কেউ তাঁর হাত ধরে বিধায়ক হয়েছেন, কেউ বা সাংসদ। বাংলার কংগ্রেস রাজনীতিতে অনেকেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন 'ছোড়দা'র স্পর্শেই। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের প্রয়াণে তাই কংগ্রেসের বর্ষীয়াণ নেতৃত্বের বড় অংশ এক বাক্যে স্বীকার করলেন, সোমেন মিত্র না থাকলে তাঁরা নেতা হতে পারতেন না। সোমেন মিত্র যে তাঁকে খুবই স্নেহ করতেন, সেকথা বললেন বর্তমানে বিজেপি নেতা মুকুল রায়ও। রাজ্যের প্রবীণ মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বললেন, ছাত্র রাজনীতির সময় তিনি অনেক সহযোগিতা করতেন। সিপিএম-এর বর্তমান পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী আবার মনে করেন, সোমেন মিত্র চলে যাওয়ায় বাংলার রাজনীতিতে অনেক ক্ষতি হল।
সোমেন মিত্রের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নিজের স্কুল জীবনের কথা মনে পড়ে গেল বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মুকুল রায়ের। তিনি বলেন, "সেই ১৯৬৭ সালের কথা। তখন আমি স্কুলে লেখাপড়া করি। আমার বাড়ির আটটা বাড়ি পরে একটা মেস বাড়ি ছিল। বিধানসভা নির্বাচনে সেখানে ভোট করাতে গিয়েছিলেন সোমেন মিত্র। তখনই আমি খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি। তারপর বরকতদা (এবিএ গনিখান চৌধুরি) যখন রেলমন্ত্রী, তখন সোমেনদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছি। যখন এইমসে ভর্তি ছিলেন তখনও একবার দেখা হয়েছিল। অনেক কথা মনে পড়ছে আজ।"
কংগ্রেসে বরাবর প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির সঙ্গে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের নাম একসঙ্গে উচ্চারিত হত। সেই সুব্রত মুখোপাধ্যায় এদিন বলেন, "আমরা নকশালদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। ও কলকাতায় থাকত। আমরা মফঃস্বলের ছেলে। মফঃস্বল থেকে আসতাম। ছাত্র পরিষদ করতাম। সোমেন মিত্রের সহযোগিতা পেতাম খুব।"
রাজ্যে তৃণমূল ও বিজেপির সঙ্গে এক জোট হয়ে লড়াইয়ে সম্প্রতি বাম নেতাদের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন সদ্য প্রয়াত সোমেন মিত্র। একাধিক আন্দোলন কর্মসূচি রূপায়নও করেছেন। ফলে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তী মনে করেন, "বাংলার রাজনীতিতে নিঃসন্দেহে একটা বড় ক্ষতি। শুধু কংগ্রেস দলের কাছে নয়, বাংলার রাজনীতিতে তাঁর ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করি তখন থেকেই সোমেন মিত্রকে চিনতাম। অতুল্য ঘোষ যেমন বড় সংগঠক, তেমন সোমেনদা ব্লক, গ্রাম, বুথ স্তরের কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তাঁদের চিনতেন, জানতেন। সুবিধা অসুবিধার সময় পাশে থাকতেন। বড় সংগঠক ছিলেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সজ্জন, বড় মনের মানুষ।"
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির মৃত্যুতে রাজ্য কংগ্রেস অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল, এমনটা মনে করছেন অনেকেই। আজ কংগ্রেসের নেতৃত্বে রয়েছেন এমন অনেকের রাজনীতির হাতেখড়ি সোমেন মিত্রের মাধ্যমেই। তাঁরা সেই অবদানের কথা স্বীকারও করছেন। বর্তমানে লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা বহরমপুরের সাংসদ অধীর চোধুরী তাঁর জনপ্রতিনিধি হওয়ার কৃতিত্ব দিয়েছেন 'ছোড়দা'কে। অধীর চৌধুরী বলেন, "সোমেন মিত্রর মৃত্যুর খবর আমাকে বেদনাহত করেছে। শুধু রাজনীতি নয়, তাঁর সঙ্গে একটা আবেগের সম্পর্ক ছিল। তাঁকে আমার অভিভাবক বলে মনে করতাম। আমি যে কংগ্রেস রাজনীতিতে পদার্পণ করেছিলাম তা শুধু সোমেন মিত্রের হাত ধরেই। জনপ্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ দেওয়ায় কখনও বিধায়ক হয়েছি, কখনও সাংসদ হয়েছি। আমার রাজনীতির পিছনে সব থেকে বড় অবদান সোমেন মিত্রের। প্রিয়জনকে হারালাম। খুব খারাপ লাগছে। বাংলার কংগ্রেসের একটা অধ্যায় সমাপ্ত হল।"
বিধানসভার বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান বলেছেন, "আমি দাদাকে হারালাম"। আবদুল মান্নান আরও বলেন, "এটা খুব মর্মান্তিক ও দুর্ভাগ্যের। একজন প্রবাদপ্রতীম মানুষ নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতায় কংগ্রেসের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছিলেন। কারও যোগসূত্র ধরে তিনি নেতা হননি। কর্মীদের ভালবাসা ও সহযোগিতায় তিনি নেতা হয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে দলের কর্মীদের ক্ষতি হয়েছে। তাঁকে অভিভাবক হিসাবে জানতাম। আমার সঙ্গে তাঁর অনেক ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হয়েছে। কিন্তু মনান্তর কোনও দিন হয়নি। আমাকে ছোট ভাইয়ের মত দেখতেন। আমাকে পরিবারের একজন মনে করতেন। রাজ্য-রাজনীতিতে আমাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। আমাকে জোর করে বিধানসভায় দাঁড়ও করিয়েছেন"।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন