২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের উত্তেজনার পারদ চড়তে শুরু করেছে। তবে সাম্প্রতিক অতীতের বিধানসভা নির্বাচনগুলি থেকে এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, এবার ক্ষমতা দখলে রাখা তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে রীতিমত চ্যালেঞ্জিং। অন্যদিকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কথা-বার্তায় যেন মনে হতে পারে একুশে বাংলা জয়ের বিষয়ে তাঁরা অনেকটাই নিশ্চিত। এরই মধ্যে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের একটা অংশের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। প্রতিষ্ঠান বিরোধী হাওয়া তো রয়েছেই।
নির্বাচনে ঘর গোছানোর পালা চলছে। চলছে অঙ্ক কষা। তবে বেশ কিছু 'যদি' এবং 'কিন্তু' ২০২১-এর নির্বাচনে সব থেকে বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে। করোনা আবহেই বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম দুই সেনাপতি নিয়ে গুঞ্জন রয়েছে রাজনৈতিক মহলে। তৃণমূলে যাচ্ছেন না একথা ঘোষণা করতে সাংবাদিক বৈঠক করতে হয়েছে মুকুল রায়কে। শুভেন্দু অধিকারী সম্পর্কে জোর জল্পনা চললেও এখনও তিনি খোলাখুলি কোনও ঘোষণা করেননি। তবে তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বকে তিনি এড়িয়ে চলছেন তা একেবারে জলের মত স্পষ্ট। আবার তাঁকে এককভাবে কোনও দায়িত্ব না দেওয়ায় এটাও স্পষ্ট যে শুভেন্দুকে দল সেই অর্থে গুরুত্ব দিতে চাইছে না। পরস্থিতি এমনই যে এভাবে তিনি তৃণমূলে থাকবেন না অন্য কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন তা নিয়ে জল্পনা অব্যাহত।
বাংলার রাজনীতিতে এই মুহূর্তে মুকুল রায় ও শুভেন্দু অধিকারী অনেকটাই ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর তা যে কোনও রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিই স্বীকার করতে বাধ্য। একজনের তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক কৌশল, অন্যজনের সরাসরি জনসংযোগ। তবে নিজেদের দর বৃদ্ধি করাও রাজনীতিতে একটা বড় খেলা। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে তাঁদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন রাজনীতির কারবারিরা। তবে গুঞ্জন থাকলেও নতুন দল তৈরি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলায় যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তা অন্য কারও পক্ষে অসম্ভব বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। অতীতে তাবড় নেতৃত্ব এই রাজ্যে এ বিষয়ে ডাহা ফেল করেছেন। এবার নির্বাচনে একাধিক ফ্যাক্টর কাজ করবে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, দলে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া ভোট ক্যাচার কেউ নেই বললেই চলে।
এবারের মুসলিম ভোটের বড় অংশ কোন দিকে যাবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, সংখ্যালঘুদের একটা অংশের নানা কারণে তৃণমূলের ওপর ক্ষোভ রয়েছে। এঁরা বিজেপির উপরও ক্ষিপ্ত। এই অংশের ভোটাররা শেষ মুহূর্তে কী সিদ্ধান্ত নেবেন তা ২১-এর ভোটে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। এর ওপর একদিকে এমআইএম অন্যদিকে, ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির ঘোষণা আদৌ রাজনৈতিক ময়দান অবধি গড়ায় কি না তা-ও দেখার। সে ক্ষেত্রে ভোট রাজনীতির অঙ্কে পিছিয়ে পড়বে তৃণমূল কংগ্রেস। জয়-পরাজয়ের মার্জিনে ১টা ভোটও গুরুত্বপূর্ণ। তবে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে দেখা গিয়ছে সম্পূর্ণ মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামেও ভোট পড়েছে পদ্মফুলে। মুসলিম ভোটের একটা অংশ কংগ্রেস-সিপিএম জোটের ঝুলিতে যাওয়ার বড় সম্ভাবনা আছে।
২০১৯ লোকসভা ভোটেই মতুয়া ভোট আড়াআড়ি ভেঙে দু'টুকরো হয়ে গিয়েছিল। ঠাকুর পরিবারের সব ক্ষেত্রেই এখন পদ্মফুল ও ঘাসফুলের লড়াই। রাজনীতি তাঁদের উৎসবেও প্রভাব ফেলেছে। একচ্ছত্র ভোট ব্যাঙ্কও থাকছে না কোনও দলের। এবার নতুন ভোট ব্যাঙ্ক পরিযায়ী শ্রমিক ও তাঁর পরিবার। এমনই ভোট ব্যাঙ্কের নানা সমীকরণ রয়েছে ২১-এর নির্বাচনে।
২০১১-এ প্রবল বাম বিরোধী ঝড় উঠেছিল। ২০১৬ সালের নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস যৌথভাবে হাওয়া তোলার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস অধিক আসনে জয় পেয়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছে। কিন্তু এবারের নির্বাচনী প্রক্ষেপট সম্পূর্ণ পৃথক। রাজনীতির কারবারিরা মনে করেন, আমফান, করোনায় উদ্ভুত পরিস্থিতি, রেশন ব্যবস্থাই শুধু নয়, স্থানীয় নানা ইস্যুও বড় ফ্যাক্টর হতে চলেছে। বিশেষত স্থানীয় নেতৃত্বের একটা বড় অংশের আচার-আচরণ, ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গাড়ি, বাড়ি, ঠাঁট-বাট সবই চোখে পড়ছে আমজনতার। সিপিএম-এর শেষের দিক আর এখনকার পরিস্থিতি, অনেকটা একই রকম। ভোটের রাজনীতিতে অনেকেই জাতীয় বা রাজ্যের বড় বড় ইস্যুকে গুরুত্ব দেন। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় ইস্যু সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে অভিজ্ঞমহল। মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই সব থেকে বড় বিষয়। এসব ফ্যাক্টর কাটিয়েই লড়াইয়ে টিকে থাকতে হবে তৃণমূল কংগ্রেসকে।
ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরও একটা বড় বিষয়। কোথাও 'মাদার তৃণমূল' ও যুব তৃণমূলের সরাসরি লড়াই। টিকিট পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টাও রয়েছে। তখন এই লড়াই বন্ধ করতে না পারলে বড় সমস্যা রয়েছে। রাজনীতির কারবারিদের মতে, বিধানসভা নির্বাচনে সব পক্ষকে নিয়ে চলতে না পারলে ঘরের বিদ্রোহ সব থেকে বড় বিপদ হতে পারে তৃণমূল কংগ্রেসের। কথায় আছে ঘরের শত্রু বিভীষণ। এটাই বড় ভয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন