রাজ্যে বাম আন্দোলন প্রায় শয্যাশায়ী। নবান্ন অভিযানের দিন ধর্মতলায় পুলিশের লাঠিপেটার পর বামেদের রাস্তায় নেমে আন্দোলন তেমন একটা চোখে পড়েনি। মিছিলে পর্যাপ্ত লোক পর্যন্ত হয় না। সামনের সারিতে সেই ৬০-৭০ এর দশকের নেতৃত্ব। সবই পক্ককেশযুক্ত।
কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় মনে হচ্ছে, ছাত্র আন্দোলন নতুন দিশা দিতে পারে বামেদের। বাম ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্বও মনে করছেন তাঁদের সংগঠন বাড়ছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য সমাপ্ত আন্দোলনের ফলে রীতিমত পিছু হঠতে হয়েছে সরকার পক্ষকে। নিজের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। স্নাতকস্তরে কলা বিভাগে ভর্তির পরীক্ষা ফের চালু করার দাবিতে চলছিল আন্দোলন। চার দিনের অনশন আন্দোলনের কাছে ঝুঁকতে হয়েছে কর্তৃপক্ষকে। মানতে হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের দাবি।
এই আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত ছিল যাদবপুরের এসএফআইয়ের সংগঠন, দাবি সংগঠনের রাজ্য নেতৃত্বের। এখনও যাদবপুরে কলা বিভাগের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের দখলে রয়েছে। ময়দানে ছাত্রছাত্রীদের ইস্যুর সঙ্গে থাকলে যে ফল পাওয়া যায় তা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
যাদবপুরের ঘটনার পরপরই হস্টেলের দাবিতে শুরু হয়ে যায় মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়াদের অনশন। টানা অনশনে পড়ুয়ারা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাতেও কোনও হেলদোল দেখা যায়নি কর্তৃপক্ষের। কিন্তু অনশন ১৩ দিন গড়িয়ে ১৪ দিনে পড়তে অবশেষে টনক নড়তে শুরু করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় ওঠে আন্দোলন নিয়ে। ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ ওই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। চাপে পড়ে কর্তৃপক্ষ দাবি মেনে নেওয়ায় অনশন উঠে যায়। তারপর রাস্তায় ছাত্রদের বিজয় উল্লাসে দেখা গিয়েছে গাঢ় লাল রঙের আবিরে মাখামাখি হতে।
নকশালপন্থীরা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকলেও এসএফআইও ছিল আন্দোলনকারীদের পাশে। সাংগঠনিক ভাবে খোঁজখবর রাখা, ডাক্তার দেখানো-সহ নানাভাবে মেডিক্যালের পড়ুয়াদের পাশে থেকেছে। সিপিএম নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, সুজন চক্রবর্তী, বিকাশ ভট্টাচার্যরা অনশনস্থলে ছাত্রদের পাশে দাঁড়ান। এই ইস্যুতে নিজেদের সমর্থন জাহির করতে বিধানসভায় বিক্ষোভ প্রদর্শনও করে বামেরা।
এসএফআইয়ের রাজ্য সাধারন সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্যর বয়স এখন ২৫। যখন ওই পদে এসেছিলেন তখন সবে ২৪ পার করেছিলেন। সম্ভবত সৃজনই সবচেয়ে কম বয়সে ওই পদে এসেছেন।
স্বরলিপি চট্টোপাধ্যায় চারুচন্দ্র কলেজের ফাইনাল বর্ষের ছাত্রী। মাত্র এক বছর আগে এসএফআইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। সংগঠনের দুর্বলতার কথা স্বীকার করলেও এসএফআইয়ের আন্দোলনের ওপর পূর্ণ আস্থা আছে তাঁর। তিনি বলেন, "আন্দোলন করলে এখনই রাতারাতি সব পরিবর্তন হয়ে যাবে না। তবে ক্রমাগত পড়ুয়াদের পাশে থেকে আন্দোলন করলে ভবিষ্যত বামেদের। এখনই সমাজে কোনও জায়গা করতে পারছি না বলে আন্দোলন বন্ধ করতে হবে, সেটা তো হতে পারে না। ১০ বছর বা ১৫ বছর পরে হোক, আমরা আসবই।"
এই সময়ে নতুন করে এসএফআইয়ের আন্দোলনের সঙ্গে কেন? তাঁর মতে, "আন্দোলনটাকে জারি রাখতে পারব। এই বিশ্বাস নিয়েই সংগঠন করছি। আমরা আমাদের দিক থেকে জয়ী হবই। আমরা পারব। তাই এসএফআই করা। টিএমসি বা বিজেপি, এদের কোনও আদর্শ নেই। মার্কসবাদই একমাত্র আদর্শ হতে পারে।"
আরও পড়ুন: প্রেসিডেন্সিতে ছাত্র আন্দোলন, ফের নতি স্বীকার কর্তৃপক্ষের
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনে আবার মুখ্য ভূমিকায় এসএফআই। প্রেসিডেন্সিতে জোরদার সংগঠন রয়েছে তাদের। ছাত্র সংসদের ক্ষমতায় রয়েছে আইসি, কিন্তু প্রেসিডেন্সিতে যে কোনও আন্দোলনেরই রাশ থাকে এসএফআইয়ের হাতে।
সম্প্রতি শহরে কলেজ ভর্তিতে দুর্নীতি এবং তোলাবাজি নিয়ে লালবাজার অভিযানে নেমেছিল বাম ছাত্র সংগঠন। তাতে আর কিছু না হোক, তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের আপাত দুর্নীতি এবং এসএফআইয়ের দৃশ্যত ছাত্রবন্ধু গোছের ভাবমূর্তির ফারাক স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সাধারন সম্পাদক সৃজন বলেন, "বিজেপি, তৃণমূলের নীতির কারণেই মানুষের কাছ থেকে তারা দূরে সরে যাবে। ছাত্র সংগঠন টাকা মারার চ্যানেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের দাবিদাওয়া নিয়ে তাঁদের পাশে থাকলে সংগঠন বাড়তে বাধ্য। ছাত্রছাত্রীরা যেন বুঝতে পারে কারা তাদের আসল বন্ধু। শিক্ষা সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে প্রতিদিন রাস্তায় নামছি। ভবিষ্যত বাম ছাত্র সংগঠনেরই।"
প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন অধ্যক্ষ অধ্যাপক অমল মুখোপাধ্যায়ের অভিমত, "সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের ফলে কিছুটা আশার আলো দেখতেই পারে বামেরা। তবে এই সব আন্দোলন অনেকটাই স্বতন্ত্র। অনেকটাই নিরপেক্ষ। সিপিএম এখন অত্যন্ত দুর্বল। যেহেতু এখানে কর্মসংস্থানের সমস্যা রয়েছে, তাই শাসকদলে ভিড় থাকাই স্বাভাবিক।"