ক্ষমতায় নেই তো কী হয়েছে? পাটভাঙ্গা পাঞ্জাবি-পাজামা পরে নেতার গা ছুঁয়ে বা ঘুরঘুর করে নজর কাড়ার চেষ্টা করা নেতারা এখনও দলে অনেক আছেন, পোড় খাওয়া নেতা বিমান বসু এদের ভালোভাবে জানেন, এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করেন। কিন্তু তিনি চাইলেই কি হয়? কাজেই সোমবার আরেকবার এঁদের ভালোবাসার দাপটে তিতিবিরক্ত হলেন বিমানবাবু।
দুপুর রোদে প্রায় তিন ঘন্টা টানা পদযাত্রা করে যখন দলের কর্মীদের উদ্দেশ্যে রামপুরহাটে রাস্তার ওপর একটা টুল আকারের মঞ্চে বলতে উঠলেন তিনি, তখন দেখা গেল মঞ্চের পেছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি দেওয়া পুরসভার পুরোনো হোর্ডিং। এতটাই দায়সারা আয়োজন, যে একটা লাল শালু দিয়ে মঞ্চও তৈরি হয় নি। অতি উৎসাহী এক কমরেড সেই মঞ্চে বিমানবাবুর কাছে গিয়ে মোবাইল খুলে সেলফি নিচ্ছেন দেখে বিরক্ত নেতা ফোনটি কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন।
থতমত সবাই। এ কোন বিমান বসু? দুপুর রোদে স্লোগান দিয়ে একজন ৭৯ বছরের মানুষ ১২ কিলোমিটার পথ হাঁটার পর স্বাভাবিকভাবে যে আর বক্তব্য রাখতে পারেন না, বাম দলের নেতারা তা বুঝেও বোঝেন না, ফলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে উত্যক্ত বিমানবাবুর পাল্টা মন্তব্য, "খালি পিনিং করবেন না আমাকে, নিজেদের পশ্চাৎদেশে পিনিং করুন!" সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন, জানুয়ারি মাসে তৃণমূলের ব্রিগেড সভায় বাম দলগুলি যোগ দেবে কী না। এই প্রশ্নের প্রাসঙ্গিকতা হয়তো সেই মূহুর্তে অতটা ছিল না, ফলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বর্ষীয়ান নেতা।
কিন্তু বিমান বসুর রাগ বা আনন্দ, সবটাকেই ছাপিয়ে গেল সাধারণ মানুষের বিস্ময়। ধর্মপ্রাণ মানুষদের তারাপীঠ মন্দির নগরীতে বেশি ভীড় হয় ভাদ্র মাসের অমাবস্যার দিনে। সোমবার বেলা ১১টায় যখন পদযাত্রা শুরু হয়, তখন কয়েক হাজার মানুষের স্রোত তারাপীঠে। সেই অমাবস্যার ভিড়ও হেরে গেল পদযাত্রার জনস্রোতের কাছে। দলের নেতা সুজন চক্রবর্তী, নরেন চ্যাটার্জি, তপন হোড়, রামচন্দ্র ডোম মনসা হাঁসদা পর্যন্ত অবাক সেই জনজোয়ার দেখে। জেলার এক বাম নেতা বলেই ফেললেন, পঞ্চায়েতে মনোনয়ন জমা না করতে দেওয়াতে কর্মীদের যন্ত্রণাটা এখনও কিন্তু পরিষ্কার।
"এত বাধার মাঝে এত মানুষ।" এ কথা সবার মুখে ঘুরতে থাকলো, পথেও গ্রামের মোড়ে মিলল সম্বর্ধনা, অভিনন্দন। সাথে ছোট্ট মন্তব্য, "সরকারে থাকতে এমন করে গাঁয়ে ঘুরতেন তো ভালো হতো।"
নেতারা শুনেও শোনেন না। লক্ষ্যনীয় ছিল দলের মিছিলে কমবয়সী কর্মী সমর্থকদের সংখ্যা। তাঁদের স্লোগান এবং বহুদিনের নিরুদ্ধ দাপট নেতাদের কাছে পেয়ে যেন একেবারে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো।
বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী কটাক্ষ করে বললেন, “মুখ্যমন্ত্রী বীরভূমে মস্তান পুষে রেখেছেন, যে কিনা রুপোর পাঁচন হাতে নিয়ে ঘুরছে, মানুষ এ দাপটের সমুচিত জবাব ঠিক সময় দেবেন।" বাম নেতারা পদযাত্রা শেষে সভায় বললেন, "বিজেপির ধর্ম নিয়ে রাজনীতি যেমন ভয়াবহ, তেমন বিজেপি বিরোধিতার নামে পাল্লা দিয়ে ধর্মের যে রাজনীতি শুরু করেছে তৃণমূল, সেটা আরও ভয়াবহ। কী দরকার ছিল পাল্লা দিয়ে হনুমান পুজো বা খোল করতাল নিয়ে রাম গান করার? আসলে বিজেপিকে মদত দিচ্ছে তৃণমূলের এই রাজনীতি।"
এত বড় কর্মসূচীতে সফল হয়েও বাম নেতাদের কাছে স্থানীয় কর্মীদের একটাই প্রশ্ন, ৭৯ বছরের মানুষটাকে আর কত পরিশ্রম করিয়ে তাঁরা ক্ষান্ত হবেন? দলের অঙ্ক কষে চলা জনবিচ্ছিন্ন নেতারা দলে বড় পদ পেয়ে হয়তো কিঞ্চিৎ পায়াভারি হয়ে গেছেন, গ্রামাঞ্চলের কর্মীরা এখনও ছুটে আসছেন ৭৯ বছরের নেতার নাম শুনে। কিন্তু এভাবে একজন বৃদ্ধ কতদিন টানবেন? দল নেতারা না ভাবুন, মানুষ কিন্তু বলছেন।