ভোট তলানিতে-পুঁজি নেই-বাড়ছে দলীয় কোন্দল, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেতাজি প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড ব্লক

নেতাজি পরিবারের সদস্যদের প্রশ্ন, সুভাষচন্দ্র বসু যে বাম আদর্শে বিশ্বাস করতেন তা কী ফরওয়ার্ড ব্লক মেনে চলে?

Netajis Forward Bloc struggles to stay afloat amid financial woes dip in vote share
ধুঁকছে নেতাজির তৈরি ফরওয়ার্ড ব্লক।

ঘটা করে উদযাপন হল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ১২৫তম জন্মজয়ন্তী। কিন্তু হতশ্রী দশা নেতাজি প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতক দল ফরওয়ার্ড ব্লকের। দলের একজনও সাংসদ বা বিধায়ক নেই। রয়েছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। চরম আর্থিক দুরাবস্থা। এই পরিস্থিতিতে ১৯৩৯ সালে নেতাজির তৈরি ফরওয়ার্ড ব্লক অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই চালাচ্ছে।

নেতাজির আদর্শ সামনে রেখেই ফরওয়ার্ড ব্লক পরিচালিত হত। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় বাংলা তো বটেই, দেশের দক্ষিণে তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল, অসম, বিহারের মতো রাজ্যগুলিতে নেতাজি প্রতিষ্ঠিত দলের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। ছিল দলের একাধিক সাংসদ ও বিধায়কও। কিন্তু,গত কয়েক বছরে ক্রমশ হ্রাস পেয়েছে বাংলায় বামফ্রন্টের অন্যতম এই শরিক দলের ক্ষমতা। বর্তমানে কয়েকটি অঞ্চলে ফরওয়ার্ড ব্লকের ক্ষীণ অস্তিত্ব দেখা যায়, নেই কোনও সাংসদ বা বিধায়ক।

দলের এই ক্ষয় উপলব্ধি করেছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের বর্তমান নেতৃত্ব। পুঁজি কম, তার উপর এ রাজ্যে প্রায় তিন দশক সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের অংশীদার হওয়ায় কার্যত স্বতন্ত্রতা হারিয়েছে দল। ফলে গড়ে হঠেনি নিজস্বতা। যা এই মুহূ্তে ফরওয়ার্ড ব্লকের পুনরুজ্জীবনে বড় বাধা বলে মনে করছেন দলের বর্তমানে নেতৃত্ব।

সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাসের কথায়, ‘এটা ঠিক যে আমরা গভীর সংকটে। স্বাধীনতার পরে একটা সময় বাংলা ছাড়াও দক্ষিণ ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্য, মহারাষ্ট্র, বিহারে আমাদের বিধায়ক ছিল। এখন আমাদের কোনও জনপ্রতিনিধি নেই। বিগত কয়েক বছর ধরে সদস্যও কমেছে। কীভাবে ফের দলের পুনরুজ্জীবন সম্ভব তা নিয়ে দলীয়স্তরে আলোচনা চলছে।’

নেতাজীতো ছিলেনই, এছাড়াও পরবর্তীতে ফরওয়ার্ড ব্লকের অন্যতম নেতৃত্ব ছিলেন এইচ ভি কামাথ, হেমন্ত বসু, আরএস রুইকার, এসবি এস বি ইয়াগী এবং এসএস কবিশার-রা। দেবব্রতবাবুর দাবি, স্বাধীনতার পরে বেশ কয়েকবার দলের মধ্যে আদর্শগত বিরোধ প্রকট হয়েছে। ফলে দল ভাগ হয়েছে। সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদকের দাবি, একাধিক বিভক্তি এবং বিশিষ্ট নেতাদের অন্য দলে চলে যাওয়া ফরওয়ার্ড ব্লকের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ। তাঁর কথায়, ‘দলে এমনসব বরেণ্য নেতৃত্ব ছিল যাঁরা নেতাজির পরবর্তী সময় দলকে দিশা দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরে সবাইকে একসূত্রে গেঁথে রাখা যায়নি। ১৯৪৮ সাল থেকে দলে বেশ কয়েকবার ভেঙেছে। প্রথমে রুইকার ও ইয়াঙ্গি গ্রুপের মধ্যে ভাগ, তারপরে অন্যান্য রাজ্যেও দল ভেঙেছে।’

দবব্রত বিশ্বাসের সংযোজন, ‘অনেক নেতাই চাইতেন ফরওয়ার্ড ব্লককে কংগ্রেসের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। পরে তাঁদেরই অনেকে কংগ্রেস অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনে যোগদান করেন। শীর্ষ নেতৃত্বের প্রয়াণের পর অনেক জায়গায় আমরা সেই স্থানও পূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়েছি।’

কংগ্রেসের সভাপতি পদ ত্যাগের পর নেতাজি ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে দলের মধ্যেকার বাম ও সমাজাতান্ত্রিক ভাবধারার সদস্যদের নিয়ে ব্লক গঠন করেন। এর প্রথম সভাপতি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে এইচভি কামাথ। পরে যার নাম হয় ফরওয়ার্ড ব্লক। সমাজতান্ত্রিক ভাবনাকে পাথেও করেই এই দল পরিচালিত হতে থাকে।

২০০৪ সালে জাতীয় রাজনীতিতে গোটা ভারতে ফরওয়ার্ড ব্লকের ভোটের হার ছিল ০.৩৫ শতাংশ। যা ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কমে দাঁড়ায় ০.০৫ শতাংশে। একদা ঘাঁটি বাংলাতেও অবস্থা শোচনীয়। ২০১১ সালের বিধানসভায় প্রায় ৪.৮০ শতাংশ কমতে কমতে ২০২১-এ এই দলের ভোটের হার শতাংশের বিচারে ০.৫৩। বর্তমানে, পশ্চিমবঙ্গের কিছু পকেটে ফরওয়ার্ড ব্লকের কয়েকজন মাত্র পঞ্চায়েত সদস্য রয়েছে।

