তাঁতের শাড়ির জন্য বিখ্যাত নদিয়ার ফুলিয়া। ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশেই অলিখিত ভাবেই তাঁতের হাব গড়ে উঠছে। বেশ কিছু বড় শোরুম আছে। শুধু কি তাঁতের জন্য বিখ্যাত ফুলিয়া? স্টেশন থেকে বয়ড়া গ্রাম মেরেকেটে তিন কিলোমিটার। কালের নিয়মে বয়ড়া আজ কৃত্তিবাসের নামেই খ্যাত। পাশে বয়ে যাওয়া গঙ্গার পাড়ও তাই কৃত্তিবাস ঘাট।
কে এই কৃত্তিবাস? মধ্যযুগের সাহিত্যের ইতিহাসে কৃত্তিবাস ওঝার নাম জ্বল জ্বল করছে। বাংলা ভাষায় প্রথম রামায়ণ রচয়িতা কৃত্তিবাস। কথিত আছে, এই বই লিখেছেন বয়ড়া গ্রামের এক বট-বৃক্ষের নীচে বসে। বাংলার মনীষীদের সঙ্গে রামচন্দ্র এখন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বাংলায় রামায়ণকে জনপ্রিয় করেছিলেন কৃত্তিবাসী রামায়ণ। এমন মতামতের বিপক্ষেও রয়েছেন অনেকেই। যাঁরা এখনও কৃত্তিবাসের স্মৃতিকে আগলে রেখেছেন এবং সেখানকার বাসিন্দারা ভোটের আসরে রাম-বিতর্ক নিয়ে কী বলছেন তা জানতে বয়ড়ায় হাজির হয়েছিল ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার প্রতিনিধি।
প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে পর্যটকরা আসেন ফুলিয়ার বয়ড়ায়। কৃত্তিবাসের কীর্তির স্থান পরিদর্শনে বিদেশীরাও নিয়মিত আসেন এই গ্রামে। অন্যদিনের মতো বৃহস্পতিবারও দুপুরে হরিদাস মন্দিরে ভোগের আয়োজন চলছিল। একদিকে দেবতাদের ভোগ, অন্যদিকে গাভিসেবার আয়োজন। স্থানীয়দের মতে, এই প্রাঙ্গনেই রয়েছে কৃত্তিবাসের অস্থি-সমাধি। এদিকে সারা দেশের মধ্যে বাংলার এবারের বিধানসভা নির্বাচন অত্যন্ত তাতপর্যপূর্ণ। বাংলার নির্বাচনী রাজনীতিতে রামও অন্যতম ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদ্মশিবিরের জয় শ্রীরাম স্লোগান বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। এছাড়া বাংলার সংস্কৃতি অনুযায়ী কোন দেব-দেবী আগে, কে পড়ে তা নিয়ে তর্ক করতে ছাড়ছেন না রাজনীতিকদের একাংশ। এই বিতর্কও ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু কৃত্তিবাসের স্মৃতিকে আঁকড়ে বেঁছে থাকা মানুষগুলো কী বলছেন? তাঁরাও কী মতপার্থক্যে ভুগছেন? বাংলার প্রথিতযশা গবেষকরাই বা কী বলছেন?
ঘর-বাড়ি ছেড়ে ২০ বছর ধরে হরিদাসের মন্দিরে আছেন অমূল্য দাস। অকৃতদার এই প্রৌঢ়ার এটাই এখন সংসার। কী বলছেন অমূল্যবাবু? তিনি বলেন, "কৃত্তিবাস এখানে রামায়ণ রচনা করেছেন। রামকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করি। ত্রেতা যুগের অবতার হলেন শ্রীরাম। রাম বাঙালীর মধ্যে যথেষ্ট জনপ্রিয়।" জয় শ্রীরাম স্লোগান কী ভাবে দেখছেন? অমূল্যবাবুর জবাব, "এটাও সুন্দর ভাবেই দেখছি। এতে কোনও ভুল নেই। এটাকে আমি সমর্থন করি।"
কৃত্তিবাস, রামায়ণ, রাম নিয়ে মজে থাকলেও জয় শ্রীরাম স্লোগানে আপত্তি রয়েছে এখানকার দায়িত্ব সামলানো দাঁড়ি গোসাইয়ের। গুরুদেব তাঁর নাম রেখেছেন সুবল দাস। ষাটোর্ধ সুবলবাবু বলেন, "কৃত্তিবাস রামায়ণকে বংলায় ব্য়াখ্যা করেছেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণের কথা সারা বিশ্বের মানুষ জানেন। এই মন্দির হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। স্থানীয় বাধায় তা আপাতত আটকে গিয়েছে। কৃত্তিবাস ও হরিদাসের স্মৃতি টিকিয়ে রেখেছি ভিক্ষের মাধ্যমে। ত্রেতা যুগে রামই দেবতা তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।" তবে জয় শ্রীরাম স্লোগান নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন তিনি।
দাঁড়ি গোসাই বলছেন, "এটা তো ওরা করছে পয়সার লুঠবার জন্য। আমরা কোনও রাজনীতির মধ্যে থাকি না। ভগবানের ভোগ সময়মত দিতে হবে। আপনারা জয় শ্রীরাম করবেন না জয়রাম করবেন সেটা আপনাদের বিষয়। জয় নারায়ন করবেন, জয়কৃষ্ণ করবেন, জয় মহাপ্রভু করবেন, জয়ধ্বনি সকলের। রামচন্দ্রের জয় হলে রামের জয়জয়কার হবে। কে রামচন্দ্র বলল, কে ভজহরি বলল তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। রামচন্দ্রকে সমর্থন করছি। তাঁর অনুগত আমরা। ত্রেতা যুগে রামই ভগবান।" কিন্তু এই গোসাইয়ের জোরালে উক্তি, "আমরা স্লোগান মানি না, আমরা রামের পুজো করি। শ্রীরাম আমাদের ভগবান। তাই বলে স্লোগান দিতে হবে তা নয়।"
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি কৃত্তিবাস ওঝা। তিনি বাল্মিকী রামায়ণের বাংলা পদ্যানুবাদ করেছিলেন। গবেষকদের একাংশের মতে, মূল সংস্কৃত রামায়ণের ভাবানুবাদ করায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ জনপ্রিয়তা পায়। বাংলায় রামায়ণের জনপ্রিয়তায় কৃত্তিবাস ওঝার ভূমিকার কথা তাঁরা মানেন। যদিও এর বিপক্ষে মতামতও রয়েছেন গবেষকদের একাংশের। গ্রামবাসীরা মনে করেন, বয়ড়াতে রয়েছে কৃত্তিবাসের বহু স্মৃতি। রাজনীতিতে রামের অনুপ্রবেশ নিয়ে কৃত্তিবাসের গ্রামের বাসিন্দারা কী বলছেন? সেখানেও রয়েছে ভিন্নমত।
বেলঘড়িয়া এক নম্বর গ্রামপঞ্চায়েতের বয়ড়া সংসদের সদস্য অনুপ ঘোষ বলেন, "রামচন্দ্র সবার। রাম নিয়ে কেন রাজনীতি হবে? কৃত্তিবাসের গ্রামের বাসিন্দা হিসাবেও আমরা চাই না রাম রাজনীতিতে থাকুক।" স্থানীয় বেলঘড়িয়ার প্রবীণ বাসিন্দা সূর্যকান্ত দাস মনে করেন, "রাম নিয়ে রাজনীতি ঠিক না।" গ্রামের গৃহবধূ চিত্রা ঘোষের কথায়, "রামকে নিয়ে রাজনীতি না করাই ভাল।" কৃত্তিবাসের ঘাট সংলগ্ন মালিপোতা গ্রামের বাসিন্দা সুশীল সরকারের মতে, "জয় শ্রীরাম বলায় অসুবিধা কোথায়।"
কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাংলায় কতটা প্রভাব ফেলেছে? রাম বাঙলির কতটা কাছের? এসব নিয়ে ব্য়াখ্যা দিয়েছেন ভারতীয় মহাকাব্য এবং পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলাকে তিনি বলেন, "কৃত্তিবাসের রামায়নের জন্য রামায়ণ চর্চা এমন কিছু বাড়েনি। বাংলাতে রামায়ণ চর্চা হয়েছে একেবারে অ্যাকাডেমিক স্তরে। কৃত্তিবাসের পরে রামায়ণ জনপ্রিয় হলে সিরিজ অব রামায়ণ আসত, তা আসেনি। তার কোনও মুদ্রিত সংস্করণ নেই। রামচন্দ্র নিয়ে বাংলায় অত কিছু ভাবনা ছিল না। রামচন্দ্র নিয়ে সামান্য যে ভাবনা এসেছে তা চৈতন্যদেব জন্মানোর পর। চৈতন্য মহাপ্রভু তিনি পরম বৈষ্ণব ছিলেন। তিনি বলেছেন, কয়েকটা তিথি আমাদের করতে হবে। যেহেতু ভগবানের অবতার পুরুষ তাঁরা। বামন অবতারের জন্য বামনদ্বাদশী, নৃসিংহ অবতারের জন্য নৃসিংহ চতুর্দশী। রামের জন্য রামনবমী। এই তিথি পালনে বৈষ্ণবদের ঘরে সামান্য কিছু পুজা-পাঠ হত। তার জন্য রামচন্দ্রকে নৈবদ্য সমর্পণ করা হত। বাড়ির বিগ্রহের ওপরেই করা হত। আলাদা করে রামমূর্তি সাজিয়ে করা হত না।"
অধ্যাপক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর অভিমত, "অস্থি সমাধিসহ বয়ড়ায় কৃত্তিবাসের অনেক স্মৃতি প্রতীক হিসাবে পরে তৈরি হয়েছে। আমি নিজে আস্তিক লোক। বাড়িতে বিগ্রহ আছে। আমি রামকে ভগবান মনে করি। ফুলিয়ার তাঁতও বিখ্যাত, ফুলিয়ার কৃত্তিবাসও বিখ্যাত। রামায়ণ সমস্ত ভারতবর্ষ নয়, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডে ছড়িয়েছে, রাম নয়।"
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক স্মৃতিকুমার সরকার মনে করেন, কৃত্তিবাসের রামায়ণ রচনার পরেই বাংলায় রামায়ণ জনপ্রিয় হয়েছে। স্মৃতিকুমার সরকার বলেন, "কৃত্তিবাসী রামায়ণের আগে বাল্মিকীর রামায়ণ ছিল সংস্কৃত ভাষায়, হিন্দী ভাষায়, ছিল তুলসীদাসের রামায়ণ। বাঙালীর মধ্যে রামায়ণের চর্চা ছিল সংস্কৃত আশ্রিত পন্ডিতদের মধ্য়ে। সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে রামায়ণ চর্চা, যাত্রা, কতকথা, রামায়ন গান, রামের মন্দির এসব কৃত্তিবাস পরবর্তী যুগের ঘটনা। কৃত্তিবাস প্রথম বাংলা অনুবাদ করে ঘরে ঘরে রামায়ণ পৌঁছে দেয়। পূর্ববঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরবঙ্গে রামায়ণের জনপ্রিয়তা কৃত্তিবাসের জন্য়, আসাম মনিপুরেও জনপ্রিয়তারও একই কারণ।"
রাম নিয়ে বাঙালীর একাংশের ধারণার সঙ্গে একমত নন তিনি। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকার বলেন, "আমাদের ভুল ধারনা রামচন্দ্র বাঙালীর দেবতা নয়। হিন্দু ধর্মে ত্রেতা যুগের অবতার রমচন্দ্র। অনাবশ্যক এটা নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে। বাঙালীর অন্তরে রাম। বাইরের মানুষ এসে শিখিয়েছে কী হরে রাম, হরে কৃষ্ণ? এই স্লোগান দিয়েছিলেন চৈতন্যদেব। জয় শ্রীরাম ধ্বনি বিজেপি সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছে। গান্ধীজি রামরাজ্যের কথা বলার সময় কেউ তো আপত্তি করেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছাতে চাইছে বিজেপি। এটা নিয়ে প্রতিরোধের কোনও কারণ নেই।"
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন