বিরাট ধাক্কা রাহুলের, আর সাংসদ নন কংগ্রেস নেতা, সদস্যপদ খারিজ করে দিলেন লোকসভার স্পিকার। এদিকে রাহুলের সাংসদ পদ খারিজ নিয়ে বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, "সত্যি কথা বলার জন্য রাহুল গান্ধীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। রাহুল ওবিসি সমাজ অর্থাৎ অনগ্রসর শ্রেণীকে অপমান করেননি। "
সুরাটের আদালত কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে মানহানির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করার একদিন পরে, লোকসভা সচিবালয় একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছে যে ২৩ শে মার্চ, ২০২৩ থেকে ওয়েনাডের সাংসদের লোকসভা সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে। শুক্রবার, বিরোধী সাংসদরা অধিবেশন শুরুর আগেই এক বৈঠক করেন। সংসদে রাজ্যসভার বিরোধীদলীয় নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গের অফিসে এবং পরে রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে মিছিল করে পোস্টার হাতে কংগ্রেসের তরফে দাবি করা হয়েছে, "গণতন্ত্র বিপন্ন"। বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে বিজয় চক এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। বিজয় চক থেকে কয়েকজন সাংসদকে আটক করা হয় বলেও পুলিশ সূত্রে খবর।
এদিকে গতকালের সাজা ঘোষণার পর আজ সকালে লোকসভায় আসেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। কংগ্রেস নেতারা তাকে সংসদে কথা বলার অনুমতি দেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ দেখায়। কিছু সময় পরে স্থগিত করা হয় লোকসভার কার্যক্রম। এদিকে রাহুলের সাজা এবং সাংসদ পদ বাতিলের বিষয়ে কংগ্রেস আজ রাজধানীতে একটি বড় আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছে। অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে দেখা করেন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব। আজ সকালে সংসদে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গের কার্যালয়ে বৈঠকে বসেন বিরোধী নেতারা।
কংগ্রেস নেতা এবং ওয়েনাডের সাংসদ রাহুল গান্ধীকে তার কথিত "মোদী উপাধি" মন্তব্যের জেরে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা ২০১৯ ফৌজদারি মানহানির মামলায় বৃহস্পতিবার দুই বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে, আদালত তাকে জামিন দেয় এবং ৩০ দিনের জন্য তার আদেশ স্থগিত করে যাতে কংগ্রেস নেতা উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারেন।
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেছেন, 'সত্যি কথা বলার জন্য রাহুল গান্ধীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। রাহুল ওবিসি সমাজ অর্থাৎ অনগ্রসর শ্রেণীকে অপমান করেননি। কংগ্রেস নেতা পিএল পুনিয়া বলেছেন যে 'সম্পূর্ণ ষড়যন্ত্রের শিকার রাহুল গান্ধী'। কংগ্রেস সাংসদ প্রমোদ তিওয়ারি বলেছেন যে আমাদের সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। দুর্নীতি, অন্যায় ও দেশ ভাঙার বিরুদ্ধে জোরালো কণ্ঠকে শান্ত করার চেষ্টা করা হয়। এটা বিজেপি সরকারের ষড়যন্ত্র, এতে গণতন্ত্র লজ্জিত।
জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ৮ ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, কোনো জনপ্রতিনিধি দুই বছর বা দুই বছরের বেশি সাজা হলে রায়ের দিন সদস্য পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি ৬ বছর অযোগ্য থাকবেন, অর্থাৎ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। প্রসঙ্গত, সুরাটের এক আদালত বৃহস্পতিবার তাঁকে ফৌজদারি মানহানির জন্য দোষী সাব্যস্ত করার পরে কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। আর, এটার নেপথ্যে ১০ জুলাই, ২০১৩ সালে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের এক যুগান্তকারী রায়ের জেরে। তার আগে আইন ছিল, দোষী সাব্যস্ত সাংসদ, বিধায়ক, বিধান পরিষদ সদস্যদের সমস্ত বিচার প্রক্রিয়া শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আসন ধরে রাখার অনুমতি পাবেন। ততক্ষণ পর্যন্ত পাবেন, যতক্ষণ না সুপ্রিম কোর্টে তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হন।
সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়ের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন মনমোহন সিংয়ের সরকার একটি অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল। কিন্তু, সেই অধ্যাদেশ ছিঁড়ে ফেলে বিক্ষোভ দেখান রাহুল। কংগ্রেসে তাঁর সমর্থকরাও এই বিক্ষোভে শামিল হয়েছিল। যার জেরে সরকার অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্সটি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
লিলি থমাস বনাম ভারত সরকার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে, ‘কোনও সাংসদ, বিধায়ক বা বিধান পরিষদ সদস্য, যিনি অপরাধের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং ন্যূনতম ২ বছরের সাজা পেয়েছেন, তিনি অবিলম্বে সংসদের সদস্যপদ হারাবেন।’ শীর্ষ আদালতের এই নির্দেশ জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ধারা ৮(৪)-কে ‘অসাংবিধানিক’ তকমা দিয়ে বাতিল করেছিল। আগের আইন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দোষমুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে উচ্চ আদালতে আবেদনের জন্য তিন মাসের ছাড় দিয়েছিল।
সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের দুই মাস পরে, ইউপিএ সরকার নির্দেশটি বাতিল করার জন্য একটি অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স পাস করেছিল। কারণ, পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি মামলায় দোষী প্রমাণিত হলে কংগ্রেসের মিত্র তথা আরজেডি সুপ্রিমো লালুপ্রসাদ যাদবের সাংসদপদ খারিজ হতে পারত। পাশাপাশি, প্রবীণ কংগ্রেস নেতা এবং রাজ্যসভার সাংসদ রশিদ মাসুদ সেই সময় একটি দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। আর, সাংসদ পদ খারিজের মুখে পড়েছিলেন। তাই, ইউপিএ সরকার সেই সময় অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশটি পাশ করেছিল বলে মনে করা হয়েছিল।
বিজেপি এবং বামপন্থী-সহ তৎকালীন বিরোধীরা এই অধ্যাদেশ বা অর্ডিন্যান্স নিয়ে মনমোহন সিং সরকার এবং কংগ্রেসের কঠোর সমালোচনা করেছিল। আর, দোষী সাব্যস্ত আইন প্রণেতাদের রক্ষা করার চেষ্টার অভিযোগ এনেছিল। এই অর্ডিন্যান্স বা অধ্যাদেশটি পাশ হওয়ার কয়েকদিন পরে, ২৭ সেপ্টেম্বর রাহুল দিল্লিতে দলের এক সাংবাদিক বৈঠক করেছিলেন। আজ এত বছর পরে সেই যুগান্তকারী রায়ের কারণেই সাংসদ পদ হারালেন রাহুল গান্ধি। এবার তিনি এবং তাঁর কংগ্রেস কী করে সেটাই দেখার।