিশ তিওয়ারি: আপনি একদিকে বলছেন, মুসলিমরা আপনাদের ভোট দিয়েছে। অন্যদিকে বলছেন, রাজ্যের কিছু মুসলিম-প্রধান জায়গায় গিয়ে মনে হয়েছে, সেই এলাকাগুলি ভারতের অংশ বলে মনে হয় না। এটা তো পরস্পরবিরোধী হয়ে গেল।

ওই সব জায়গার মানুষের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছিল, এই এলাকাগুলি ভারতের অংশ নয়। ব্যবহার আর আচার-আচরণ দেখেই মনে হয়েছিল।

বন্দিতা মিশ্র: কী ধরণের ব্যবহার?

ভারতের যে কোনও জায়গায় আপনি যান, মানুষের মধ্যে একটা স্বাগত জানানোর মনোভাব থাকে। আপনি কোনও রাস্তার হদিশ জানতে চাইলে লোকে আপনার কাছে জানতে চাইবেন, কিছু খেয়েছেন কিনা। এটাই আমাদের দেশের ঐতিহ্য, 'অতিথি দেব ভব'। কিন্তু বাংলার কিছু জায়গায় গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, আমরা বোধহয় একটা বোঝা। এটা একটা মনোভঙ্গি। আমি প্রচুর মুসলিম এলাকায় যাই এবং সেখানের মানুষের ভালবাসা পাই। ইন্দোরে আমি অনেক মুসলিম অনুষ্ঠানে যাই। ওখানে মুসলিমদের প্রচুর ভোট পাই আমি। কিন্তু বাংলার কিছু এলাকায় গিয়ে মনে হয়েছে, আমরা এখানে স্বাগত নই।

রভিশ তিওয়ারি: আপনি বিজেপি-র হয়ে মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এবং বাংলায় কাজ করেছেন। রাজনৈতিক হিংসার ব্যাপারটা বাদ দিলে এই রাজ্যগুলির রাজনীতিতে কী কী ফারাক চোখে পড়েছে?

দেখুন, উত্তরপ্রদেশে প্রতি দুটো ঘরে আপনি একজন 'রাজনীতিক' পেয়ে যাবেন। একজন জাঠের সঙ্গে কথা বললে তিনি জাঠদের পুরো জাতিগত ইতিহাস আপনাকে বলে দেবেন। একজন যাদব সম্প্রদায়ের মানুষ আপনাকে তাঁদের জাতিগত বঞ্চনার ইতিহাস জানিয়ে দেবেন। ভোটাররা ওখানে রাজনৈতিক ভাবে খুব সচেতন। হরিয়ানার ভোটাররা আবার সবচেয়ে সৎ। আমি ট্রান্সপোর্টারদের একটা অনুষ্ঠানে একবার হরিয়ানায় গিয়েছিলাম। ওঁরা আমায় খাইয়ে দাইয়ে খুব আদরযত্ন করেছিলেন। কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা কি বিজেপি-কে ভোট দেবেন? উত্তরে ওঁরা বললেন, "আমরা চৌটালার লোক" (হাসি)। এত সৎ ভোটার আমি দেশের কোথাও দেখি নি।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অনেক খবরের কাগজ পড়েন। পড়েন এবং ভাবেন। একজন বাঙালির সঙ্গে কথা বলা খুব কঠিন, চট করে ওঁরা মনের ভাব বুঝতে দেন না। ওঁরা খুব আবেগপ্রবণ, নিজেদের ভাষা এবং সংস্কৃতি নিয়ে ওঁরা গর্বিত। পশ্চিমবঙ্গের মহিলারা তাঁদের সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে চিন্তিত থাকেন, ভাবেন শিক্ষার মান নিয়ে।

রভিশ তিওয়ারি: বিজেপি মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা ভোটে হারল কেন?

