লোকসভার বিশেষ অধিবেশনে পেশ হল মহিলা সংরক্ষণ বিল। হট্টগোলের মধ্যেই নতুন সংসদ ভবনে অধিবেশনের প্রথম দিনে এই (সংবিধানের (১২৮তম সংশোধনী বিল, ২০২৩) বিল পেশ করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল। এই বিল সম্পর্কে বলতে উঠে লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী বলেন, রাজীব গান্ধী পুর ও পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠানগুলোয় মহিলা সংরক্ষণ নিশ্চিত করেছিলেন। মহিলাদের জন্য পুরসভা এবং পঞ্চায়েতে এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন- মহিলা সংরক্ষণ বিল! সবক্ষেত্রেই এক-তৃতীয়াংশ সংরক্ষণ, জটিল বিষয় জানুন সহজে
অধিবেশনে অধীর চৌধুরীর এই মন্তব্যের বিরোধিতা করেন শাসক বিজেপির সদস্যরা। তার প্রেক্ষিতে অধীর চৌধুরী জানান, কিছুক্ষণ আগে লোকসভায় বিজেপির নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী সংসদে 'ভাল আচরণ'-করার পরামর্শ দিয়েছেন। অথচ, বিজেপির সদস্যরা অন্যরকম আচরণ করছেন। হট্টগোল না-থামায় দুপুর ২টো ৪৭ পর্যন্ত অধিবেশন মুলতুবি করে দেওয়া হয়। অধীর চৌধুরীর প্রধানমন্ত্রীর উদাহরণ টানার কারণ, এই বিল সম্পর্কে তাঁর আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংসদে বক্তৃতা করেন। তিনি মহিলা সংরক্ষণ বিলের ইতিহাস এবং বিভিন্ন সরকার কীভাবে এটি চালু ও পাস করানোর চেষ্টা করেছিল, সেই সম্পর্কে বলেন।
আরও পড়ুন- কংগ্রেস কেন বলছে মহিলা সংরক্ষণ বিল আসলে তাদেরই, কী করেছিলেন রাজীব গান্ধী?
জনপ্রতিনিধিত্বে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের চিন্তাভাবনা নতুন কিছু নয়। বিহারে ১৯৪৮ সালে এই সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিক থেকেই সংরক্ষণ রয়েছে। তবে, সর্বভারতীয়স্তরে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত অকার্যকর ছিল। ১৯৯২ সালে ৭৩তম সবিধান সংশোধনী এই কাঠামো পরিবর্তন করতে চেয়েছিল। আর, ভারতজুড়ে নিয়মিত নির্বাচনের সঙ্গে একটি ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে যে, এই 'ধারা (১)-এর অধীনে সংরক্ষিত মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ তফসিলি জাতি বা তফসিলি উপজাতির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে।'
উপরন্তু বলা হয়েছে, 'প্রতি পঞ্চায়েতে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করা মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশের কম (তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতির মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা-সহ) সংরক্ষিত থাকবে। মহিলা এবং এই জাতীয় সংরক্ষিত আসনগুলো পঞ্চায়েতের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় ভাগ করা হতে পারে। ৭৪তম সংবিধান সংশোধনীটি পুরসভা এবং পঞ্চায়েতের মত বিভিন্ন স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য একইভাবে প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০০৯ সালে, পঞ্চায়েতের মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ (৩৩%) থেকে অর্ধেক (৫০%) মহিলাদের জন্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে লোকসভায় সংবিধান (১১০তম সংশোধনী) বিল পেশ করা হয়েছিল। বিলটি অবশ্য পাস হয়নি। ২০০৬ সালে, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের অধীনে মহিলা সংরক্ষণের শতাংশ ৫০%-এ উন্নীত করা হয়। বিহার এই ব্যাপারে প্রথম রাজ্যের তকমা পায়। এরপর সিকিম সেই পথ অনুসরণ করে এবং ২০০৮ সালে মহিলাদের জন্য পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৪০% সংরক্ষণ নীতি প্রয়োগ করে (যা এখন বেড়ে ৫০% হয়েছে)।
ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং উত্তরাখণ্ড পরবর্তীকালে পঞ্চায়েতে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ ৫০%-এ উন্নীত করার জন্য আইন পাস করেছে। বর্তমানে, মধ্যপ্রদেশ-সহ ২০টি রাজ্যে পঞ্চায়েতস্তরে মহিলাদের জন্য ৫০% আসন সংরক্ষণ রয়েছে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে কীভাবে পরিবর্তনগুলো গ্রাম, ব্লক এবং জেলাস্তরে প্রায় ১০ লক্ষ মহিলার নির্বাচনের পথ তৈরি করেছে। আর, তাতে কী প্রভাব পড়েছে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (এমআইটি) দ্বারা প্রকাশিত ২০০৩ সালের একটি সমীক্ষা এই মহিলা সংরক্ষণকে, 'আইন প্রণয়নের একটি যুগান্তকারী অংশ এবং কিছু পরিমাণে পরীক্ষামূলক' বলে একে অভিহিত করেছে। এমআইটি অনুযায়ী, 'সংরক্ষিত প্রধান-সহ গ্রামের মহিলারা আগের ছয় মাসে গ্রামপ্রধানের কাছে একটি অনুরোধ বা অভিযোগ করার সম্ভাবনা এতে দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। আর, সেই পার্থক্যটি রীতিমতো উল্লেখ করার যোগ্য।'
এনসিএইআর দ্বারা আয়োজিত ইন্ডিয়া পলিসি ফোরাম দ্বারা প্রকাশিত ২০১০ সালের এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, 'মহিলা নেতৃবৃন্দের গ্রামগুলোতে মহিলাদের অংশগ্রহণ এবং তাঁদের কণ্ঠস্বর বৃদ্ধি পেয়েছে।' সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে যে, 'সংরক্ষিত মহিলা নেতাদের সঙ্গে গ্রাম পরিষদগুলো পানীয় জলের পরিকাঠামো, নিকাশি, রাস্তা, স্কুল মেরামত, স্বাস্থ্যকেন্দ্র মেরামত এবং সেচের সুবিধার জন্য বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে।' বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের পঞ্চায়েতস্তরে স্বাস্থ্যের ফলাফলের ওপর লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স এবং অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির যৌথ উদ্যোগে ইন্টারন্যাশনাল গ্রোথ সেন্টার দ্বারা প্রকাশিত ২০১২ সালের এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, 'রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ প্রাতিষ্ঠানিক সম্ভাবনার সঙ্গে যুক্ত। এতে সন্তানের জন্ম অনেক নিরাপদ হয়। সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা আরও ভালো হয়।'
আরও পড়ুন- মহিলা সংরক্ষণ বিল: মোদীর ক্যাবিনেট ছাড়পত্র দিতেই সনিয়া বললেন ‘এটা আমাদেরই’
এই গবেষণায় আইনের সীমাবদ্ধতাগুলোকেও দেখানো হয়েছে। বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে, প্রচলিত লিঙ্গের ধারণা বদলকেও তুলে ধরা হয়েছে। একজন মহিলা নেতাকে দেখার পর তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর মত বিষয়গুলোও এক্ষেত্রে সামনে এসেছে। এমআইটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে সাক্ষাত্কার নেওয়া মহিলাদের মধ্যে ৪৩% স্বীকার করেছেন যে তাঁদের স্বামীরা নানা কাজে সহায়তা করেন। এমনকী, তাঁরা যদি গ্রাম পর্যায়েও কাজ করেন, সেক্ষেত্রেও সহায়তা করেন তাঁদের স্বামীরা। গবেষকরা অবশ্য বিষয়টি ভালো চোখে দেখেননি। তাঁরা মনে করছেন, মহিলা জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে 'দ্বিধাবোধ' নির্ভরশীলতার জন্ম দিয়েছে। এই দ্বিধাবোধ এসেছে, 'নারী কার্যকর নেতা নন, এমন ধারণা' থেকে।