মঙ্গলবার লাদাখ সীমান্তে যে রক্তক্ষয়ী হাতাহাতিতে শহিদ হন ২০ জন জওয়ান, প্রমাণ করে ছেড়েছেন ভারতও শক্তিধর চীনকে প্রত্যুত্তর দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। হিমাঙ্কের নীচে তাপমাত্রায় দেশের সেনা জওয়ানরা মারণ কামড় দিয়েই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। কারা ছিলেন সেই সৈনিকরা। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দেশের আলাদা আলাদা ১১টি রাজ্য থেকে এসেছিলেন তাঁরা-
কর্নেল বিক্কুমাল্লা সন্তোষ বাবু, তেলেঙ্গানা:
১৬ বিহার ব্যাটলিয়নের কম্যাডিং অফিসার সন্তোষ বাবু লাদাখে কর্তব্যরত ছিলেন শেষ দেড় বছর। তিন মাস আগেই হায়দরাবাদে পোস্টিংয়ের অর্ডার পেয়েছিলেন। তবে দেশ জোড়া লকডাউন এবং সীমান্তে উত্তেজনার কারণে ফিরতে পারছিলেন না। স্ত্রী সন্তোষী এবং দুই সন্তান ছিলেন দিল্লিতে। বুধবারই তারা তেলেঙ্গানায় ফিরেছেন। কর্ণেলের মৃতদেহ পৌঁছে গিয়েছে হায়দরাবাদে।
হাবিলদার পালানি, তামিলনাড়ু:
তামিলনাড়ুর রামনাথপুরম জেলায় কদুকালার জেলার বসিন্দা তিনি। স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে রেখে গেলেন তিনি। তাঁর ভাইও সেনাবাহিনীর সদস্য। তিনিই প্রথমে দাদার মৃত্যুসংবাদ বয়ে আনেন।
পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে, লাদাখে পোস্টিং হওয়ার আগে পালানি এলাহাবাদ এবং রাজস্থানে পোস্টিং ছিলেন। কিছুদিন আগেই পরিবারের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। সেই সময় তিনি জানান, কিছুদিন ফোনে যোগাযোগ রাখতে পারবেন না। মুখ্যমন্ত্রী পালানিস্বামী এবং বিরোধী নেতা স্ট্যালিন সহ সমস্ত রাজনৈতিক দল এই মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন।
সিপাই গণেশ রঞ্জন কুঞ্জম, ছত্তিশগড়:
অচেনা এক নম্বর থেকে মঙ্গলবার বিকালে কাকা তিহারু রাম কুঞ্জন ভাইপোর মৃত্যুসংবাদ পান। বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল ২৮ বছরের গণেশ রাম কুঞ্জনের। জানুয়ারিতেই বাগদান পর্ব সারতে বাড়ি এসেছিলেন। তিন সন্তানের মধ্যে তিনিই ছিলেন জ্যেষ্ঠ। ছত্তিশগড়ের কাকরের গিঢালি গ্রামে এক কৃষকের পরিবার থেকে উঠে আসা গণেশ বরাবরই সেনায় কাজ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। বাবা ঈশ্বরী রাম কুঞ্জন জানান, প্রথম সুযোগেই আর্মির পরীক্ষায় বাজিমাত করেছিলেন তিনি। তবে অকালেই ঝরে পড়ল একটি প্রাণ।
দীপক সিং, মধ্যপ্রদেশ:
মধ্যপ্রদেশের রেওয়া জেলায় ফরহাদা গ্রামে শেষবার হোলিতে এসেছিলেন। গত নভেম্বরেই বিয়ে করেন। বাবা গজরাজ সিং ভাবতেই পারছেন না তেরঙা জড়িয়ে ফিরে আসবে পুত্রের নিথর দেহ। তবে পুত্রের জন্য তিনি গর্বিত, জানাচ্ছেন পিতা। চলতি জুন মাসেই সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার অষ্টম বছর পূর্ণ করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং এবং প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথ শ্রদ্ধা ব্যক্ত করেছেন।
হাবিলদার সুনীল কুমার, বিহার:
পাটনার তারানগর গ্রাম থেকে ২০০২ এ সেনায় যোগ দিয়েছিলেন সুনীল কুমার। বাবা বাসুদেব সিং গ্রামেই একটা দোকান চালান। রেখে গেলেন এক স্ত্রী এবং সন্তানকে। স্ত্রী রিকি দেবী জানান, সাত মাস আগেই বাড়ি এসেছিলেন সুনীল কুমার। বড়ভাই অনিল কুমার নিজেও প্রাক্তন সেনা। জানালেন, তাদের আশঙ্কাই সত্যি প্রমাণিত হল। তবে গোটা পরিবার সুনীল কুমারের জন্য গর্বিত।