দুটো কারণে। এক, আমরা ১৫ বছর ক্ষমতায় ছিলাম। রাস্তা আর পরিকাঠামোর অনেক উন্নতি করেছিলাম। এবারের ভোটে নতুন কিছু আমরা দেখাতে পারি নি। আমরা যখন ক্ষমতায় এসেছিলাম, তখন যার চার-পাঁচ বছর বয়স ছিল, সে এবার ভোট দিতে পেরেছে। সে জানত না আমরা গত ১৫ বছরে কী কী করেছি। রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে আট দিনের মধ্যে কৃষকদের ঋণ মকুব করবেন। কিন্তু করেন নি। আরও বলেছিলেন, বেকারদের পেনশন দেবেন। কেউ একটা টাকাও পায় নি। লোকসভা ভোটে মানুষ এই প্রতারণার রাজনীতির জবাব দিয়েছেন।

কোনো বিজেপি কর্মী হিংসায় যুক্ত ছিল না। বলা হচ্ছে, আমরা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেছি। এটা ঠিক নয়, আমরা এটা করি নি। আমরা হয়তো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে উপকৃত হয়ে থাকতে পারি, কিন্তু সে দায় আমাদের নয়। দায় রাজ্য সরকারের

অবন্তিকা ঘোষ: বাংলায় এখন রামনবমী অনেক বেশি ধুমধাম করে পালিত হচ্ছে। অনেক বাঙালি হনুমান-ভক্ত বলে মঙ্গলবার নিরামিষ খাচ্ছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা তো চিরদিনই মূলত দুর্গার আরাধনা করত। এই বদলটা কীভাবে এল, আর কীভাবেই বা ভোটে প্রভাব ফেলল?

সব ক্রিয়ারই একটা প্রতিক্রিয়া থাকে। চার বছর আগেও বংলায় রামনবমী আর হনুমান জয়ন্তী পালিত হতো না। জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হতো। বাচ্চারা হনুমান সেজে হাতে গদা নিয়ে ঘুরলে অস্ত্র আইনে মামলা করা হত। অনুমতি ছাড়া রামনবমীর মিছিল বার করলে জেলে পুরে দেওয়া হত। এসবের একটা সামাজিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কেউ ' জয় শ্রীরাম' বললে তাদের মারধর করা হত, গ্রেফতার করা হত। এই ভোটে একটি গ্রামের সব মানুষ 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান দিতে দিতে ভোট দিতে গিয়েছিলেন। এটা নিউটনের সূত্র। প্রতিটি ক্রিয়ার একটা সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া তো হবেই।

অনন্ত গোয়েঙ্কা: বাংলার সামাজিক চিত্রটা আগামী দশ বছরে কতটা বদলাতে পারে বলে মনে করেন?

বিজেপি-র সরকার এলে বাংলায় আমরা ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস (এনআরসি) চালু করব। এক কোটির বেশি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত হবে, যারা বাংলার সম্পদ এবং কাজ জবরদখল করছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অনন্ত গোয়েঙ্কা: কিন্তু মমতাই যদি আবার বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী হন, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের চেহারাটা কেমন দাঁড়াবে?

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একটা কথা বলেছেন। যাঁরা আমাদের উপর বিশ্বাস রেখেছেন, তাঁদের সঙ্গে থাকব, এবং যাঁরা বিশ্বাস রাখেননি, তাঁদের বিশ্বাস জয়ের চেষ্টা করব। আমরা প্রধানমন্ত্রীর স্লোগানে বিশ্বাসী, "সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস"। বাংলায় সাইক্লোনের সময় প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছিলেন মমতাকে। মমতা ফোন ধরেন নি, বলেছিলেন, মোদীকে প্রধানমন্ত্রী বলে মানেন না। কী মানবেন আর কী মানবেন না, সেটা মমতার ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

কৃষ্ণ কৌশিক: বিজেপি কেরালায় হারল কেন?

তৃণমূল বাংলায় অপরাজেয়, এই ধারণাটা আমরা ভেঙে দিতে পেরেছি পশ্চিমবঙ্গে। কেরালায় তেমন একটা ধারণা আমরা তৈরি করতে পারি নি, সেই পরিবেশটা তৈরি করতে পারি নি। সেই পরিবেশটা যখন তৈরি হবে, যখন কেরালার মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করবেন যে আমরা জিততে পারি, তখনই ছবিটা বদলাবে।

Mamata Banerjee west bengal politics bjp tmc
Advertisment