দলের পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব তৈরি করা যায়নি, যুবশক্তিকেও আদর্শ দ্বারা উদবুদ্ধ করা যায়নি। যার ফলই বর্তমানে ফরওয়ার্ড ব্লকের করুণ অবস্থা বলে মনে করেন দলীয় নেতারা। সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস বলেন, ‘যদিও তরুণদের মধ্যে নেতাজির জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে শ্রদ্ধা ও কৌতূহল রয়েছে, তবুও আমরা তাদের দলের মধ্যে আনতে ব্যর্থ হয়েছি। তার উপরে, সুভাষবাদ নাকি বাম মতাদর্শ অনুসরণ করবেন? জনগণের মধ্যে এ নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। নিঃসন্দেহে নেতাজি একজন বামপন্থী ছিলেন, কিন্তু তিনি সাম্যবাদের মতাদর্শ প্রচার করেছিলেন।’

দেবব্রতবাবুকে সমর্থন করেই তাকে দলের রাজ্য সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি জানিয়েছেন যে, আর্থিক অভাবই দলের উত্তোরণের পথে মূল বাধা। তিনি বলেছেন, ‘বর্তমান ভারতে, আপনি যদি রাজনীতিতে পা রাখতে চান, আপনার অর্থের প্রয়োজন। ২০১১ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতা হারানোর পর, আমাদের আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল। আমরা এখন সদস্যদের কাছ থেকে সংগৃহীত শুল্ক, দলীয় চাঁদা এবং দলীয় সহানুভূতিশীলদের অনুদানের ভিত্তিতে দল চালাচ্ছি। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। আমরা যদি দলকে শক্তিশালী করতে চাই তবে আমাদের অর্থ দরকার।’

দলের পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে, দেবব্রত বিশ্বাস বলেছিলেন যে নেতাজির অন্তর্ভুক্তি এবং সাম্যবাদ নীতির উপর বিশেষ জোর দিয়ে একটি সাংগঠনিক সংশোধনের জন্য আলোচনা চলছে। তাঁর দাবি, ‘ফরওয়ার্ড ব্লককে বামফ্রন্টের অংশীদার হিসাবে দেখা হয়। নেতাজির দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী দলের গঠনতন্ত্র, নীতি পরিবর্তনের জন্যই আলোচনায় বাম ঐক্য থাকবে, কিন্তু আমাদের আলাদা পরিচয় জরুরি, যার মাধ্যমে সারাদেশের নেতাজি অনুগামীরা আমাদের চিনবে।’

তবে নেতাজির পরিবারের সদস্যরা মনে করেন যে, যখন ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও সিপিআইএম প্রাসঙ্গিক হতে সংগ্রাম করছে তখন বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সংগঠনটিকে পুনরুজ্জীবিত করা ফরওয়ার্ড ব্লকের জন্য কঠিন একটি চ্যালেঞ্জের কাজ। চন্দ্র কুমার বসু বলেছেন, ‘বছরের পর বছর ধরে ফরওয়ার্ড ব্লক সিপিআই (এম)-এর অনুগামী দলে পরিণত হয়েছে। এবং এখন, সিপিআই (এম)-এরই ছন্নছাড়া অবস্থা, ফলে ফরোয়ার্ড ব্লকের ক্ষেত্রে পুনরুজ্জীবনের বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন।’

চন্দ্র কুমার বসুর কথায়, ‘নেতাজি বাম মতাদর্শের একজন প্রবক্তা ছিলেন যা দেশের মাটির বাস্তবতায় নিহিত ছিল, তিনি অন্য কমিউনিস্ট দেশকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেননি।’

নেতাজি পরিবারের আরেক সদস্য, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ও নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর চেয়ারম্যান সুগত বসু বলেছেন, ‘স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ফরওয়ার্ড ব্লকের নেতাজি এবং তাঁর আদর্শের সঙ্গে সম্পর্ক খুব কমই রয়েছে। তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক ত্যাগ করেছিলেন, আইএনএ গঠন করেছিলেন এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন৷ নেতাজি যে সংগঠন ১৯৩৯ সালে তৈরি করেছিলেন তার সঙ্গে বর্তমানের প্রান্তিক রাজনৈতিক দলটিকে তুলনা করা ভুল হবে৷ নেতাজির আদর্শ রাজনীতির ঊর্ধ্বে’

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন বর্তমানে ফরওয়ার্ড ব্লক পশ্চিমবঙ্গে একটি ক্ষয়ীষ্ণু শক্তি এবং এর পুনরুত্থান অত্যন্ত কঠিন কাজ। রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর কথায়, ‘২০১১-র পরে পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। কীভাবে দলকে এক সূত্রে নেতৃত্ব গেঁথে রাখবে তা নিয়েও স্পষ্ট ধারণা নেই। ফলে বাংলায় দলের পুনরুজ্জীবন শুধু কঠিন নয়, অসম্ভব বলেই মনে হয়।’

Read in English

Stay updated with the latest news headlines and all the latest Politics news download Indian Express Bengali App.

Web Title: Netajis forward bloc struggles to stay afloat amid financial woes dip in vote share

Next Story
‘সমঝোতার বার্তা দিয়েও দল ভাঙানো জারি’, তৃণমূলকে তুলোধনা চিদম্বরমের
Exit mobile version