শোভন-বৈশাখী শেষ পর্যন্ত কি বিজেপিতে থাকবেন? এ প্রশ্ন ঘিরে যখন তোলপাড় বঙ্গ রাজনীতি, ঠিক তখনই বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ করলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘকালের জীবনসঙ্গী রত্না চট্টোপাধ্যায়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে রত্না বলেন, ‘‘এই পরিস্থিতির জন্য শোভনবাবুর কোনও হাত নেই। ওঁকে মাটির পুতুলের মতো কাজ করানো হচ্ছে। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন নাচাচ্ছেন, তেমনই নাচছেন। ব্ল্যাকমেলিং করে যেমন শোভনবাবুর জীবনটা নষ্ট করেছিলেন, তেমনই পদের লোভে বিজেপির সঙ্গে ব্ল্যাকমেলিং করছেন বৈশাখী’’। এ প্রসঙ্গে বিজেপিকে কার্যত পরামর্শ দেওয়ার সুরে রত্না বলেন, ‘‘বৈশাখী ছাড়লে বিজেপি দলটা বেঁচে যাবে’’। তবে রত্না চট্টোপাধ্যায়ের এমন দাবিকে কার্যত উড়িয়ে দিয়েছেন অধ্যাপিকা তথা শোভন-বান্ধবী বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে তিনি বলেন, "রত্না চট্টোপাধ্যায় বিজেপি দলের কেউ নয়। ফলে আমি মনে করি, তাঁর এ বিষয়ে মন্তব্য করার কোনও অধিকারই নেই"। তবে শোভনবাবুকে তিনি 'নাচাচ্ছেন' বলে যে দাবি রত্না করেছেন, সে বিষয়ে নিজে কিছু বলতে চাননি বৈশাখী। এ প্রসঙ্গে শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, "দেখুন, আমি বাচ্চা ছেলে নই। সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই আমি আমার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার পরিবারের ক্ষেত্রে যা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তাও আমারই। এমন নয় যে কেউ আমায় নির্দেশ দেবে, আর আমি সেই অনুযায়ী কাজ করব। ওনার কোনও অধিকারই নেই 'শোভনবাবু ভাল বা অন্য কেউ মন্দ', এ ধরনের মন্তব্য করার। বরং উনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবুন, আমি কেন বাড়ি ছেড়েছি বা তাঁর সঙ্গে বিচ্ছেদের রাস্তায় হেঁটেছি এবং বিশ্বাস করে কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি। অনুগ্রহ করে উনি যেন এই ধরনের কথা না বলেন আর।"
আরও পড়ুন: ‘মহুয়া মৈত্রই আমাকে দেবশ্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন’, বিস্ফোরক দিলীপ
ঠিক কী বলেছেন রত্না চট্টোপাধ্যায়?
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-র সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রশ্নকর্তার মুখে ‘শোভন-বৈশাখী’র নাম শোনামাত্রই এদিন রত্না বলে ওঠেন, ‘‘ধুর! এই নাম দুটোই এখন আমার কাছে অভিশাপ। আমার জীবনটাও শেষ হল, অভিশাপ হয়ে রয়ে গেল’’। এরপরই শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে বিজেপির সাম্প্রতিক 'সমস্যা' সম্পর্কের প্রসঙ্গে রত্না বলেন, ‘‘এই যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে শোভনবাবুর কোনও হাত নেই। ওকে মাটির পুতুলের মতো কাজ করানো হচ্ছে। ওকে যেরকম নাচানো হচ্ছে, তেমনই নাচছেন। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ই নাচাচ্ছেন। বৈশাখী বিজেপিকে ব্ল্যাকমেলিং করে পদ নিতে চাইছেন। উনি পদের লোভে বিজেপিতে গিয়েছেন। ব্ল্যাকমেলিং করে শোভনের জীবন নষ্ট করেছেন। আমার মনে হয়, বিজেপির মতো একটা সর্বভারতীয় দল এই ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার হবে না’’।
আরও পড়ুন: বৈশাখী ‘নতুন বউ’! শোভন কী বললেন দিলীপকে?
এরপরই শোভন-বৈশাখী বনাম বিজেপি সংঘাত প্রসঙ্গে মুখ খোলেন রত্না। তিনি বলেন, ‘‘উনি (বৈশাখী) বলছেন, অপমানিত হয়েছেন। কীসে অপমানিত বোধ করছেন উনি? একটা সর্বভারতীয় দলের নিজস্ব নীতি-আদর্শ রয়েছে। সেই দল যা সিদ্ধান্ত নেয়, তা মানতে হবে। বৈশাখীদেবী তো সবটা জেনেই বিজেপিতে গিয়েছেন। এই দল করতে গেলে দলের নিয়ম মানতে হবে। না পারলে থাকবেন না। নিয়ম মেনে চলতে পারেননি বলেই তৃণমূল থেকে চলে গিয়েছেন। মমতা ওকে (শোভন) অনৈতিক জীবন থেকে বেরতে বলেছিলেন বলেই মমতার সঙ্গে বিরোধ হয়েছিল। বাড়িতে যা খুশি করতে পারি, দলে থাকলে দলের কথা মেনে তো চলতে হবে। সেই মানসিকতা না থাকলে রাজনীতি করা উচিত নয়। উনি (বৈশাখী) বিজেপি ছাড়লে বিজেপি দলটা বেঁচে যাবে’’।
আরও পড়ুন: মুকুলের খেলা? দেবশ্রীকে কে নিয়ে গিয়েছিলেন বিজেপি দফতরে, রহস্যভেদ করলেন বৈশাখী!
