পাহাড়ের উন্নয়নে নতুন কমিটি গড়ল রাজ্য সরকার। ৪ দিনের পাহাড় সফরে এসে মঙ্গলবার এই কমিটির কথা ঘোষণা করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কমিটির মাথায় বসানো হয়েছে দার্জিলিং-এর বিধায়ক অমর রাইকে। এছাড়াও কমিটিতে রয়েছে দার্জিলিং ও কালিম্পং-এর জেলাশাসক, দুই জেলার পুলিশ সুপার, জিটিএ চেয়ারম্যান বিনয় তামাং সহ পাহাড়ের বিধায়কেরা। মূলত পাহাড়ের উন্নয়নই এই কমিটির প্রধান লক্ষ্য বলে জানিয়েছেন তিনি।
আর এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলির প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে রাজ্য সরকারকে। পাহাড়ের উন্নয়নের জন্যে জিটিএ থাকলেও কেনো পৃথক কমিটি গড়া হল তা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে শুরু হয়েছে কানাঘুষো। তবে কি বিনয়ে আস্থা নেই তাই নতুন কমিটি গড়ল রাজ্য? এমন প্রশ্নই তুলছে বিরোধীরা। লোকসভা ভোটে পাহাড়ের ভোটব্যাংক নিজেদের হেফাজতে রাখতেই এই কমিটি বলে মনে করছেন অশোক ভট্টাচার্যের মতো পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদরা।
আরও পড়ুন, মৃত্যু মিছিলের বিরাম নেই পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠনেও, কিন্তু দায় কার!
পাহাড়ের উন্নয়নে ১৯৮৮ সাল থেকে ২৩ বছর গোর্খা হিল কাউন্সিল থাকলেও পরবর্তীতে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ তা ভেঙে দিয়ে জিটিএ ( Gorkha territorial administration) গঠন করা হয়। ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে জিটিএ গঠন হওয়ার পর মোর্চা নেতা বিমল গুরুং জিটিএ-এর চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। ত্রিপাক্ষিক চুক্তিতে সিদ্ধান্ত হয় জিটিএ-র মাধ্যমেই পাহাড়ের উন্নয়ন হবে। সেইমতো জিটিএ-র মাধ্যমেই পাহাড়ের উন্নয়নে টাকা বরাদ্দ করে রাজ্য ও কেন্দ্র। এর মাঝে বেশ কয়েকবার পাহাড়েও আসেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেইসময়ে তৎকালীন মোর্চা সুপ্রিমোর সঙ্গে তৃণমূল সরকারের সুসম্পর্ক থাকলেও গত লোকসভা ভোটের আগে থেকে ছন্দ পতন ঘটে। কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসতেই মোর্চা-বিজেপি সখ্যতা বাড়তে থাকে। মোর্চার সমর্থনে দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্র থেকে গত লোকসভা ভোটে বিপুল ভোটে জয়ী হন বিজেপি প্রার্থী সুরিন্দর সিং অালুওয়ালিয়া। তৃণমূলের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তেই জিটিএ-র কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে রাজ্য সরকার। পাহাড়ের সভা থেকেই তৎকালীন মোর্চা সুপ্রিমোকে হুঁশিয়ারি দিতে শোনা যায় মুখ্যমন্ত্রীকে। এইরকম চলতে থাকায় গত বছরের মার্চ মাসে গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে সরব হয় মোর্চা। রাজ্যের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের কথা ঘোষণা করে মোর্চা। মোর্চার হুঁশিয়ারিকে উপেক্ষা করেই পাহাড়ে ক্যাবিনেটের মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি পাহাড় থেকে নামতেই শুরু হয় সংঘর্ষ। পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয় মোর্চা সমর্থকদের। টানা একমাসেরও বেশি সময়ের সংঘর্ষে দুই পক্ষেরই বেশ কয়েকজন গুরুতর জখম হন। মৃত্যুও হয় দুপক্ষের বেশ কয়েকজনের। বিমল গুরুংয়ের বিরুদ্ধে রাষ্টদোহিতার অভিযোগ আনে রাজ্য। এরপর থেকেই পুলিশের ভয়ে পাহাড় ছাড়ে বিমল ও রোশন। কৌশলে তৃণমূলের পরোক্ষ মদতেই জিটিএ-এর মসনদে বসে বিমলের একসময়ের ছায়াসঙ্গী বিনয় তামাং।
এরপর থেকে বিনয়ের নেতৃত্বই পাহাড়ে কাজ করছে জিটিএ। খোদ মুখ্যমন্ত্রী বিনয়কে ক্লিনচিট দেওয়ার পর জিটিএ-এর মাধ্যমেই পাহাড়ের উন্নয়নে ব্রতী হয় রাজ্য। কিন্তু লোকসভা ভোট আসন্ন হওয়ায় দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্র নিয়ে চিন্তিত তৃণমূল। লোকসভায় পাহাড়ের মানুষের সমর্থন ছাড়া যে জয় অনিশ্চিত তা বুঝে গিয়েছে তৃণমূল। লোকসভা নির্বাচনের আগে পাহাড় নিয়ে কোনওরকম ঝুঁকি নিতে নারাজ তৃণমূল সুপ্রিমো। সে কারণেই জিটিএ থাকা সত্ত্বেও পাহাড়ের উন্নয়নে পৃথক কমিটি গড়ল রাজ্য বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। কিন্তু এই কমিটির যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে বিরোধীরা। পাহাড়ের উন্নয়নের জন্যে আগে থেকেই রয়েছে জিটিএ। জিটিএ-র মাধ্যমে উন্নয়ন হলে এই কমিটির কাজ কী থাকবে তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। আর উন্নয়নে যদি নতুন কমিটি কাজ করে তবে জিটিএ-র কী কাজ থাকবে তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। তবে কি বিনয় তামাং পরিচালিত বোর্ডের প্রতি ভরসা না থাকাতেই পাহাড়ে নতুন কমিটি গড়ল রাজ্য, সেটাই এখন পাহাড়ের রাজনীতিতে সব থেকে বেশি আলোচ্য বিষয়।
অন্যদিকে, মঙ্গলবার জিটিএ নিয়ে একটি রিভিউ বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠক শেষে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন," পাহাড়ের উন্নতির জন্যে একটি শর্ট টাইম, একটি মিডল টাইম ও একটি লং টাইম প্ল্যানিং প্রয়োজন। তাই মুখ্যসচিব একটি কমিটি তৈরি করেছেন। কী করে দার্জিলিংয়ের উন্নতি করা সম্ভব সেই বিষয়ে ছয় মাস বাদে একটি রিপোর্ট দেবে এই কমিটি। মূলত দার্জিলিং পাহাড়কে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে বাইরে নিয়ে আসা এবং পর্যটনের উন্নতিতে কী করণীয় তা দেখবে এই কমিটি।"
রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা শিলিগুড়ির বাম বিধায়ক অশোক ভট্টাচার্য বলেন,"আসলে মুখ্যমন্ত্রী কারও উপরেই ভরসা রাখতে পারেন না। তাই তিনি আবার নতুন কমিটি বানালেন। উনি 'ইউজ অ্যান্ড থ্রো' পলিসিতে বিশ্বাসী। পাহাড়ের এখনই জিটিএ নির্বাচন হলে ৯০ শতাংশ ভোটই বিনয়ের বিপক্ষে যাবে। এটা তৃণমূল বুঝতে পেরেছে।"