সিপাই কুন্দন কুমার, বিহার:
সহর্ষ জেলার আরণ গ্রাম থেকে যোগ দিয়েছিলেন সেনায়। স্ত্রী সহ পাঁচ ও তিন বছরের দুই সন্তানকে রেখে গেলেন। স্ত্রী বেবি দেবী জানান, "জানুয়ারির ২৭ তারিখে যোগ দিতে ফিরে গিয়েছিল। জুন মাসের ৯ তারিখেই শেষবার কথা হয়। গলা শুনেই বুঝেছিলাম, সীমান্তে টেনশন রয়েছে। ও মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলেছিল।" বাবা নিমেন্দ্র যাদবের দুই বিঘা জমি রয়েছে। তিনি জানান, "পুত্রের আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়।"
সিপাই জয়কিশোর সিং, বিহার:
২৬ বছরের জয়কিশোর বৈশালী জেলার চাকফতা গ্রামের বাসিন্দা। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বড়ভাই নন্দকিশোর সিং সিআরপিএফ জওয়ান। বাবা কাপুর সিং কৃষক। শেষবার ফেব্রুয়ারিতে গ্রামের বাড়ি এসেছিলেন। প্রতিবেশী শিববচন সিং জানান, "নন্দকিশোরের জন্য মেয়ে দেখা চলছিল। গ্রামের যুবকদের কাছে আইডল ছিলেন তিনি। ওর জন্য আমরা গর্বিত। তবে চীনকে যোগ্য জবাব দিতে হবে।"
সিপাই রাজেশ ওঁরাও, পশ্চিমবঙ্গ:
বীরভূমের বেলগরিয়া গ্রামের আদিবাসী কৃষক পরিবারের সন্তান রাজেশ। পিতার একমাত্র পুত্র। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন তিনি। শয্যাশায়ী পিতা সুভাষ জানান, মে মাসেই গ্রামে ফেরার কথা ছিল, তবে লকডাউনের কারণ এ আসতে পারেননি। রাজেশের ভাই অভিজিৎ জানান, মে মাসে ফিরলে ওর বিয়ে চূড়ান্ত করে ফেলা হত। আপাতত ওর দেহ নেওয়ার জন্য প্রতীক্ষায় রয়েছি।
হাবিলদার বিপুল রায়, পশ্চিমবঙ্গ:
উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। আগামী বছরেই স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। স্ত্রী ও পুচকি সন্তানকে নিয়ে মেরুট থেকে ফিরতেও চেয়েছিলেন। বাবা বীরেন রায় জানান, "অবসর নেওয়ার পর গ্রামের বাড়িতে ফিরতে চেয়েছিল। এখন ওর মৃতদেহ পৌঁছাবে। ওর মৃত্যু বৃথা যাওয়া উচিত নয়।"
সিপাই অঙ্কুশ ঠাকুর, হিমাচলপ্রদেশ:
হামিরপুর জেলার কোরহতা গ্রামের বাসিন্দা। ২০১৮ সালের পাঞ্জাব রেজিমেন্টে যোগ দেন। অঙ্কুশ ঠাকুরের বাবা অনিল ঠাকুর জানান, কমিশনার অফিসার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। তার প্রস্তুতির জন্য ট্রেনিং সম্পন্ন হওয়ার পর দশ মাস আগে সঙ্গে করে বইও নিয়ে যায়।
সিপাই গুরতেজ সিং, পাঞ্জাব:
মনসা জেলার বিরোয়ালা ডগড়া গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন। গ্রামের অন্যদের মতোই বিদেশে যেতে চাইতেন। দ্বাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আইইএলটিএস পরীক্ষাতেও পাশ করেন। তবে হঠাৎ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ইচ্ছা হয়। ২০১৮ র ডিসেম্বরে সেনায় যোগ দেন।
সিপাই গুরবিন্দর সিং, পাঞ্জাব:
নিজের বাগদানের জন্য নয় মাস আগে সংগরুরের তোটাওয়ালা গ্রামে এসেছিলেন। এখনো বিয়ের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হয়নি। গ্রামের সরপঞ্চ মেওয়া সিং জানান, এই গ্রামের অনেকেই সেনাবাহিনীতে রয়েছেন। তবে এই প্রথমবারের মত কেউ মারা গেলেন। গ্রামে কেউ সেদিন রান্না করেনি।
নাইব সুবেদার সতনাম সিং, পাঞ্জাব:
