তৃণমূলে একটাই পোষ্ট বাকি সব ল্যাম্প পোষ্ট - মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল সম্পর্কে এই সামলোচনা বহুল চর্চিত। দলের জন্মলগ্ন থেকে নেত্রীর কথাই একমাত্র শিরোধার্য। তবুও ২০১১ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর দলের ওপর থেকে নজর অনেকটাই সরে গিয়েছিল মমতার। নেত্রী তখন মুখ্যমন্ত্রী সত্ত্বাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আর এই সময়জুড়ে দলীয় সংগঠনের সর্বময় রাশ কার্যত থেকেছে 'অঘোষিত' দুনম্বর মুকুল রায়ের হাতে। তৃণমূলে জনশ্রুতি ব্লক থেকে বুথ স্তর পর্যন্ত দলীয় সংগঠনের অন্ধি-সন্ধি নখদর্পণে ছিল কাঁচরাপাড়ার রায় মশাইয়ের। আর সেই মুকুল রায় তৃণমূল ত্যাগ করে বিজেপির চাণক্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে পুরনো দলের সংগঠনে চোরা-গোপ্তা আঘাত হেনেছেন অবিরত। যার ফলে দফায় দফায় তৃণমূলে ভাঙন ধরিয়ে পদ্মশিবিরে ঘর গোছাতে সমর্থ হয়েছেন তিনি।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে এরাজ্য়ে বিজেপির ঐতিহাসিক অভ্যুদয়ের পিছনে তৃণমূলের সংগঠনে বেলাগাম যে অনেকাংশে দায়ী তা টের পেয়েছেন মমতা। এছাড়া সাংগঠনিক কাজকর্ম এবং 'ভোট মেশিনারি' নিয়ন্ত্রণে কোনওকালেই সেভাবে যুক্ত থাকেননি মমতা। এবিষয়টি বরাবরই দেখে এসেছেন মুকুল রায়। মমতা চিরকালই তাঁর স্বকীয় ভঙ্গিতে ভোটারদের সামনে আভির্ভূত হয়েছেন। আর তাতেই যা ম্যাজিক ঘটার ঘটে এসেছে। কিন্তু ২০১৯-এর নির্বাচন নেত্রীকে চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দেয় সংগঠন ও ভোট মেশিনারির প্রয়োজনীয়তা। সে জন্যই লোকসভা ভোট পরবর্তী প্রথম সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, "এবার থেকে সংগঠনে নজর দেব বেশি।" শেষ পর্যন্ত তাই করেছেন নেত্রী। বৃহস্পতিবারের ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন: বিজেপির ঔদ্ধত্যের রাজনীতি পরাজিত হয়েছে: ‘বিজয়িনী’ মমতা
লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল পেয়েছিল ২২টি আসন। বিজেপি জয়ী হয়েছিল ১৮টিতে। ফলাফল প্রকাশের তিন দিনের মাথায় কালীঘাটের বাড়িতে সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 'অভিমানিনী' তৃণমূল সুপ্রিমো সেদিন বলেছিলেন, "অনেক কাজ করেছি। তাছাড়া কাজ করলেই যে ভোট পাওয়া যায় তা তো নয়, তাই এবার দলের সংগঠনের কাজে মন দেব।" কথা রাখলেন তৃণমূল নেত্রী। খড়্গপুর, কালিয়াগঞ্জ ও করিমপুর তিন বিধানসভার উপনির্বাচনে জয় পেল তৃণমূল কংগ্রেস। তিনে তিন। অর্থাৎ একশোতে একশো। সত্যিই দলের কাজে মন দিয়েছেন বটে মমতা।
লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর একাধিক সাংগঠনিক বৈঠক করেছেন তৃণমূল নেত্রী। কখনও কালীঘাটে বা তৃণমূল ভবনে, কখনও আবার নজরুল মঞ্চ অথবা নেতাজি ইন্ডোরে দলের সব স্তরের নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। এই সব সভায় নানা নির্দেশ দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভানেত্রী। সব থেকে বেশি জোর দিয়েছেন জনসংযোগের উপর। তাঁর স্পষ্ট বার্তা ছিল, "মানুষের দুয়ারে দুয়ারে যান, অভিযোগ থাকলে শুনুন এবং তার সমাধান করুন। ভুল করলে ক্ষমা চেয়ে নিন"। এর পাশাপাশি একদা সক্রিয় অথচ এখন বসে যাওয়া দলীয় কর্মীদের দলে ফেরার আহ্বানও জানান দলনেত্রী।
আরও পড়ুন: করিমপুরে বহাল সবুজ দাপট, মমতার পাশেই সংখ্যালঘুরা
'দিদিকে বলো'-কে সামনে রেখে একাধিক দলীয় কর্মসূচি নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। ফোনে বা মেইলে অভিযোগ, সমস্যা জানানোর কথা বলা হয় 'দিদিকে বলো'-তে। প্রত্যন্ত গ্রাম ও শহরে কর্মী বা সাধারণের বাড়িতে রাত্রি যাপনের মাধ্যমেও জনসংযোগে জোর দেওয়া হয়। এই কর্মসূচি প্রচারের মাধ্যমেও জনসংযোগ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এভাবেই ফের চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকরা, এমনটাই মনে করা হচ্ছে।
জনসংযোগের কৌশলের পাশাপাশি কাজে দিয়েছে এনআরসি নিয়ে মমতার অবস্থান। তৃণমূল সুপ্রিমোর একরোখা এনআরসি বিরোধিতা এই উপনির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এদিকে বিজেপির বক্তব্য, যেভাবেই হোক এনআরসি করবই। ফলে কালিয়াগঞ্জ ও করিমপুরের মতো সীমান্তবর্তী বিধানসভা এনআরসি মেরুকরণ প্রবলভাবে কাজ করেছে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
মাত্র তিনটি কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জয় কতটা মনোবল বর্ধকের কাজ করতে পারে তা এদিন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিমদের প্রতিক্রিয়া এবং শরীরি ভাষা থেকেই স্পষ্ট। এবার দেখার আত্মবিশ্বাসী তৃণমূল কীভাবে সামলায় ২০১২ সালের মহারণ।