খিদেয় পেট জ্বলছে। কিন্তু, বাইরে বেরোলেই বিপদ। ঘনঘন সাইরেন বাজছে। কখনও যে এসে একটা বিরাট গোলা ঘাড়ে পড়বে, কেউ জানে না। অথবা হয়তো, শরীরে বিঁধেই গেল কালাশনিকভের গুলি। শুধু রাজধানী কিয়েভই না। ইউক্রেনের সব শহরই এখন এমনই আস্ত মৃত্যুপুরী। এই বিপদ থেকে বাঁচার উপায় একটাই। বাংকারে আর পাঁচ জনের সঙ্গে গাদাগাদি করে থাকা।
হাঙ্গেরি আর পোল্যান্ড সীমান্ত খুলে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, ওই দুই পথ দিয়ে ইউক্রেনের মানুষজন পালাতে পারবেন। অন্তত, মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবেন। মিলবে নিশ্চিন্ত ঠিকানা। কিন্তু, সীমান্ত পর্যন্ত যাবে কী করে মানুষজন! সব শহরই তো রুশ সেনা ঘিরে রেখেছে। তাদের পেরিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছনো তো অসম্ভব।
রাশিয়ার জালে বন্দি হয়ে এখন এই অসহায় অবস্থায় গোটা ইউক্রেন। যতক্ষণ, খাবার-পানীয় আছে, ততক্ষণই ভরসা। প্রথমে অবশ্য অনেকেরই সেটা মনে হয়েছিল। কিন্তু, পরে স্কুল থেকে সাধারণ বাড়িগুলোর ওপর রুশ সেনা যখন বোমাবর্মণ শুরু করল, সাধারণ মানুষ বুঝে গেল, একবিংশ শতাব্দীতেও পৃথিবীটা কত যেন অসহায়।
এরমধ্যেই তো ওঁরা আছে। ওঁরা মানে দু'চোখে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভারত থেকে পড়তে আসা ছেলেমেয়েরা। পড়তে অনেক টাকা খরচা। ধারদেনা করে কোনওমতে সেই টাকা দিয়েছে পরিবার। ডাক্তারি পাশ করে কোথাও একটা ভালো ব্যবস্থা করে এবার পরিবারকে টাকা ফেরতের স্বপ্ন দেখছিলেন ওঁরা। এই তো আর ক'টা মাস। কেউ তৃতীয়, তো কেউ চতুর্থ বর্ষ। 'দুটো-তিনটে বছর কষ্ট করেছি। বাকিটাও দেখতে দেখতে কেটে যাবে,'- এই তো ছিল ওঁদের আশা। সে আশায় ভর করেই রাশিয়ার আক্রমণকে ওঁরা গুরুত্ব দেননি। কলেজ কর্তৃপক্ষের কথাতেই ভরসা রেখেছিলেন।
যদি লেখাপড়ার ক্ষতি হয়! ফিরতেও তো অনেক টাকা! এসব সাত-পাঁচ ভেবে ওঁরা আগে থাকতে তাই ফেরেননি। ভারতীয় দূতাবাস যখন বারবার করে দেশে ফেরার তাড়া দিতে লাগল, তখনও ওঁদের অনেকে ছিলেন দ্বিধায়। কেউ আবার আফগানিস্তানে আটকে পড়া ভারতীয়দের পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে দূতাবাসের বার্তা পেয়েই ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, ততদিনে বিমানের সব টিকিট বুকিং হয়ে গেছে। তা-ও যাদের টিকিট মিলেছিল, মস্কোর বোমা ফেলার তাড়াহুড়োতে তাঁদেরও ফেরা আটকে গেছে।
আরও পড়ুন- রুশ গোলার মুখেও মাথা নত হয়নি, ১৩ শহিদ বর্ডার গার্ডসকে ‘হিরো’র মর্যাদা ইউক্রেনের
ততদিনে অসামরিক বিমান পরিবহণ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে ইউক্রেন। এই হাজার হাজার ভারতীয় ছাত্রদের এখন অবস্থা ইউক্রেনের আর পাঁচ জন নাগরিকের মতোই। 'বম্ব বাংকার'- মানে মেট্রো স্টেশন অথবা হস্টেলের ভূগর্ভস্থ অংশ, বাঁচার একমাত্র ঠাঁই। আশা বলতে বিদেশমন্ত্রকের আশ্বাস। শুনেছেন, তাঁদের ফেরানো হবে। কিন্তু, সেটা কবে! পরিবারের থেকে বিচারাধীন বন্দি যেমন আশ্বাস পায়, এ-ও যেন তেমনই। না, তার চেয়েও বেশি। কারণ, ওঁরা জানেন না। কাল দেখতে পাবেন কি না! বিদেশ-বিভুঁইয়ে এই অসহনীয় পরিস্থিতি সামলেই ফোনে পরিবারের লোকেদের কাছে ভালো থাকার বার্তা দিচ্ছেন ওঁরা। কারণ, যাতে দুশ্চিন্তায় অভিভাবকদের কারও কোনও অঘটন না-ঘটে যায়! সেই দায়ও এখনও ওঁদেরই কাঁধে।
Read story in English