ভোজরাজ গ্রামের বাসিন্দা। বুধবার স্থানীয় থানা থেকে জানানো হয় মৃত্যু সংবাদ। পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে ১৯৯৫ সালে সেনায় যোগ দেন। তাঁর দেখাদেখি ভাই সুখচরণ সিংও এখন সেনার নাইব সুবেদার। যিনি আপাতত হায়দরাবাদে পোস্টিং। শেষ তিন দিন পরিবারের লোক যোগাযোগ করতে পারেননি। সীমান্তে উত্তেজনার খবর প্রচারমাধ্যম থেকেই জেনে শুরু হয়ে যায় টেনশন। সেই আশংকাই আপাতত সত্যি হয়ে গেল।
সিপাই কুন্দন কুমার ওঝা, ঝাড়খণ্ড:
দিন দশেক আগেই কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছিল। বাড়ি ফিরে পার্টি দেওয়ার কথা ছিল বন্ধুবান্ধবদের। থাকেন সাহেবগঞ্জে। লাদাখের পোস্টিং নিয়ে সতর্ক ছিলেন। তবে চীনাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে, সেটা ভাবতেও পারেননি। এনসিসি তে নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১১ এ সেনায় যোগ দেন। নিজের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে দেশের সেবার জন্য বাকিদেরও উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি।
সিপাই গণেশ হাঁসদা, ঝাড়খণ্ড:
২০১৮ সালে সেনায় যোগ দেন। বড়দাদা দীনেশ জানান, অত্যন্ত গরিব পরিবারে বেড়ে ওঠে তাঁরা। ভাইকে সেনাবাহিনীতে পাঠানোর জন্য দিনমজুরের কাজও করেছেন। সেই কারণে ধার দেনা করেও নিজেদের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। সেনায় যোগ দেওয়ার প্রথম আট মাসের মধ্যেই সব ধার দেনা মিটিয়ে ফেলা হয়। ২০১৮ সালে সেনায় যোগ দেওয়ার পর পাকা বাড়িও বানিয়েছে পরিবার।
সিপাই চন্দন কুমার, বিহার:
মে মাসেই বিয়ে ছিল। তবে লকডাউনের কারণে তা আর করা যায়নি। ভোজপুরের জ্ঞানপুরের চন্দন কুমার তিন বড় দাদার পদাঙ্ক অনুসরণ করে যোগ দেন সেনায়। বাবা হৃদয়ানন্দ অবসরপ্রাপ্ত হোমগার্ড। তিনি বলেন, আমার পুত্রের এই আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়।
নাইব সুবেদার মনদীপ সিং, পাঞ্জাব:
পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী হিসেবে ১৯৯৮ সালে যোগ দেন সেনায়। এক পুত্র এবং কন্যা পাতিয়ালায় আর্মি স্কুলে পড়াশুনা করেন। লকডাউনে পাতিয়ালায় পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে কিছুদিন আগেই যোগ দেন সেনায়। লাদাখে ছিলেন। শেষবার পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলার সময় নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর কথা বলা হয়নি।
সিপাই চন্দ্রকান্ত প্রধান, ওড়িশা:
কন্ধমল জেলায় রাইকিয়া ব্লকের বিয়ারপাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা। আদিবাসী পরিবার থেকে বেড়ে ওঠা চন্দ্রকান্ত প্রধান পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। বাবা করুনাকর প্রধান প্রান্তিক চাষী। ২০১৪ সালে সেনায় যোগ দেন তিনি। মাস চারেক আগেই গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন।
নাইব সুবেদার নান্দুরাম সোরেন, ওড়িশা:
ময়ূরভঞ্জ জেলার রাইরংপুর এলাকার বাসিন্দা। বড়ভাই ডোমান মাজি জানান, রাইরংপুর কলেজ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি উত্তীর্ণ হওয়ার পর ১৯৯৭ সালে সেনায় যোগ দেন তিনি।
সিপাই আমন কুমার, বিহার:
সামস্তিপুর জেলার সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা আমন কুমার ২০১৪ সালে সেনায় যোগ দেন। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। এক বোনও রয়েছে। বাবা সুধীর কুমার জানান, পুত্র এবং বাকি শহিদদের জন্য তারা গর্বিত।