বৈশাখীর বিরুদ্ধে তোপ দেগে রত্না আরও বলেন, ‘‘উনি বলছেন সম্মানহানি করা হচ্ছে, কিন্তু ওঁর কীসের ভিত্তিতে সম্মানহানি হচ্ছে? বিজেপি কী করেছে? আমরা তো মানসচক্ষে দেখছি না যে বিজেপি ওদের (শোভন-বৈশাখী) সম্মানহানি করেছে। শোভনবাবুকে ডাকছেন, ওকে ডাকছেন না তাই অসম্মান হচ্ছে। আজ বিজেপি দলে বৈশাখীর মতো অনেক নেত্রী আছেন, কই তাঁরা তো কিছু বলছেন না। তুমি কে? শিক্ষকতা করার যোগ্যতা রয়েছে, কিন্তু রাজনীতিতে আনকোরা। কী করে আশা কর, বিজেপির সর্বোচ্চ পদ তোমাকে নিয়ে নাচবে। আমরা বহুদিন ধরে তৃণমূল করি। আমার বর মন্ত্রী ছিল। কিন্তু আমার কোনও পদ নেই। কর্মী হিসেবে কাজ করছি। কাউন্সলির, বিধায়ক, সাংসদের বৈঠক হয়, কই আমি তো যাই না’’।
আরও পড়ুন: বৈশাখীকে যৌন হেনস্থার অভিযোগ, পুলিশের দ্বারস্থ শোভন-বান্ধবী
সম্প্রতি, বিজেপি ছাড়ার সিদ্ধান্তের কথা জানানোর পর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা-কে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘মমতা যখন আমার সম্পর্কে চরম খারাপ কথা বলেছেন, তখনও কিন্তু তিনি এটাকে মিডিয়া ট্রায়াল হতে দেননি। উনি আমার নাম নিয়ে প্রকাশ্যে একটাও কথা বলেননি’’। এ প্রসঙ্গে রত্না চট্টোপাধ্যায় হেসে বলেন, ‘‘বাবা! তবুও ভাল, সৎ মা থেকে আবার মা হচ্ছে’’। এরপরই শোভন-পত্নী বলেন, ‘‘উনি আসলে ভীষণই কনফিউজড। তৃণমূলে থেকে বুঝতে পারছিলেন না মমতা কী স্ট্যান্ড নিচ্ছেন। আজ আবার অন্য দলে গিয়ে মনে হচ্ছে আগের দল ভাল ছিল। আমাদের দলের পতাকা নিয়ে মিছিল করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। যিনি আজ পর্যন্ত কোনও মিছিলে পা বাড়িয়েছেন কি না জানা নেই, তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশা করা আমার কাছে মুর্খামি’’। উল্লেখ্য, বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর সংবাদমাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শোভনের ‘সৎ মা’ বলে মন্তব্য করেছিলেন বৈশাখী। শোভনের ফোনে মমতার নম্বর ‘মা’ হিসেবে সেভ করা ছিল। এই প্রেক্ষিতেই সেদিন এমন মন্তব্য করেছিলেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়।
এক্সক্লুসিভ শোভন: মমতাকে তৈরি করতে সব নষ্ট করে জীবন দিয়েছিলাম, আর উনিই রাজনীতি করলেন
প্রসঙ্গত, গত শনিবারই রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের একাংশের উপর ক্ষোভ উগরে দিয়ে (যোগ দেওয়ার মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যেই) বিজেপি ছাড়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান বৈশাখী। তাঁর এই সিদ্ধান্তে সহমত পোষণ করে শোভনবাবুও। কলকাতার প্রাক্তন মহানাগরিকও যে বিজেপি ছাড়তে চান, সে কথাও সংবাদমাধ্যমে দাবি করেন বৈশাখী। এরপরই সোমবার রাতে দিল্লিতে কার্যত ‘মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে সাড়ে ৩ ঘণ্টা বৈঠক করেন মুকুল রায়। এ বৈঠকের পর ‘শোভন-বৈশাখী বিজেপিতেই ছিলেন, আছেন’ বলে মুকুল জানালেও, মঙ্গলবার রাতে কলকাতায় ফিরে শোভন চট্টোপাধ্যায় জানিয়ে দেন, ‘‘যে জটিলতা ছিল, তার সমাধান হয়েছে এমন কোনও কথা হয়নি’’। এদিকে, বুধবার সকালে কলকাতায় এসে কৈলাশ বিজয়বর্গীয় বলেন, ‘‘এটা শোভনবাবুর ব্যাপার, উনি ভেবে দেখুন’’। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, শোভন-বৈশাখীর সঙ্গে আর কোনও সমঝোতার পথে হাঁটতেই চাইছেন না বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। সে কারণেই এখন ‘শোভনবাবুর ভাবনা’ বলে কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের কোর্টেই বল ঠেলে দিয়েছে পদ্মবাহিনী। এই প্রেক্ষিতে শোভন-পত্নী তথা ‘মমতা ঘনিষ্ঠ তৃণমূল কর্মী’ রত্নার এহেন মন্তব্য ঘটনাক্রমে নয়া মাত্রা যোগ করল বলেই মত সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশের।