Advertisment

ঠুনকো প্রতিশ্রুতি! পঞ্চায়েত ভোট বয়কটের সিদ্ধান্ত ছিটমহলবাসীর

উন্নয়ন হয়নি, প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি, পড়ে আছেন যে-কে-সেই। স্কুল বহুদূর, জমির কাগজ নেই, নেই শৌচাগার। অজস্র অভিযোগ নিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট বয়কটের সিদ্ধান্ত ছিটমহলবাসীর।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
cooch behar, enclaves

কোচবিহারে ছিটমহলবাসীদের ছবি। সৌজন্য- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

রাভীক ভট্টাচার্য

Advertisment

২০১৫ সালের পয়লা অগাস্টের কথা। ৩৭টি ছিটমহলের প্রায় ১৪ হাজারেরও বেশি সংখ্যক মানুষ নতুন করে বাঁচার মানে খুঁজে পেয়েছিলেন। নতুন পরিচিতি পেয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছিলন ওঁরা। ভারত-বাংলাদেশ সরকারের ছিটমহল বিনিময়ের দরুন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন ওঁরা। কিন্তু ৩ বছর পার হলেও, এখনও সে স্বপ্ন যেন অধরাই রয়ে গেছে তাঁদের। স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নিকাশি ব্যবস্থা, রাস্তা, শৌচাগার... এসবের প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বাস্তব ছবিটা অন্য। অন্তত এমনটাই বলছেন কোচবিহারের কোকোয়াবাড়ির প্রদীপ বর্মনরা। এদিকে সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। এমনিতেই পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে রাজ্য রাজনীতি উত্তাল। এর মধ্যেই এবার ছিটমহলবাসদের ক্ষোভের ছবিটা সামনে এল। ক্ষোভের বশে এবার পঞ্চায়েত ভোট বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রদীপ বর্মনরা।

কে এই প্রদীপ বর্মন? বছর ছাব্বিশের এই যুবক প্রাক্তন ছিটমহলবাসী। ভারত-বাংলাদেশ সরকারের ঐতিহাসিক ছিট বিনিময়ের পর কোচবিহারেই আপাতত আস্তানা প্রদীপদের। কোকোয়াবাড়িতে প্রদীপদের মতো অন্য বাসিন্দাদেরও ভরসা অস্থায়ী শৌচাগার। স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে ভাল শৌচাগারের আশায় আজও অপেক্ষা করছেন তাঁরা। এলাকায় বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য কোনও স্কুলও নেই। অধিকাংশ পড়ুয়ারই তাই ভরসা আড়াই কিমি দূরত্বের প্রাথমিক বিদ্যালয়। উঁচু ক্লাসের পড়ুয়াদের এজন্য আবার আরও কষ্ট করতে হয়। কারণ, কাছেপিঠের হাইস্কুলে যেতে গেলে পেরোতে হয় ৫ কিমি পথ। এমন দুর্দশার ছবিই তুলে ধরলেন প্রদীপ বর্মন।

চাষবাসের জন্য তাঁদের সামান্য জমি রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রদীপ। ‪ফালানপুর এলাকায় ৫০৬ একর পর্যন্ত জমি রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে নলগ্রাম এলাকায় ১ হাজার ৩৯৩ একরের মতো জমি রয়েছে। তবে এলাকার কোনও বাসিন্দার হাতেই এখনও পর্যন্ত এসব জমির কাগজপত্র নেই বলে দাবি তাঁর। ‘‘সেচের জন্য আমাদের কাছে মাত্র কয়েকটা নলকূপ ও সৌর বিদ্যুৎ চালিত পাম্প রয়েছে। এমনকি ভোটার কার্ডে প্রয়োজনীয় ঠিকানাও লেখা নেই’’, আক্ষেপের সুরে বললেন প্রদীপ। ‘‘রাজনৈতিক দলগুলির নেতারা এখন আমাদের কাছে আসছেন। কিন্তু সবাই ঠিক করেছি, এবার পঞ্চায়েত ভোট দেব না’’, সাফ জানালেন বছর ছাব্বিশের ওই যুবক। প্রদীপের অভিযোগ, তাঁদের স্রেফ ঠকানো হয়েছে। তিনি বলেন, খবরের কাগজে দেখতে পাই যে টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, কিন্তু সে অনুযায়ী কাজ দেখতে পাই না।

‘‘আমাদের বোধহয় সবাই ভুলে গেছেন’’, ফোনের ওপার থেকে এমন আক্ষেপই শোনা গেল ফালানপুরের বাসিন্দা ৬৬ বছর বয়সী বীজেন্দ্রনাথ বর্মনের গলায়। তিনি বললেন, ‘‘ভোটের আগেই কেবল সরকারের লোকেরা এসে জমির মাপজোক করে। তারপরই তারা কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে যায়।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, কোনও ভাল রাস্তা নেই, এখনও এলাকায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র খোলেনি। এখনও জমির কাগজপত্র পায়নি কেউ। কারও কাছেই এক-দু বিঘার বেশি জমি নেই বলে দাবি করেছেন ওই বৃদ্ধ। বীজেন্দ্রনাথ বর্মন সাবেক ছিট নাগরিক সুরক্ষা কমিটির সভাপতি ছিলেন, যে কমিটি ছিটমহলবাসীদের জন্য লড়াই চালিয়ে গিয়েছিল।

আরও পড়ুন,পঞ্চায়েত ভোট: মনোনয়নপর্বে হিংসার নিন্দায় বিদ্বজ্জনরা

বছর চল্লিশের কমলেশ্বর সরকারের মুখেও দুর্দশার কথা শুনতে পাওয়া গেল। হলদিবাড়ির অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে পরিবার নিয়ে আপাতত ঠাঁই কমলেশ্বরের। বাংলাদেশে থাকাকালীন একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে কাজ করতেন তিনি। নার্স হিসেবে কাজ করতেন তাঁর স্ত্রী। আর আজ, ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সেই কর্মী রুজি-রুটির জন্য টোটো চালান। মাসের শেষে সরকারের রেশনের জন্য ভরসা করতে হয় কমলেশ্বরবাবুদের। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য বলে মত তাঁর।

হলদিবড়িতে অস্থায়ী ঘরে কমলেশ্বরের সঙ্গে থাকেন তাঁর তিন ভাই। সেখানে ৬-৭ পরিবার একটি ঘরেই দিনযাপন করছে বলেও জানা গেছে। কমলেশ্বরের ভাইয়েরা পালা করে দুটি টোটো চালান। ‘‘আমাদের পদবী রায়, কিন্তু ভোটার কার্ডে লেখা সরকার,’’ এমনই দাবি করেছেন রায়বাবু ওরফে, কমলেশ্বর সরকারের স্ত্রী কণিকা। গৃহকর্তা জানিয়েছেন, সরকারের কাছ থেকে তাঁরা মাসে ৩০ কেজি চাল, ৫ লিটার সর্ষের তেল, ৫ কেজি কেরোসিন, কেজি মুসুর ডাল, ২ কেজি নুন ও ২ লিটার দুধ পান। তাঁর অভিযোগ, এলাকায় কোনও স্কুল নেই, নিকাশি ব্যবস্থাও ভাল নয়, রাস্তার হালও খারাপ। তাঁদের জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও পূরণ হয়নি বলে অভিযোগ রায়বাবুর। অভিযোগ, সরকারের তরফে কোনও কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি এ ব্যাপারে বহুবার বিডিও ও এসডিও-র কাছে তদবির করেও কোনও লাভ হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।

আরও পড়ুন,২০২১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারাবে বিজেপি: সুনীল দেওধর

পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে নারাজ আরেক সাবেক ছিটমহলবাসী ৪২ বছরের দেবীচরণ অধিকারী। তাঁর নিবাস মাথাভাঙার কাছে নলগ্রাম এলাকায়। ২ বিঘা জমি থাকা সত্ত্বেও তিনিও এখনও পর্যন্ত কোনও জমির কাগজ পাননি বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে তাড়াহুড়ো করে আমাদের ভোটার কার্ড দেওয়া হয়েছিল। আমরা ভোটও দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার দেব না।’’

এদিকে সাবেক ছিটমহলবাসীদের এই দুর্দশা নিয়েও একে অপরের বিরুদ্ধে দোষারোপ করা শুরু করেছে তৃণমূল ও তার এই মুহূর্তের প্রধান প্রতিপক্ষ বিজেপি। ‘‘উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে। কিন্তু এজন্য কিছুটা সময় লাগবে’’, বললেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। তাঁর অভিযোগ, বিজেপি ওই এলাকাবাসীদের উস্কানি দিচ্ছে, ভুল বোঝাচ্ছে। উন্নয়ন প্রসঙ্গে তাঁর দাবি, রাস্তার কাজ চলছে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রও তৈরি করা হচ্ছে, এলাকায় বিদ্যুৎ পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা যেসব ছিটমহলবাসী জমি পাননি, তাঁদের জন্য সরকার অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করে দিচ্ছে। তাঁদের বাচ্চারাও কাছকাছি স্কুলে যাচ্ছ। সাবেক ছিটমহলবাসীদের পঞ্চায়েত ভোট বয়কট প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন যে, তিনি তাঁদের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলবেন। ভোট দেওয়ার ব্যাপারে তিনি ক্ষুব্ধ ছিটমহলবাসীকে বোঝাবেন বলেও জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

অন্যদিকে কোচবিহারের বিজেপি জেলা সভাপতি নিখিলরঞ্জন দে বলেন, সাবেক ছিটমহলবাসীদের ক্ষোভ অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। ওই এলাকায় প্রায় কোনও কাজ হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। সাবেক ছিটমহলবাসীর জমির অধিকারের প্রশ্নই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি। রাজ্য সরকারকে নিশানা করে বিজেপি জেলা সভাপতি বলেন, সরকার ওঁদের জন্য ছোট অ্যাপার্টমেন্ট গড়ে দিচ্ছে, অথচ ওঁরা বাড়ি তৈরির জন্য জমি চান। প্রতিশ্রুতি মতো স্কুল, চাকরি এসব কিছুরই ব্যবস্থা করা হয়নি বলেও অভিযোগ করেন নিখিল। তাঁর বক্তব্য, কেন্দ্র টাকা বরাদ্দ করলেও কোনও কাজ হয়নি, এ ব্যাপারে কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হবে।

কোকোয়াবাড়ি এলাকায় ১৬টি পরিবারে মোট ৫২ জন ভোটার রয়েছেন বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে।

অনুলিখন- সৌরদীপ সামন্ত

panchayat vote
Advertisment